সুইডেনে শরৎ এসেছে, আসেনি চিতই পিঠা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪:৩৭ পিএম, ২০ অক্টোবর,মঙ্গলবার,২০২০ | আপডেট: ০১:৫৮ এএম, ২৫ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
ঋতু হচ্ছে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ভূ-পৃষ্ঠের কোনো একটি স্থানের জলবায়ুর ধরন। মহাকাশে সূর্যের অবস্থানের সাপেক্ষে পৃথিবীর অক্ষের অবস্থানের পরিবর্তনের কারণে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঋতু পরিবর্তন হয়।
মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এদেশে ঋতুর আবির্ভাব ঘটে এবং সেগুলি পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে বছরকে ছয়টি ঋতুতে বিভক্ত করা হয়েছে যথা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। এজন্যই বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত ও শীত- এই চারটি ঋতু রয়েছে। সুইডেন তার মধ্যে একটি। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বর মাস মিলে যে ঋতুটি তাকে সুইডেনে বলা হয় হোস্ত (höst)। বাংলাদেশের শরৎ এবং হেমন্তের সমন্বয়ে সুইডিশ হোস্ত ঋতুটি।
বাংলাদেশের মতো শরৎকালে সুইডেনেও নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়। তবে ওখানে শরতের ভোরে ঘাসের ডগায় শিশির দেখা যায় আর দেখা যায় কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। শরতের শেষে রোদের তেজ আস্তে আস্তে কমতে থাকে, ঠিক তখনই হেমন্তের আবির্ভাব হয়।
মূলত হেমন্তকাল হচ্ছে শরতের শেষ এবং শীতের শুরু। দিনের শেষে তাপমাত্রার ব্যাপক পতনের ফলে বিকেলে হালকা তুষার পড়তে শুরু করে আর ঘাসের ওপর জমে থাকে সেই সঙ্গে কুয়াশা। এ সময় গাছের পাতা রং বদলায় এবং পরে ঝরে পড়ে।
সুইডিশ আবহাওয়াবিদদের মতে, তাপমাত্রা কমপক্ষে দশ ডিগ্রির নিচে একটানা পাঁচ দিন থাকতে হবে। তবেই চমৎকার সুইডিশ হোস্ত ঋতুর স্বাদ পাওয়া যাবে, যা এখন লক্ষণীয়।
আমি সুইডেনের শরৎ এবং হেমন্তের সময়টুকুকেই বাংলাদেশের শীতকাল হিসেবে উপভোগ করে আসছি। কারণ ছোটবেলায় বাংলাদেশে যখন শীতকাল ছিল তখন আমি সকালে ঘাসের ডগায় যেমন শিশির জমে থাকতে দেখেছি তেমনি দেখেছি কুয়াশাও।
কয়েকদিন ধরে সুইডেনের শরতের সময়টুকু আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে ছোটবেলার দিনগুলো। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে পৌষ ও মাঘ (মধ্য ডিসেম্বর থেকে থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) এ দুই মাসের কথা বেশি মনে পড়ছে।
এর পেছনে যে কারণটি জড়িত তা হলো খেজুরের রস এবং পৌষ মাসের পিঠা। মনে পড়ে যায় ছোটবেলার স্মৃতি, যখন খুব সকালে উঠে রস আনতে গিয়েছি। পৌষ মাসের পিঠা তৈরির ধুম পড়ত প্রতিটি বাড়িতে যা আজও মনের মধ্যে গাঁথা রয়েছে।
অনেক সময় দেখা গেছে কুয়াশার কারণে খেজুরের রস ঘোলাটে হয়েছে। ঘোলা হবার কারণে সেই রস দিয়ে পিঠা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। রসের রং ঘোলাটে হবার কারণে খেতেও কেমন মজা লাগত না, বিরক্তিকর টক টক স্বাদ।
যখন আকাশ পরিষ্কার থেকেছে, শীতও পড়েছে প্রচণ্ড, তখন ভোরে গাছি যখন রস পেড়েছে সে রস দেখতে পরিষ্কার পানির মত মনে হতো। সে রস যে কী অমৃত এবং সুস্বাদু ছিল ভাবতেই জিভ দিয়ে পানি পড়ে আজও।
বলবো চিতই পিঠা সম্পর্কে। খেজুরের রসের মধ্যে পরিমাণ মতো তেজপাতা, দারচিনি ও এলাচ দিয়ে সেটি ভালো করে জ্বালানো হতো। অতঃপর তার সঙ্গে জ্বাল দেওয়া দুধ মিশিয়ে আবারো কিছুটা জ্বাল দিয়ে উত্তম মিশ্রণ তৈরি করা হতো। আতপ চাল ঢেঁকিতে গুঁড়ো করে সেই চালের গুঁড়ো দিয়ে গোলা বানিয়ে মাটির ছাঁচের সাহায্যে তৈরি করা হত পিঠা।
যাকে আমাদের এলাকায় বলা হয় চিতই পিঠা। গরম গরম চিতই পিঠা তৈরি করেই তা ছেড়ে দেয়া হত পূর্বে তৈরি করা রস-দুধের মিশ্রণের মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পিঠাগুলো তাদের সাধ্যমতো রস নিজের বুকের মধ্যে শুষে নিয়ে টইটুম্বুর হয়ে যেত।
ব্যাস তৈরি হয়ে যেত চিতই পিঠা, যাকে আমরা ভিজানো পিঠাও বলতাম। আহ! সে কী মজা!! রাতে গরম রসে ভিজা পিঠা, ভোরে ঠাণ্ডা হওয়া ভিজা পিঠা। দুটোর স্বাদ দুই রকম, মজাও দুই রকম। এ ছিল সেই ছোটবেলার মধুময় স্মৃতি।
জানি না এমনটি অনুভূতি কি আজও আছে গ্রাম বাংলায়? এখনও কি সকাল হলে নির্ভেজাল খেজুরের রস, খাঁটি গরুর দুধ এবং আতপচালের ভেজালমুক্ত চালের গুঁড়া পাওয়া যায়? বড় সাধ জাগে একবার ফিরে যাই সেই বাংলার কোলে যেখানে কেটেছে আমার মধুময় শিশুকাল।
শরৎ প্রতিবছরই সুইডেনে ফিরে আসে তবে শীতের সেই দুধ চিতই পিঠা ফিরে আসেনি একবারও। ছোটবেলার অনেক স্মৃতিই মাঝে মধ্যে হৃদয়ের মাঝে এসে বেশ জ্বালা দিয়ে যায়।
মাকে পাবো না। খেজুর রস, সেই দুধ চিতই পিঠা তাও হয়তো পাবো না। হে বাংলাদেশ, হয়তো কিছুই নাহি পাবো তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাব।