ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাওয়া তরুণের মাথাপিছু আয় কত?
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৯ ফেব্রুয়ারী,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৪:৫০ পিএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
দেশে কথা বলার প্রতিযোগিতা হলে তাতে রাজনীতিবিদরা যে প্রথম হবেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর তিনি যদি হন সরকার দলীয় কোনও বড় নেতা, তাহলে তো কথাই নেই। সরকারি দলে থাকলে কাজ যতটা না করতে হয়, বলতে হয় তার কয়েকগুণ। বলার এই প্রতিযোগিতায় কেউ দেশকে বানান লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, ভেনিস, কেউ বা বলেন ১০ বছর পর বিদেশ থেকে ফিরে মানুষ বলে ‘কোথায় এলাম? সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক না দুবাই?’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মাঠে ‘হল সম্মেলন ২০২২’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এই প্রশ্নটিই রাখেন জাহাঙ্গীর কবির নানক।
যেনতেনভাবে মেয়াদের পর মেয়াদ ক্ষমতায় থাকলে একদিকে যেমন লন্ডন-প্যারিস-নিউ ইয়র্ক-দুবাইতে বাড়ি কিনে সেখানে নিজের দেশ বানানো যায়, তেমনি দেশে থাকার সময়েও নিজের চারপাশে সেসব শহরের আমেজ আনা যায়। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের অবস্থার কোনও হেরফের হয় না।
আওয়ামী লীগ তাদের উন্নয়ন বোঝাতে কিছু মেগা প্রকল্পের নাম, যেমন- পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভারের সঙ্গে সঙ্গে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয়ের কথা অবধারিতভাবে নিয়ে আসে। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি বিষয়টি গোলমেলে। যেকোনও কাজ হলেই প্রবৃদ্ধি বাড়ে। সেই কাজ যে জনস্বার্থে, মানুষের কল্যাণে হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। এই যেমন দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বনিম্নমানের রাস্তা একবার ভেঙে দশবার বানালে, পৃথিবীর দূষিততম শহর ঢাকার বাতাসে শ্বাস নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে, করোনায় আইসিইউ বা হাইফ্লো অক্সিজেন না পেয়ে রোগী মারা গেলে, সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বানালেও জিডিপি বাড়ে। সুতরাং জিডিপি বাড়লেই দেশ ভালো আছে, মানুষ ভালো আছে, তেমনটি নয়।
মাথাপিছু আয় তো আরও গোলমেলে। শত কোটি টাকার সম্পদের মালিকের সঙ্গে যখন একজন ভ্যানচালক, রিকশাওয়ালা কিংবা খণ্ডকালীন গৃহকর্মীর আয়ের গড় হিসাব করা হয়, তখন তো সবাই কোটিপতি। মাথাপিছু আয় আর জিডিপি আবার সরাসরি সম্পৃক্ত। দেশের মোট জিডিপিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যায় মাথাপিছু আয়। এসব নানা ভাগ যোগের হিসাব শেষে অর্থমন্ত্রী জানালেন, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে আমাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ৩ হাজার ৮৯ মার্কিন ডলারে। সাদা বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, ৪ সদস্যের এক পরিবারের মাসিক আয় হবে ৮৭,৫০০ টাকা। মজা মন্দ নয়।
যদিও এই ডাটার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই আছে অনেক প্রশ্ন। রাষ্ট্রীয় ডাটার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে তৈরি বিশ্বব্যাংকের সূচকে (স্ট্যাটিসটিক্যাল ক্যাপাসিটি স্কোর) ক্রমাবনতি হতে হতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের এখনকার অবস্থান আফগানিস্তান ছাড়া আর সব দেশের নিচে। অর্থাৎ জিডিপি প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়ের যে তথ্য সরকার দেয় সেটা অনেক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেওয়া হয়, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
কিছু দিন আগে দুটো খবর প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং পরে মূলধারার গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে। একটি খবরে বলা হয়, হাসপাতালের ২৬ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করতে না পেরে নবজাতক সন্তানকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করলেন মা। যদিও পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে মা ফিরে পান তার সন্তানকে, কিন্তু সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আলোচনা। দারিদ্র্য কত ভয়ংকর হলে নিজের সন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হন মা। এছাড়া সন্তান জন্মতো হঠাৎ ঘটা কোনও মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি নয়। এর জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতির সময় পাওয়া যায়। প্রস্তুতির এই সময়ের মধ্যেও যখন একটি পরিবার মাত্র ২৬ হাজার টাকা জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়, তখন তাঁদের দুর্দশা বুঝতে আর বাকি থাকে না। অথচ অর্থমন্ত্রীর অংক বলছে এই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মাথাপিছু মাসিক আয় ২১ হাজার ৮৮০ টাকা। মাথাপিছু আয় আর জিডিপি প্রবৃদ্ধির গোলমেলে হিসাবের শুভঙ্করের ফাঁকি বুঝতে আর কী লাগে?
