avertisements 2

মাঝ রাতের দরজায় কড়া নাড়ে মানবতার ‘ফেরিওয়ালা’ 

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২২ জানুয়ারী,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৩:১৩ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪

Text

মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে গ্রামের দরিদ্র মানুষদের মধ্যে শীত কাপড় ও কম্বল বিতরণ করেন মোস্তফা

সময় তখন রাতের ১২টা। তীব্র শীতের নিস্তব্ধ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে প্রায় পুরো গ্রাম। এমন সময়ে হঠাৎ দরজায় কড়া নেড়ে ডাক। শব্দে মাঝরাতের ঘুম ভেঙ্গে যায় আব্দুল জলিলের। দরজা খুললে দেখতে পান হাতে কিছু শীতের কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অচেনা এক যুবক। বিক্রেতার ভঙ্গিতে কাপড় পছন্দ করতে বলেন জলিলকে। 

মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কাপড় বিক্রির বিষয়টিতে বেশ বিরক্ত হন জলিল। তবুও এক নজর নেড়েচেড়ে দেখলেন কিছু কাপড়। কিছুদিন থেকেই শীতের কাপড় কিনতে টাকা জমাচ্ছিলেন তিনি। তবে টাকা না থাকায় গাম্ভীর্য সুরেই বললেন, না আমার কোনো কাপড় লাগবে না।

মাঝরাতে কড়া নাড়ায় এলাকায় নতুন আশা জলিলের পরিবার আতঙ্কিত হলেও শীত মৌসুমে এমন শব্দ পেয়ে এই গ্রামের নিম্ন আয়ের ছিন্নমূল পরিবার আনন্দ ও উৎসাহ নিয়েই দরজা খোলেন। শীত এলে অনেকে প্রতীক্ষায় থাকেন, এবারও রাতের বেলা শীতবস্ত্র দিয়ে যাবেন ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ মোস্তফা। 

সেদিন জলিলের পরিবারের তিন সদস্যই পেয়েছিলেন একটি করে শীত নিবারণের মোটা পোশাক ও একটি কম্বল। কিছু কাপড় থেকে পছন্দের কাপড়টা বেছে নেওয়ার সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি। জীবনে প্রথমবার এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে বেশ অবাক হন জলিল। পরবর্তীতে জলিলের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারে রাইজিংবিডি।

কনকনে শীতের মধ্যেই মাঝরাতে মোস্তফার খোঁজে বের হয় জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ প্রোটাল রাইজিংবিডি. কমের প্রতিনিধি। মোস্তফার সঙ্গে এ প্রতিনিধির দেখা হয় গ্রামের এক সরু পথেই। সে সময় শীতার্থদের খোঁজেই বের হয়েছিলেন মোস্তফা। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাতের ফেরিওয়ালা খ্যাত যুবক মোস্তফার বাসা ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের কচুবাড়ি গ্রামে। সারা বছর জমানো টাকায় শীতের রাতে নিজ গ্রাম ঘুরে ঘুরে শীতার্থদের বাসায় শীতবস্ত্র পৌঁছানো এখন তার নেশায় পরিণত হয়েছে। নিজেও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও মানবতার অন্যান্য নিদর্শন রেখে যাচ্ছেন ৩৩ বছর বয়সী এই যুবক।

গ্রামের কিছু বন্ধুদের নিয়ে প্রায় ৭ বছর আগে এই মানবিক কাজ শুরু করেন মোস্তফা। তবে তিন বছর পরেই একা হয়ে পরেন তিনি। কিন্তু সাহস হারাননি মোস্তফা। অন্যেরা ছেড়ে গেলেও একাই গ্রামের শীতার্থদের দরজায় কড়া নাড়ছেন এই মানবিক ফেরিওয়ালা।

নিজের সাড়ে ৩ বিঘা জমির সঙ্গে কিছু বর্গা জমিতে আবাদ করেই জীবন চলে মোস্তফার। পরিবারের প্রয়োজন মিটিয়ে সারা বছর জমানো টাকা দিয়েই শীত নিবারণের জ্যাকেট ও কম্বল বিতরণ করে যাচ্ছেন তিনি। 

শীতবস্ত্র বিতরণের কারণ জানতে চাইলে মোস্তফা বলেন, “সাত বছর আগে এলাকার স্কুল মাঠে কম্বল বিতরণ হচ্ছিলো। কম্বল হাতে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন এক ৬৫ বছর বয়সী প্রবীণ। চোখে পানি দেখে ওই প্রবীণের কাছে কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশীর কাছে জানতে পেরে পাশের স্কুল মাঠে কম্বল নিতে যায়। সেখানে অনেক মানুষ কম্বল নিতে গিয়েছিলো। কিন্তু কম্বল পেতে প্রায় ৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। কম্বলের স্লিপ নেওয়া, সবার উপস্থিতি, অতিথিদের জন্যে অপেক্ষা ও অতিথিদের বক্তব্য শেষ করেই কম্বল দেওয়া শুরু হয়। কম্বল নিতে গিয়ে কাজে যেতে পারিনি। তাই পরিবারের জন্যে বাজার করার টাকাও আর হাতে ছিল না।’

মোস্তফা বলেন, ‘সেদিন বন্ধুরা সবাই মিলে বাজার করে দেই ওই প্রবীণকে। এরপর তার বাসার সবার জন্যেই কিনে দেই শীতের মোটা কাপড়। তারপর থেকেই বন্ধুরা পরিকল্পনা করে জমানো টাকা দিয়ে গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করি। কিন্তু আস্তে আস্তে সবাই চলে গেছে। তাই এখন একাই চেষ্টা করছি।’ 

মোস্তফা বলেন, ‘আমি মনেকরি যারা সত্যিকারে অভাবী তাদের শীতবস্ত্র বিতরণের আয়োজনে গিয়ে কম্বল সংগ্রহ করা সম্ভব না। কারণ, এতে করে তাদের দিনমজুরি হারাতে হয়। আমার গ্রামের এমন অনেক দরিদ্র পরিবার আছে যারা পুরো মৌসম শীতবস্ত্রের অভাবে কষ্ট করে। তাই আমি সারা বছর আমার উপার্জন থেকে কিছু টাকা জমিয়ে শীতের সময় শীত কাপড় কিনি। পরে সেই কাপড় যাদের প্রয়োজন তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি।’

মাঝরাতে শীতবস্ত্র বিতরণের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দিনের সময় শীতবস্ত্র দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। দিনে দিতে গেলে অনেকেই আমার কাছে চাইতে আসবে। তখন তাদের দিতে গিয়ে দেখাযাবে প্রকৃতরা পায়নি। আমার সামর্থ্য কম, সংগ্রহ সীমিত। আমি প্রথমে গ্রামের প্রকৃত অভাব গ্রস্তদের চিহ্নিত করি। পরে রাতের আধারে চুপিচুপি দিয়ে আসি। আমার সামর্থ্য থাকলে এই অঞ্চলের সবার দরজায় গিয়ে দাঁড়াতাম।‘ 

মোস্তফার এমন মহৎ উদ্যোগের প্রশংসা করে ঠাকুরগাঁও নাগরিক সমাজের সভাপতি আবু মহিউদ্দীন বলেন, ‘বর্তমান সময়ে এমন মানুষ মানবতার উদাহরণ স্বরূপ। তার এমন চিন্তাভাবনাকে সাধুবাদ জানাই। দেড়শ টাকার কম্বল বিতরণে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এক্ষেত্রে দিনমজুর শ্রেণির মানুষেদের পক্ষে শীত নিবারনের কাপড় সংগ্রহ করাটা অবশ্যই কষ্টকর।’

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2