জালাল উদ্দিন আহমেদ
ধর্মীয় গলিপথে ভারত রাষ্ট্র-দুই
প্রকাশ: ০৮:৪০ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২০ | আপডেট: ০৯:৩৩ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
( হিন্দু মুসলিম দুটি বৃহত্তর ধর্মীয় গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত হয় হিন্দু জাতিগোষ্ঠীর ভারত রাষ্ট্র। ধর্মীয় গতিধারায় চালিত হিন্দু জাতিগোষ্ঠীর ভারত রাষ্ট্রর পথচলা নিয়ে আমার এই প্রয়াস)
মুসলমানদের শৌর্যবীর্য ও ইসলাম ধর্মীয় শান্তির পতাকাতলে ভারতবর্ষ সর্বোচ্চ সম্মানের একটি সর্ব ধর্মের রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলমান শাসকদের ইসলামী শিক্ষার আলোক ছটায় পারস্পারিক সহাবস্থান ও দেশ মাতৃকার সেবায় স্ব স্ব অবস্থানে থেকে তারা ভারতকে এক শান্তির দেশ হিসাবে সমুন্নত করে। মোটকথা মোঘল পাঠান বা মুসলিম শাসনের পতাকাতলে ভারতবর্ষ এক শক্তিশালী সর্ব ধর্ম রাষ্ট্রের আদলে পৃথিবীতে সেক্যুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মডেল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। মুসলিম শাসনের বার'শ থেকে সতের'শ এই পাঁচ শতাব্দীর মধ্যে ভারত রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও উৎকর্ষতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। কিন্তু পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের পুজারী হিন্দু সভাসদ ও রাজন্য আমত্যদের জাগতিক ভোগবিলাস ও কাম প্রেমের অবগাহনের হাতছানিতে মুসলমান শাসকেরাও ততদিনে ভোগবিলাসী চক্রে প'ড়ে একটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তি হিসাবে ক্ষমতার তলানীতে চলে আসে। গৃহ বিবাদের বিচরন মোঘল সাম্রাজ্যে এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করে। পাশাপাশি প্রেম ও কামোদ্দীপনার বহুবিধ উপাদান তাদেরকে সর্ব ভারতীয় প্রেক্ষাপটে একটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত করে। তাদের সেইসব কাজের প্রতিফলন তো আমরা দেখেছি শাহজাহানের তাজমহল বা মোঘল বাদশাদের হেরেমের চটকদার সব খবরা খবরে। হিন্দু বনেদী রাজা মহারাজারা তো এসবের অপেক্ষাতেই দিন গুনছিলেন যে কিভাবে এই সাম্রাজ্য হিন্দু রাষ্ট্রের কাঠামোয় দিল্লীময় করা যায়। হয়েছিলও তাই। বৃটিশ বেনিয়ারা বাণিজ্যে বসতি নিয়ে কিভাবে এই বাংলার মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল তা আমরা কমবেশী সবাই জানি। এটা ছিল উঁচুতলার অতি সুযোগ পাওয়া হিন্দু আধিকারিকদের বিশেষ এক কৌশল যাদের কৌশলের সুযোগ সৃষ্টিতে বৃটিশরা মুসলমান শাসক শ্রেণীকে ক্ষমতাহীন করে এদেশে কোম্পানী আইনের মাধ্যমে সরাসরি বৃটিশ রাজের করতলে নিয়ে নেয়।
ধর্ম তত্ত্বের ঠিকাদার উঁচুশ্রেণীর হিন্দু বাবুরা ধর্ম তত্ত্বের কৌশলগত জায়গায় থেকে পরবর্তী দু'শ বছরের বৃটিশ শাসনে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোয় নিজেদের শিকড়কে শক্ত গাঁথুনির মধ্যে প্রোথিত করে। ওদিকে মুসলিমরা তাদের ধর্মের শিক্ষা ও নিজস্ব স্বকীয়তায় বৃটিশ রাজের বিরোধী শক্তি হয়ে আজাদির লড়াইয়ে নিজেদেরকে ব্যপৃত করে। ভারতবর্ষকে বৃটিশ রাজ থেকে মুক্ত করার মানসে তারা প্রকাশ্যে সিপাহী বিদ্রোহ করে। ফলে পাঁচ - ছ'শ বছরের ভারত বিনির্মানের কারিগর ও বৃহত্তর ভারতের শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সম্প্রদায় বৃটিশদের কাছে শত্রু বলে ঘোষিত হয়। