সরকারি কর্মকর্তা ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদদের অপকর্মে ব্যবহার হয় দ্য ওয়েস্টিনের ২৬ কক্ষ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ সেপ্টেম্বর,
বুধবার,২০২৪ | আপডেট: ০১:২৮ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
ছবি: দ্য ওয়েস্টিন
রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত ‘দ্য ওয়েস্টিন’ হোটেল। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে, পাঁচ তারকা এ হোটেলের অন্তত ২৬টি কক্ষ ব্যবহার করে সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরা চালিয়েছেন নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। আর এসব কর্মকাণ্ডে তারা সামনে রাখতেন এক সময়ের যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়াকে।
স্বামী মফিজুর রহমান সুমনসহ পাপিয়াকে গ্রেফতারের পর একাধিক মামলার এজাহার ও আদালতে দেয়া অভিযোগপত্রে ওয়েস্টিন হোটেলে সংঘটিত এসব অপরাধের তথ্য উঠে আসে। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, হোটেল কর্তৃপক্ষের সরাসরি সহযোগিতা ছাড়া দিনের পর দিন এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সম্ভব নয়। তবে হোটেল কর্তৃপক্ষের দাবি, এ ধরনের অপরাধে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত পাপিয়ার ‘অতিথি’ হয়ে ওয়েস্টিন হোটেলে আসতেন সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকরা। তারা এ হোটেলে বসে মাদক বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাণিজ্যসহ নানা ধরনের অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতেন।
এক মামলার অভিযোগপত্রে সিআইডি বলেছে, পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন ২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাস ওয়েস্টিনে অবস্থান করেন। এর মধ্যে একবার তারা সেখানে ঢাকা সিকিউরিটি সার্ভিসেসের স্বত্বাধিকারী টোকন মিয়া এবং তার দুই সহযোগী স্বপন মিয়া ও আইয়ুব আলীকে আটকে রাখেন। এরপর আপত্তিকর ছবি তুলে ভয়ভীতি দেখিয়ে আদায় করেন অর্থ।
অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, ওই চার মাসে দ্য ওয়েস্টিন হোটেলের ২৬টি কক্ষ ব্যবহার করেন পাপিয়া। এজন্য ৩ কোটি ২৩ লাখ ২৪ হাজার ৭৬১ টাকা তিনি শুধু হোটেল ভাড়াই দেন।
মামলায় আসামির তালিকায় ওয়েস্টিনের বার ম্যানেজার মো. বশিরের নামও ছিল। তবে অভিযোগপত্র থেকে তার নাম বাদ যায়। এতে বিস্ময় প্রকাশ করেন মামলার বাদী সিআইডির পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মো. বশির সে সময় পাপিয়া ও তার সহযোগীদের বাড়তি সুবিধা দেন। পাপিয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি অতিথিদের পানীয় সরবরাহ করতেন। পাশাপাশি অতিথিদের আপত্তিকর ভিডিও ধারণ ও ছবি তুলতেন। বিনিময়ে পাপিয়ার অপরাধলব্ধ আয়ের একটা অংশ তিনিও পেতেন।’
মনিরুজ্জামান আরো বলেন, ‘অনুসন্ধান পর্যায়ে অন্য আসামিরা সিআইডিতে হাজির হয়ে তথ্য দিলেও বশির একবারও আসেননি। বিশেষ প্রভাব খাটিয়ে অভিযোগপত্র থেকে তার নাম বাদ দিতে বাধ্য করা হয়েছে।’
দ্য ওয়েস্টিনের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটসহ অন্তত ২৬টি কক্ষ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে থাকত বলে জানান তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বণিক বার্তাকে জানান, ওই হোটেলে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অনেক কর্মকর্তার। তাদের সঙ্গে মতের মিল না হলেই তুলে নিয়ে হোটেলের কক্ষগুলোয় আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হতো। এছাড়া ব্যবসায়ীদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করা কিংবা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখলের পরিকল্পনায় এসব কক্ষ ব্যবহার হতো। ঢাকাসহ সারা দেশের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাণিজ্যের টাকা আসত ওয়েস্টিনের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে। পরে সেই টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হতো আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীদের মধ্যে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাপিয়াকাণ্ডে ওয়েস্টিনের কর্মীসহ ছয়জনকে আসামি করে ২০২০ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করে সিআইডি। দুই বছরের তদন্ত শেষে ২০২২ সালে ওই মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়।’
গুলশানে ২০০৭ সালের ১ জুলাই বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা শুরু করে দ্য ওয়েস্টিন ঢাকা। ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের কোম্পানি ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস পিএলসির মাধ্যমে এটি পরিচালিত হয়। সিআইডির অভিযোগপত্রে আসা বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের হোটেলে গেস্ট চেকইন করলেই সেটা এটিআই সফটওয়্যারে নিবন্ধন করা হয়। এ সফটওয়্যারের সঙ্গে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) যুক্ত থাকে। পাশাপাশি আমাদের এ হোটেলটি পরিচালনা করা হয় ম্যারিয়েট ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে। ফলে এখানে কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়া বা হোটেল কর্তৃপক্ষের যুক্ত থাকার কোনো সুযোগ নেই।’