avertisements 2

রুটিন আন্দোলনের ফাঁদে বিএনপি!

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩০ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:০৪ এএম, ৪ মে,শনিবার,২০২৪

Text

নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই ইতোমধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এদিকে সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে বিএনপি ও সমমনা জোটের আন্দোলনও অবরোধ-হরতালের ফাঁদে। সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক পর্যায়ের চাপও নিজেদের অনুকূলে আসেনি।

দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। শীর্ষ তিন নেতা হাসপাতালে, প্রবাসে ও কারাগারে। সিনিয়র নেতারা আত্মগোপনে। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা জনমনে প্রশ্ন থাকলেও দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, এখনো আন্দোলনের বিকল্প নেই তাদের কাছে। তবে নেতারা আশা করছেন শিগগিরই পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে আসবে।

বিএনপি নভেম্বরের শুরু থেকে প্রতি সপ্তাহের রবি-সোম ও বুধ-বৃহস্পতিবার চার দিন হরতাল-অবরোধ পালন করে আসছে। জামায়াত ও সমমনা দলগুলো তাদের এ কর্মসূচির সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে। এসব কর্মসূচি ঘিরে চোরাগোপ্তা হামলার ঘটনা ঘটলেও রাজপথে নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি অনেকটাই শূন্য। আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা না থাকার বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। টানা আন্দোলনে আশানুরূপ ফল না আসায় অনেকের মধ্যেই এখন হতাশা বিরাজ করছে। যারা এতদিন ঝটিকা মিছিল নিয়ে দিনে দুই-তিন দফা রাস্তায় নেমেছেন, তারাও এখন নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। কর্মসূচিতে কোনো ধরনের নতুনত্ব না এনে দীর্ঘমেয়াদে রুটিন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ায় মাঠের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

দলের একাধিক নেতা আলাপকালে জানান, তাদের কাছে তথ্য আছে, সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়বে। এরই মধ্যে ক্ষমতাসীনরা নতুন বার্তা পেয়েছে। এছাড়া দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক, মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নির্বাচনের জন্য মোটেও উপযোগী নয় দেশের পরিস্থিতি। এ অবস্থায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। এছাড়া সরকারের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর চালানো দমন-পীড়নে প্রতিদিনই বিরোধী দলের কয়েকশ’ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আন্দোলনের পাশাপাশি এসব কারণে শিগগিরই পরিস্থিতি অনুকূলে আসতে পারে বলে মনে করছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।

তবে টানা আন্দোলনে নেতাকর্মীরা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও আপাতত হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতেই থাকছে বিএনপি। আজ বুধবার অবরোধ এবং কাল বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিনে সারা দেশে হরতাল কর্মসূচি দিয়েছে দলটি। এরপর ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন সামনে রেখে নতুন কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা করছেন নেতারা। সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরের প্রথম ভাগে টানা হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি নাও থাকতে পারে। এ সময় বিক্ষোভ-সমাবেশের মতো কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক দলগুলোর কাছ থেকে। আর ৭ জানুয়ারি ঘিরে বড় কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দলের নেতারা।

বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, ৭ জানুয়ারি ভোটের দিনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের আরেকটি পর্ব শুরু হবে। মনোনয়নপত্র দাখিলের পর থেকে ভোটের দিনের মধ্যের দিনগুলোতে বিক্ষোভ, পদযাত্রা ও ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা চলছে। পরিস্থিতি বুঝে ফাঁকে ফাঁকে হরতালও দেওয়া হতে পারে।

নেতারা জানিয়েছেন, এছাড়া ‘ন্যায়বিচার’ বঞ্চিত হয়ে দন্ডিত ও কারাবন্দি নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের নিয়ে উচ্চ আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণমূলক একটি কর্মসূচির চিন্তাও করা হচ্ছে। খুব শিগগির ঢাকায় এই কর্মসূচি হতে পারে।