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন বিগত কয়েক'শ বছরে ক্ষমতার বাইরে থাকা আর্য ব্রাহ্মন্য শাসকের একটি দল। যে ভারতকে এক সুতোয় বেঁধে হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত শক্তির এক সুখী সমৃদ্ধ রাষ্ট্র তৈরী করে ভারতকে সুমহান করেছিল মুসলমান শাসকেরা সেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে বরাবরই তারা ঈর্ষান্বিত ছিলেন। এবং এই সুযোগটা নিয়ে হিন্দু মাথাওয়ালারা তাদের ভবিষ্যত হিন্দুস্থান রাষ্ট্রের স্বপ্ন বিনির্মানের খায়েশে বৃটিশদের সাথে সখ্যতা বাড়িয়ে নেয়ার সু্যোগ করে নেয়। আগেই বলেছি হিন্দু ধর্মের সাজুয্যে বস্তুবাদী ও ভোগবাদী প্রেম-কামের সঙ্গে তাদের সমাজ কাঠামো গড়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে তারা তাদের সেই সামাজিক চলনের স্বাভাবিক নিয়মে প্রেম-কাম ও মনোরঞ্জনের বিষয়টি সামনে রেখে শাসক শ্রেনীর গুডবুকে ভালভাবে নাম লেখাতে সক্ষম হন।
ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম শাসনের সময়কালে ওৎ পেতে থাকা হিন্দু ব্রাহ্মন্যবাদীদের সুযোগের লাটাই নতুন উদ্যমে ঘুরতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষে তখন থেকে ধর্মীয় বিভাজনের একটি সুক্ষরেখা তৈরী হওয়ার সুযোগ পায়। কারন ততদিনে ভারতে মুসলমান একটি বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসাবে দাঁড়িয়ে যায় এবং ভারত রাষ্ট্রের স্টেক হোল্ডার হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। যদিও মুসলিম শাসনের শিক্ষা, মাহাত্ম ও সহমর্মিতার আলোকে বৃহত্তর ভারতবাসী তখনও এক সুতোয় বাঁধা থেকে বৃটিশদের থেকে ভারতকে নিজস্ব স্বাধীন স্বত্ত্বায় নিয়ে আসার আন্দোলনে একাট্টা ছিল। কিন্তু কতিপয় ব্রাহ্মন্য আচরনের উটকো গন্ধ ছড়ানো জাতপাতের বিষয়গুলো সামনে এসে বার বার হিন্দু মুসলিম যুথবদ্ধতাকে আঘাত করেছে। ফলশ্রুতিতে একটা সময় মুসলমানেরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মানসে মুসলিম প্ল্যাটফরম গঠন করে নিজেদের চাহিদায় এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। লক্ষ্য করা গেছে হিন্দুরা তাদের নেতা কর্তাদের নির্দেশে নিজেদের ধর্ম আচরনের আলোকে একের পর এক বিভিন্ন সংগঠন তৈরী করে তাদের ধর্মীয় উঠানকে শক্ত করার প্রয়াসে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুসলমানরা সেসময় নিজেদের নামে কোন সংগঠন বা প্ল্যাটফরম করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে গেলেই হিন্দু বনেদি বুদ্ধিজীবি মাথাওলারা গেল গেল রব তুলে তা থামিয়ে দেয়ার চতুরতায় সফলকাম হচ্ছে। ভারতীয় আদলে একটি কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমের দামামায় সবাইকে মশগুল রেখে ভিতরে ভিতরে ধর্মীয় আচার-আচরনে নিজেদের শক্তি সঞ্চয় ও বৃদ্ধি করার কৌশলেই হিন্দুরা এভাবে এগোতে চেয়েছিল। সম্ভবতঃ এভাবেই ভারতে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদের লক্ষন রেখাটি আত্মপ্রকাশ করেছিল। ভাবখানা যেন এরকম – তোমরা বহিরাগত, যুদ্ধ করা তোমাদের কাজ, তোমাদের আবার সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের অনুশীলনের এত দরকার কিসের!! হয়েছিলও তাই। বৃটিশ শাসনের এই দু'শ বছরে ভারত স্বাধীন করার মুক্তিযুদ্ধে বৃটিশদের হাতে প্রান দেয়া মোট মুক্তিযোদ্ধার শতকরা আশি জনই ছিলেন মুসলিম। দিল্লি গেটের পাশে ভারতের আযাদী শহীদদের যে তালিকা টাঙ্গানো আছে সেখানেই পাওয়া যায় সেই চিত্র।
