আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে বিএনপির সমাবেশ আজ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১২ নভেম্বর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:০৬ পিএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
গত ১৪ বছরে বৃহত্তর ফরিদপুরের একটি আসনেও জেতেনি বিএনপি। ২০০৮ ও ২০১৮ সালে এ অঞ্চলের পাঁচ জেলার ১৫টি আসনেই বিপুল ভোটে হেরেছে তারা। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী বিএনপি বৃহত্তর ফরিদপুরের ১৬টি আসনের (একটি আসন বিলুপ্ত) মাত্র একটি পেয়েছিল। ২০০১ সালে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও আওয়ামী লীগের ঘাঁটিখ্যাত ফরিদপুর অঞ্চলে পেয়েছিল মাত্র পাঁচটি আসন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন বাদে কখনোই গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুরে জয়ের মুখ দেখেনি ধানের শীষ।
আওয়ামী লীগের এমন শক্তিশালী দুর্গে আজ শনিবার বিভাগীয় গণসমাবেশ করতে যাচ্ছে বিএনপি। খুলনা, রংপুর, বরিশালের পর ফরিদপুরেও একই কায়দায় ধর্মঘট ডেকে গণপরিবহন বন্ধ করা হয়েছে। যেসব বাস রাজধানী ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে ফরিদপুর হয়ে চলে, সেগুলোও গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে বন্ধ। ফরিদপুরে আসার পথে বাধা পাচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মী। পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে দলটির কর্মীদের বাড়িতে তল্লাশি ও পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
গত এক মাসে যেখানে বিএনপির সমাবেশ হয়েছে, সেখানেই তিন চাকার যানবাহন বন্ধের দাবিতে বাস ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। সমাবেশ শেষ না হতেই ওইসব ধর্মঘট শেষ হয়েছে। ফরিদপুরেও কৌশল অভিন্ন। আজ সকাল ১১টায় সমাবেশ শুরু হয়ে বিএনপির সমাবেশ সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে। আর ধর্মঘট চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। তবে বিএনপির চেয়ে বেশি ভোগান্তি হচ্ছে সাধারণ মানুষের। রাজধানী ঢাকায় যুবলীগের যুব মহাসমাবেশে যোগ দিতে গতকাল ফরিদপুর থেকে নেতাকর্মী বোঝাই বাস যাত্রা করলেও সাধারণ যাত্রীরা আটকা পড়েন। বিএনপির কর্মসূচির আগের দিনই সারাদেশ থেকে সড়কপথে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ফরিদপুর।
বাস না চললেও আগের দিনে বিএনপির সমাবেশস্থল প্রায় পূর্ণ হয়ে গেছে নেতাকর্মীতে। জেলা শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে কোমরপুর আবদুল আজিজ ইনস্টিটিউশন মাঠে সমাবেশের অনুমতি পেয়েছে বিএনপি। এ মাঠের ধারণক্ষমতা ২০-২২ হাজার। তবে গতকাল দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, কয়েক হাজার নেতাকর্মী অবস্থান করছেন। বাধা এড়াতে বিএনপির যেসব নেতাকর্মী গত বৃহস্পতিবার ফরিদপুরে এসেছেন, তাঁদের একটি বড় অংশ সেদিন থেকে সমাবেশস্থলে থাকছেন। জুমার জামাত মাঠেই পড়েন তাঁরা।
ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশালের মতো ফরিদপুরেও বিএনপির কর্মীরা সমাবেশস্থলে খোলা আকাশের নিচে, গাছে নিচে, বিভিন্ন ভবনের বারন্দায় মাদুর পেতে রাত কাটাচ্ছেন। মাঠেই রান্না ও খাওয়া চলছে। তাঁরা দিনভর স্লোগান দিচ্ছেন। এক দিনের সমাবেশ তিন দিনে রূপান্তরিত হয়েছে। কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে সন্ধ্যার পর বসছে গানের আসর। শীতে বয়স্ক অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আশপাশের গ্রামবাসী কেউ কেউ বিএনপি কর্মীদের থাকা-খাওয়া ও গোসলের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা গতকাল ফরিদপুর আসেন এবং সমাবেশস্থল পরিদর্শন করেন। কর্মীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় নেতারাও রাতে খোলা আকাশের নিচে মাঠে থাকবেন বলে জানিয়েছেন।
সমাবেশস্থলের কাছাকাছি আওয়ামী লীগের উপস্থিতি ও মহড়া না থাকলেও গতকাল বিকেলে শহরের রাসেল স্কয়ারে জমায়েত হয়ে মিছিল করে ক্ষমতাসীন দল। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শামীম হক বিএনপিকে হুঁশিয়ার করে বলেন, নৈরাজ্য হলে জবাব দেওয়া হবে। তিনি জানান, বিএনপির সমাবেশ চলাকালে রাসেল স্কয়ারে অবস্থান নেবেন আওয়ামী লীগ কর্মীরা।
