avertisements 2

জোরদার নিরাপত্তায় থমথমে ঢাকা

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৭ অক্টোবর,শুক্রবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:০৯ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪

Text

২৮ অক্টোবর একইদিনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও জামায়াতের কর্মসূচিকে ঘিরে যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়াতে রাজধানীতে র‌্যাব-পুলিশ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। বাড়ানো হয়েছে পথঘাট, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ভিআইপি জোনের নিরাপত্তা। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার ও আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে শুরু করা হয়েছে কঠোর তল্লাশি অভিযান। ঢাকা মহানগরীর পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে চলছে ফুট ও কার পেট্রোলিংয়ের পাশাপাশি সর্বোচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা নজরদারি। আন্দোলনের নামে যে কোনো ধরনের নাশকতার ছক রুখে দিতে সন্দেহভাজন পলিটিক্যাল ক্যাডার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে ঢাকার পাশাপাশি উপকণ্ঠ এলাকা চলছে ‘কম্বিং অপারেশন’।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এসব তৎপরতায় সকাল থেকেই থমথমে ঢাকা। স্বাভাবিক সময়ে সাপ্তাহিক কর্মদিবসের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বিকালের পিক-আওয়ারে যানবাহনের চাপে নগরজুড়ে যানজট সৃষ্টি হলেও গোটা রাজধানীতে এবার সে দৃশ্য উধাও। সকাল থেকে নগরীর বেশিরভাগ ব্যস্ততম সড়কে যানবাহন চলাচল ছিল কম। বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের কমতি ভীষণভাবে চোখে পড়েছে।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর বারিধারা, বিশ্বরোড, বিমানবন্দর, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, গুলশান, কাওরান বাজার, ফার্মগেট, মালিবাগ, বাড্ডা ও বনানীসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্য দিনের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। মার্কেট, শপিং মল বিপণি বিতানগুলোও ছিল অনেকটাই ফাঁকা। স্বাভাবিক সময়ে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ও সায়েদাবাদ-মহাখালী-গাবতলী বাসস্ট্যান্ডসহ আন্তঃজেলা বিভিন্ন পরিবহণের কাউন্টারে ঢাকার বাইরে যাওয়া যাত্রীদের ভিড় থাকলেও গতকাল সে চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। বেশিরভাগ গণপরিবহণ এক তৃতীয়াংশ কিংবা তারও কম যাত্রী নিয়ে ঢাকা ছেড়েছে। এছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে আসা যাত্রী সংখ্যাও ছিল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কিছুটা কম।

কম যাত্রী আসা-যাওয়ার কারণ জানতে সোহাগ, শ্যামলী ও হানিফ পরিবহণসহ বেশ কয়েকটি বাসের চালকদের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। মোজাম্মেল হোসেন নামে শ্যামলী বাসের এক চালক জানান, সকাল থেকে ঢাকার প্রবেশমুখে বাসে তল্লাশি করছে র‌্যাব ও পুলিশ। তাই যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এজন্য লোকজন ঢাকায় আসছে কম। এছাড়া ঢাকার কর্মজীবী বেশকিছু মানুষ বৃহস্পতিবার বিকালের পর গ্রামের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে শনিবার কর্মস্থলে ফিরে আসলেও এবার তাদের অনেকেই এ যাত্রা স্থগিত করেছেন। কেননা অনেকের আশঙ্কা, আগামী শনিবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে জামায়াত ইসলামী ঢাকায় সমাবেশ করার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভয়াবহ উত্তাপ ছড়াবে। গণপরিবহণে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার জোরালো আশঙ্কা রয়েছে। তাই ঢাকার বেশিরভাগ কর্মজীবী মানুষ এবার গ্রামে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চাননি।

মহাখালীতে এনা পরিবহণের চালক জালাল মিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও জামায়াতের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যদি জ্বালাও পোড়াও শুরু হয়, সেই ভয় যেমন যাত্রীদের মধ্যে রয়েছে, তেমনি তারাও তটস্থ। এছাড়া পথে পথে পুলিশ বাসে তল্লাশি করছে। বিশেষ করে ঢাকার প্রবেশমুখে বেশি তল্লাশি করা হচ্ছে। এ সময় পুলিশ বাসের মধ্যে ভিডিও করছে। এতে যাত্রীদের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

এদিকে ঢাকার রাস্তাঘাটে আকস্মিক বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গণপরিবহণ ও ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচল কমে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে নানা ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাইভেট কার মালিক-চালকরা জানান, অন্য যে কোনো দিনের তুলনায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গাড়ির কাগজপত্র যাচাই ও মামলা দেওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। এছাড়া ২৮ অক্টোবর ঘিরে যে কোনো সময় রাস্তাঘাটে নাশকতার ঘটনা ঘটতে পারে এ আশঙ্কা রয়েছে। তাই বেশিরভাগ প্রাইভেট কার মালিক রাস্তায় গাড়ি বের করার ঝুঁকি নিতে চাননি।

অন্যদিকে নগর পরিবহণের মালিক-চালকরা জানান, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে যাত্রী স্বল্পতার কারণে তারা ট্রিপ কমিয়ে দিয়েছেন। কোনো কোনো বাস মালিক তার অর্ধেকের কম গাড়ি রাস্তায় নামিয়েছেন। শুক্রবার ও শনিবার নগর পরিবহণের বাস চলাচল আরও অনেক বেশি কমতে পারে বলে জানান তারা। এর নেপথ্যে রাজনৈতিক কোনো চাপ আছে কিনা জানতে চাইলে বেশিরভাগ গণপরিবহণ মালিক তা নাকচ করেন।