আরেকটি ঘটনা বগুড়া শহরের। এক যুবক দুই বেলা ভাতের বিনিময়ে প্রাইভেট টিউশনি করতে বিজ্ঞাপন দিয়েছে সারা শহরে। ঋণের টাকায় কেনা গরু চরানো, সেটার খাবারের জন্য ঘাস কাটার পাশাপাশি পড়াশোনা করা ছেলেটি এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করার টাকা পেয়েছিল মায়ের সোনার কানের দুল বিক্রি করার মাধ্যমে। আর এইচএসসির পর শহরে গিয়েছিল স্নাতক আর স্নাতকোত্তর করতে। সেখানেও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাহায্যে কৃতিত্বের সঙ্গে সেটা সম্পন্ন করে। তারপর হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজেছে সে, কিন্তু পায়নি। টিউশনি করে জমানো কিছু টাকা শেষ হয়ে যায় চাকরির ইন্টারভিউ দিতে দিতে। কিন্তু চাকরি হয় না আর। সর্বশেষ করোনার কারণে অনেক বেশি সংকটে পড়ার পর একটি টিউশনি পেয়েছিল, যাতে তার রাতের খাবারের নিশ্চয়তা হয়। তাই সকাল আর দুপুর এই দুইবেলা খাবারের বিনিময়ে একটি টিউশনি পাবার মরিয়া চেষ্টা করে সে। বিজ্ঞাপন দেওয়ার কারণ হিসাবে সে বলে, ‘আসলে যার ঘা, তারই ব্যথা। সাত মাস ধরে একবেলা খেয়ে দিন যাচ্ছে। ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে একান্ত বাধ্য হয়েই এই বিজ্ঞাপন দিয়েছি।’
দিনে মাত্র একবেলা খাবারের এই যন্ত্রণা কেবল তার একার না। করোনার আগেই সরকারি সংস্থা বিবিএস-এর করা এক জরিপ বলছিল, ঢাকাসহ দেশের অসংখ্য মানুষ দিনে মাত্র একবেলা খায়, এমনকি সারা দিনে একবেলা খাবার খেতে পায় না, এমন মানুষও আছে লাখ লাখ। করোনার আগেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে করোনার এই ভয়ংকর সময়ের পর এখনকার অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
২০২১ সালে প্রকাশিত সানেমের রিপোর্ট বলছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে। একই ধরনের বক্তব্য আসছে ব্র্যাক, পিপিআরসি’র গবেষণা থেকেও। অর্থমন্ত্রী অবশ্য সাফ জানিয়ে দিয়েছেন এসব সংস্থার রিপোর্ট তিনি মানেন না। তবে এসব সংস্থার রিপোর্ট না মানলে সরকারি সংস্থা দিয়ে জরিপ করানোর যে দায় এসে পড়ে সেটিও কাঁধে নিতে তিনি নারাজ।
বেঁচে থাকার তীব্র লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত সেই মায়ের কাছে কিংবা দুই বেলা ভাতের বিনিময়ে টিউশনি করতে চাওয়া বগুড়ার সেই যুবকের কাছে নিশ্চিতভাবেই ঢাকাকে দুবাই, সিঙ্গাপুর কিংবা ব্যাংকক মনে হয় না। মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৮৯ মার্কিন ডলার বা তারও কয়েকগুণ বেশি হলেও সেটার কোনও প্রভাব পড়বে না তাদের জীবনে। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি বাড়লো নাকি কমলো তাতেই বা কি আসে যায় এই মানুষগুলোর? রাষ্ট্রের এই মানুষগুলোর কথা যাদের ভাববার কথা তারা ব্যস্ত উন্নয়নের হিসাব কষায়। যে উন্নয়ন কাগজে, কলমে আর কেতাবে থাকে, সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে যার যোগ পাওয়া যায় না কোনও দিন।