বৃহত্তর ভারত হিন্দু-মুসলিম অংশীদারিত্বে বিশাল এক দেশ। বৃটিশ শাসনের অধীনে দেশ চলছে। ভারত স্বাধীন করার আন্দোলনে হিন্দু মুসলমানের যুথবদ্ধ আন্দোলনে তখন উত্তাল দেশ। তবে বৃহত্তর এই আয়োজনের ভিতরেই ফুটে উঠছে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের স্পষ্ট রেখাগুলি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থাকা গান্ধীর আশীর্বাদ নিয়েই ভারত আন্দোলন হিন্দু মুসলিম যৌথ নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু আগেই বলেছি হিন্দুত্ববাদের মাথাওয়ালা শিরোমনিরা বরাবরই তাদের মত করে অতি সুকৌশলে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছে। সামনে রেখেছে ভারতীয় আঙ্গিকের বৃহত্তর জনগোষ্টির অর্থাৎ নিচু সম্প্রদায়ের রামভক্ত মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীকে এবং রাজনীতির নেতৃত্বে রাখা হয়েছে মোটাবুদ্ধির মুসলমানদের। আর ব্রাহ্মন্যবাদী চক্রের হিন্দু মাথাওয়ালারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থের জন্য নেতৃত্বের সামনে থেকেও নিজেদের মাঠ গুছানোর কাজে আপন সম্প্রদায়কে জাগ্রত করে নিজস্ব প্ল্যাটফরম তৈরীতে ব্যস্ত থেকেছে। এবং এই কাজ বা গতিধারা একটি সুনির্দিষ্ট মটো নিয়েই এগিয়েছে যে, মুসলমানেরা স্রেফ বহিরাগত। এটা হিন্দুদের দেশ। এ হিন্দুস্থান শুধুই হিন্দুদের। কিন্তু ততদিনে জল অনেকদুর গড়িয়েছে। তেত্রিশ কোটির ভারতে এক তৃতীয়াংশই তখন মুসলমান জনগোষ্টি। ফলে ভারতকে বৃটিশ মুক্ত করতে গিয়ে এরই মধ্যে হিন্দু মুসলমান বিভেদ রেখাটি স্পষ্টতর হয়ে সামনে চলে আসে। এরই মধ্যে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই চিন্তাধারা ও কর্ম চাঞ্চল্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উভয় সম্প্রদায়ের কয়েক লাখ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়। এদিকে ভারত স্বাধীন করার আন্দোলনের অন্তিম লগ্নে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু নেতৃত্ব সামনে চলে আসে যদিও লোক দেখানো সুত্রে তারা অতি সুকৌশলে এক বামপন্থী সেক্যুলার ব্যারিস্টারকে সামনে রাখে। ওদিকে মুসলমানদের আলাদা নেতৃত্বে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে বৃহত্তর ভারত ভেঙ্গে তিন টুকরো করে জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্থান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রর জন্ম হয়। যদিও বৃহত্তর আদলে মুসলিম জনসংখ্যার একটি বড় অংশ গোটা ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে যায়। ফলে ভারত ভাগ হলেও মুসলমানদের একটি বড় সংখ্যা ভারতের মূল কাঠামোতেই রয়ে গেল। এর ফলশ্রুতিতে দেখা যায় বাঙালী অধ্যুষিত পুর্ব পাকিস্থানে হিন্দু মুসলিম সবস্থান থাকলেও শুধুমাত্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার আঁচড়ে এখানে হিন্দু বাঙালীরা গনহারে নিগৃহীত হলো। পাশাপাশি ভারত কাঠামোয় গোটা ভারতে ছড়িয়ে থাকা মুসলমানেরাও গনহারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিদ্ধস্ত হলো। এভাবেই সাম্প্রদায়িক বিভাজনে ভারতীয় উপমহাদেশ ধর্ম বিদ্বেষী বিষবাষ্পে তার পথ চলা শুরু করে যার রেশ অনন্তকালের যাত্রায় বহমান এক ভিস্যুভিয়াস ছাড়া আর কিই বা বলা যায়! (ক্রমশঃ)