রিকশা-অটো রিকশা, লেগুনা ও হিউম্যান হলারের চালক-শ্রমিকরা জানান, পথে পথে তল্লাশি অভিযান চলায় বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হতে দেননি। অনাকাক্সিক্ষত ঝামেলা এড়াতে কর্মজীবী মানুষ ছাড়া অন্যরাও খুব একটা বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। ফলে সব মিলিয়ে রাস্তাঘাটে যাত্রী সংখ্যা কম। থমথমে এ পরিস্থিতি রোববারের আগে কাটবে না বলে মনে করেন তারা।

ঢাকায় ২৮ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশকে সামনে রেখে রাজধানীর প্রবেশমুখ আমিনবাজারে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনে যাত্রীদের তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতালের সামনে চেকপোস্ট বসিয়ে এ তল্লাশি কার্যক্রম শুরু হয়।

দুপুরে আমিনবাজারে দেখা যায়, বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি রয়েছে। ঢাকাগামী বিভিন্ন যানবাহন থামিয়ে যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও ক্ষেত্র বিশেষে তাদের সঙ্গে থাকা ব্যাগপত্র তল্লাশি করছে পুলিশ। এ ক্ষেত্রে ঢাকাগামী দূরপাল্লার বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাস, গণপরিবহণ, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও মোটর সাইকেলের প্রতি পুলিশের বিশেষ নজর লক্ষ্য করা গেছে। আমিনবাজার চেকপোস্টে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শাহিদুল ইসলাম, সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক চন্দ্র সাহাসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সশরীরে উপস্থিত থেকে তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করেন।

সকাল থেকে সাভার হাইওয়ে থানার পাশে মহাসড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ পরিচালনা করতে দেখা যায় র‌্যাব ও ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের। ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শাহিদুল ইসলাম বলেন, ২৮ তারিখে যেহেতু রাজধানীতে দু’টি রাজনৈতিক দলের সমাবেশ রয়েছে, সেহেতু কেউ যেন ঢাকায় প্রবেশ করে কোনো নাশকতা কিংবা বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতেই পুলিশের এই চেকপোস্ট কার্যক্রম চলছে।

এদিকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের কর্মসূচিকে ঘিরে রাজধানীতে যাতে কোনো ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় এজন্য ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ধরপাকড় অভিযান শুরু হয়েছে। ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত এ অভিযান চলমান থাকবে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

তবে এ অভিযানে সব দলের চিহ্নিত নাশকতাকারী, অস্ত্রধারী ও বিভিন্ন মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত ক্যাডারদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে পুলিশ দাবি করলেও বিএনপি-জামায়াতের নেতারা ভিন্ন কথা বলছেন। তাদের অভিযোগ, ঢাকায় ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচিকে সামনে রেখে বিভিন্ন জেলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের ধরপাকড় করা হচ্ছে। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত ১২ জেলায় অন্তত ১৬০ নেতাকর্মীকে আটক ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া অনেক নেতাকর্মীর বাড়ি বাড়ি পুলিশি অভিযানের অভিযোগও করেছেন বিএনপির স্থানীয় নেতারা। এদিকে বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ২৭ নেতাকর্মীকে আটক করার খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন রয়েছেন। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য (দপ্তরে সংযুক্ত) মো. আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বিএনপির আটক নেতাকর্মীর সংখ্যার ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র ফারুক হোসেন বলেন, মহাসমাবেশকে সামনে রেখে বিএনপির নেতাকর্মীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না। বিএনপির যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে, শুধু তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। খায়রুল কবিরকে আটকের কথা নিশ্চিত করেন ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ। পুলিশ বলছে, নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই পুরনো মামলার আসামি গ্রেপ্তার চলছে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে বিএনপির পাশাপাশি অঙ্গসংগঠন ও জামায়াতের নেতাকর্মীরাও আছেন।

ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হবে জলকামান, সাঁজোয়া যান, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড। কোথাও নিরাপত্তার ঘাটতি দেখা দিলে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর ঢাকার প্রবেশপথ গাবতলী, উত্তরার আবদুল্লাহপুর, নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড, শ্যামপুরের পোস্তগোলা সেতু, পুরান ঢাকার বাবুবাজার সেতুসহ রাজধানীতে ১০ হাজারের বেশি পুলিশ মোতায়েন করা হবে। ওইদিন ডিএমপির দাঙ্গা দমন বিভাগ, থানা-পুলিশ ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) মূল দায়িত্বে থাকবে। এছাড়া ডিএমপির বিশেষায়িত দল সোয়াটের সঙ্গে বোমা উদ্ধার ও নিষ্ক্রিয়করণ দল প্রস্তুত থাকবে। মহাসমাবেশ সামনে রেখে এখন থেকেই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা নজরদারি করছে।

এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, পুলিশ মহাসমাবেশের আগে ঢাকার প্রবেশ পথগুলোতে নিরাপত্তা চৌকি বসিয়ে তল্লাশি চালাবে, যাতে সন্ত্রাসীরা অস্ত্র ও বিস্ফোরক নিয়ে ঢাকায় ঢুকতে না পারে। নগরবাসীর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2