যদিও শামীম হকের দাবি- বিএনপির সমাবেশ সফল করতে সহযোগিতা করছে আওয়ামী লীগ। তাঁর ভাষ্য, বিএনপির সমাবেশে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা ফরিদপুরের অতিথি। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা আমার ভাই, আমার বন্ধু। বিভিন্ন জেলার লোক এনে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেবেন না। একসঙ্গে আছি; থাকতে চাই।
পরিবহন বন্ধে মানুষের কষ্ট: রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সকাল থেকে পাঁচটি রুটের একটিতেও বাস চলেনি। গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, এ জেলা থেকেও বাস বন্ধ। বরিশাল ব্যুরো জানিয়েছে, গত শুক্রবার ও শনিবার এ বিভাগে বিএনপির সমাবেশের কারণে গণপরিবহন চলেনি। এ সপ্তাহেও দু'দিন বাস বন্ধ ফরিদপুরের সমাবেশের কারণে। বরিশাল বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি গোলাম মাশরেক বাবলু জানান, বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার বাস ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে ঢাকায় যায়। ফরিদপুরের ধর্মঘটে বরিশালের বাস চলছে না।
হানিফ পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, যেসব বাস ঢাকা থেকে আরিচা ঘাট এবং ভাঙ্গা হয়ে চলে, সেগুলো বন্ধ রয়েছে।
প্রবেশপথে পুলিশের তল্লাশি: ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের সংযোগ মোড়ে পুলিশের চেকপোস্ট দেখা গেছে। শুক্রবার সকালে সরেজমিন দেখা গেছে, রাজবাড়ী থেকে ফরিদপুরে আসার পথে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের বাহিরদিয়া সেতুতেও চেকপোস্ট বসেছে। শহরের মুন্সিবাজার এবং ফরিদপুর-চরভদ্রাসন সড়কের গজারিয়াতেও তল্লাশি করা হচ্ছে। প্রাইভেটকার, অটোরিকশাতেও তল্লাশি করছে পুলিশ।
বিএনপি নেতাকর্মীর অভিযোগ, সমাবেশে আসার পথে তল্লাশিতে পড়তে হয়েছে। আবাসিক হোটেলেও হানা দিচ্ছে পুলিশ। সমাবেশের সমন্বয়ক বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, জানা ছিল- আওয়ামী লীগ গণপরিবহন বন্ধ করবে; তিন চাকার গাড়ি বন্ধ করবে; রাস্তায় পুলিশ ও ক্যাডার নামাবে। রংপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা ও বরিশালেও করেছে। বিএনপিরও জানা আছে, এসব প্রতিবন্ধকতা কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়।
পথে বাধা: রাজবাড়ীর পাংশা থেকে আসা নেতাকর্মী জানান, বাধা এড়াতে মধ্যরাতে চারটি বাসে এসেছেন দেড়শ জন। পথে বাস থামানোর চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ কর্মীরা। কিন্তু বিএনপির লোকজন বেশি থাকায় পারেনি। তবে কয়েকজনের কর্মীর মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছে।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার হাওলাদার জানান, ধর্মঘট এড়াতে আগেভাগে এসেছেন। তার পরও বাধায় পড়েছিলেন। শুভ নামে এক ছাত্রদল কর্মী রাজবাড়ী হয়ে আসার পথে আওয়ামী লীগের মারধরের শিকার হয়েছে।
ফরিদপুর মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব গোলাম মোস্তফা মিরাজ বলেন, শুধু পথে বাধা নয়; রাতবিরাতে বিএনপি নেতাকর্মীর বাড়ি বাড়ি আওয়ামী লীগ কর্মী ও পুলিশ যাচ্ছে। সমাবেশে না যেতে শাসাচ্ছে তারা।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহজাহান সমকালকে বলেন, এ রকম সমাবেশে অনেক সময় অপরাধীরা ঢুকে পড়ে। বৃহস্পতিবার তল্লাশিতে মাদকসহ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। সমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করতে নয়; আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতেই পুলিশ কাজ করছে।
রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বাস বন্ধ থাকায় অটোরিকশা, ইজিবাইকে যাচ্ছেন বিএনপি কর্মীরা। জেলা বিএনপি নেতা আবুল কাশেমের অভিযোগ, আলাদিপুর, গোয়ালন্দ মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে বাধা দিচ্ছে পুলিশ। তবে রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সালাউদ্দিন জানান, নাশকতা ঠেকাতে নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে তল্লাশি চলছে।