এদিকে অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের অনেকের ধারণা, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই অত্যন্ত সূক্ষ্ম কৌশলে বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলোকে রুটিন আন্দোলনের ফাঁদে ফেলে রেখেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজপথে ব্যস্ত রেখে তাদের টার্গেট অনুযায়ী নির্বাচনী মিশন সফল করার পথে হাঁটছে। হরতাল-অবরোধে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হলেও এর ‘বেনিফিট’ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের ঘরেই উঠছে। কেননা এসব নাশকতার ঘটনাকে সামনে এনে তারা দেশের সাধারণ মানুষ ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছে। অন্যদিকে হরতাল-অবরোধে পণ্য পরিবহণ স্বাভাবিক রাখা দুষ্কর হওয়ায় জিনিসপত্রের দাম আরও ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে- এ বার্তা ছড়িয়ে দেশের জনগণকে বিএনপি-জামায়াতের বিপক্ষে দাঁড় করানোর মিশন সহজেই সফল হচ্ছে। আন্দোলন কর্মসূচির ভোগান্তিও বিরোধী দলগুলোর জনসমর্থনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রুটিন আন্দোলনে নেতাকর্মীদের মধ্যে শৈথিল্য ও একঘেঁয়েমি সৃষ্টির বিষয়টি বিএনপির প্রথম সারির নেতারাও নিঃসংকোচে স্বীকার করে জানান, আন্দোলন কর্মসূচিতে কীভাবে এবং কী ধরনের বৈচিত্র্য আনা যায় তা নিয়ে ভাবছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।

দলের কর্মকৌশল প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন এমন নেতারা জানান, অসহযোগ আন্দোলন করার পরিস্থিতি এখন দেশে নেই। সরকারকে অসহযোগিতা করে কর্মস্থলে না যাওয়া, কলকারখানা বন্ধ রাখা কিংবা অফিস-আদালত বন্ধ রাখার মতো বাস্তবতা নেই। আর গুরুত্বপূর্ণ ভবন ঘেরাও করতে হলে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে জড়ো করতে হবে। গ্রেপ্তার এড়াতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের গা-ঢাকা দেওয়াও কঠিন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থাকায় তাদের অবস্থান দ্রুত চিহ্নিত করা সম্ভব। তাই এ ইস্যুটিকে তারা আন্দোলনের ছকের বাইরে রাখার প্রস্তাব করেছেন। তবে অবরোধ রেখে ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তাব একেবারে নাকচ করে দেননি নীতিনির্ধারকরা।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা মনে করেন, সর্বোচ্চ ধাপের আন্দোলনে নামার সময় ঘনিয়ে আসলেও তাদের এ ব্যাপারে কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার এড়িয়েই আন্দোলন বেগবান করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এভাবে তাদের কতটা সক্রিয় করে তোলা যাবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি তাদের আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সংশ্লিষ্টতার কথা বললেও তাদের হরতাল বা অবরোধের মতো কর্মসূচি মানুষের সমর্থন আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি ২০১৪-১৫ সালে এই ধরনের কর্মসূচি দিয়েও নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি, তাদের আন্দোলনও সফল হয়নি। এভাবে আন্দোলন করে লক্ষ্য কতটা অর্জন করতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।’

বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলমান আন্দোলনে তাদের ওপর মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় থাকার নির্দেশনা আসলেও সামনের দিনগুলোতে কর্মসূচি ঠিক কী হবে, সে বিষয়ে এখনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর কমিটির একজন যুবদল নেতা বলেন, ‘আন্দোলনের মাঠে কর্মীদের নামতে বললে তারা নেতাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আন্দোলনের শেষ ধাপের কৌশল-কর্মপরিকল্পনা জানতে চান। অথচ তাদের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো বার্তা নেই। ফলে রাজপথের আন্দোলনে কর্মীদের সংঘবদ্ধ করে পিকেটিংয়ে নামানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তবে প্রথম সারির একজন নেতা জানান, ধারাবাহিক আন্দোলন এবং পশ্চিমা বিশ্বের অব্যাহত চাপে শিগগির পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। সেজন্য আরও কিছু দিন আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।

এদিকে সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া তফসিল ঘোষিত হলেও সরকার যদি যুক্তরাষ্ট্রের চাপে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়, তাহলে বিএনপির নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়ে তারা ইতিবাচক হতে পারে। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে এর মধ্য দিয়ে তৈরি হতে পারে সংলাপের পরিবেশ।

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন ইস্যুতে সৃষ্ট বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট একমাত্র আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই উত্তরণ সম্ভব। সংলাপের সুযোগ এখনো রয়েছে, শুধু সদিচ্ছার বিষয়। যেটা হচ্ছে, সেটা নির্বাচন নির্বাচন খেলা। এটা সমস্যার সমাধান করবে না, বরং সংকট আরও প্রকট করবে। আর বিদ্যমান সংকটের সমাধান চাইলে তা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে। আর এর উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। এ জন্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতাদের মুক্তি দিতে হবে।’

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2