মিরপুর থানায় ব্যতিক্রমী জিডি ‘আমি জীবিত’, তবু মৃত!
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৬ অক্টোবর,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ১২:০৭ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ফেসবুকের দেয়ালে আত্মহননের ঘোষণা দিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র ইশতিয়াক মাহমুদ পাঠান। ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারির ওই সুইসাইড নোটে লেখা ছিল, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। কেউ কথায় বা কাজে কিংবা অন্য কোনোভাবে আমাকে আত্মহননের জন্য প্ররোচিত করেনি। এটা আমার একান্ত সিদ্ধান্ত। শুধু আমিই এ কাজের জন্য দায়ী। কাউকে আমার মৃত্যুর পর দোষী বানাবেন না।’
সেই সময় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানের মর্মন্তুদ মৃত্যুর খবর ছাপা হয়, প্রচারিত হয়েছিল টেলিভিশনেও। তবে আড়ালের খবর হলো, বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টার পর মুমূর্ষু অবস্থায় ঘটনার দিন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন স্বজন। আট দিন হাসপাতালে থাকার পর প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
জীবন ফিরে পেলেও আত্মহত্যাচেষ্টার পরের দিনলিপি পাঠানের কাছে রীতিমতো দুঃসহ। পদে পদে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁকে। অনেকে বিশ্বাসও করতে পারছেন না, তিনি বেঁচে আছেন। নাগরিক সনদ নিতে গিয়েও নাজেহাল হতে হয়েছে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরত আসা মেধাবী এ যুবককে। নিরুপায় পাঠান শেষমেশ যান পুলিশের কাছে। অবিশ্বাসের চোখ নিয়ে যারা তাঁকে দেখছেন, তাদের কাছে পাঠান প্রমাণ করতে চান– ‘আমি জীবিত’। ‘দ্বিতীয় জীবনে’ মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়া রাবির এই প্রাক্তন ছাত্র শনিবার রাতে মিরপুর থানায় ব্যতিক্রমী এক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলেন।
সমাজ বাস্তবতার এক অন্ধকার দিক সামনে আনল এ জিডি। আত্মহত্যার পথ থেকে ভাগ্যক্রমে ফেরত আসা এক যুবককে তাঁর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ শক্তি-সাহস জোগানোর বদলে প্রশ্নবাণ ও সন্দেহের তীরে বিদ্ধ করছে। কেউ কেউ তাঁকে নিয়ে বিদ্রূপ করছেন। যন্ত্রণাদায়ক এক পরিস্থিতি থেকে নিস্তার চান পাঠান।
মনোবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ওই ব্যক্তি যাতে বুঝতে না পারেন, সমাজ তাঁকে আলাদাভাবে দেখছে। শনিবার রাতে মিরপুর থানায় বসে পাঠানের সঙ্গে কথা হয় সমকালের। আত্মহত্যাচেষ্টার অন্ধকার মুহূর্তের চেয়ে বেঁচে ফিরে আসার পর জীবনের কঠিন স্রোতের কাহিনি শোনালেন তিনি। পাঠান জানান, ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ২০১৩ সালে পাস করে বের হন। এর পর গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী চলে যান। ২০২২ সালে যশোরে একটি প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং অফিসার হিসেবে চাকরি হয় পাঠানের। ওই বছর একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে ৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। তবে টাকা নিয়ে ওই প্রতিষ্ঠান পালিয়ে যায়। এর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন পাঠান। হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহননের চেষ্টা করেন। পাঠান বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমার মৃত্যুর সংবাদ প্রচার হয়। তবে সুস্থ হয়ে ফেরার পর অনেকের বিশ্বাস করতে চাননি আমি বেঁচে আছি। পরিচিতজনের কেউ কেউ আবার এটাও বলতে শুরু করেন, বড় ধরনের কোনো অপরাধে জড়িয়ে মৃত্যুর নাটক সাজিয়ে নিজেকে আড়াল করছি। যে কোনো সময় দেশ থেকে পালিয়ে যাব। তিনি বলেন, সত্যি যদি আমি অপরাধী হই, আমার বিরুদ্ধে দেশের কোনো না কোনো থানায় তো মামলা-জিডি থাকবে।
পাঠান আরও বলেন, প্রাণে বেঁচে রয়েছি– এটা প্রমাণ করতেও কারও জীবনে এত বাধা আসতে পারে কল্পনায়ও ছিল না। বিদ্যুতের মিটার নেওয়ার জন্য পৌরসভা থেকে প্রত্যয়নপত্র নিতে হয়। সেটা যখন নিতে গেলাম তখন তারা বলল, আমি নাকি বেঁচে নেই। একই অবস্থা হয়েছে নাগরিক সনদপত্র আনার সময়। অনেকে বিব্রতকর সব প্রশ্ন করছেন। পাঠান বলেন, আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। আমি এটা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রেরণামূলক কাজে সারাজীবন থাকতে চাই। তবে তার আগে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে অনেক দূর যেতে হবে।
পাঠান বলেন, যখন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি, তখন আমার ফেসবুক আইডিতে অনেকে লিখেছেন– আমি মারা গেছি। পরে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আমার কাছে একটি মেসেজ পাঠান। তারা নিশ্চিত হতে চেয়েছিল আমি মৃত নাকি বেঁচে আছি। এরপর ফেসবুককে আমার জাতীয় পরিচয়পত্র স্ক্যানিং করে পাঠাই। তবে যে প্রক্রিয়ায় পাঠিয়েছি, সেটা সঠিক ছিল না। তাই ফেসবুক আমার আইডি ‘ডিসঅ্যাবল’ করে দেয়। গুগলেও আমার মৃত্যু সংবাদ-সংক্রান্ত অনেক নিউজ সার্চ করলে পাওয়া যায়। বিটিআরসিটির সঙ্গে নিজে যোগাযোগ করেছি এই সংবাদগুলো কীভাবে সরানো সম্ভব। কারণ, নাগরিক হিসেবে কোনো সেবা নিতে গেলেও এখন আমি জীবিত না মৃত– এ প্রশ্ন সামনে আনা হয়। কেউ গুগল সার্চ করে যখন দেখে একাধিক জায়গায় আমার মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয় তখন বলা হয়, ‘আমি সত্যি সত্যি পাঠান কিনা।’
থানায় জিডিতে পাঠান লেখেন, আত্মহত্যার পথ থেকে ফেরত আসার পরও কিছুদিন মানসিক ও সামাজিকভাবে খারাপ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যান তিনি। ওই সময় অনেকের পরামর্শ ও সহযোগিতা চান। তবে কেউ তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। পাঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরখানেক ধরে মিরপুর ‘পাঠান ট্রাভেল ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন তিনি। চারজন কর্মী নিয়ে এই ব্যবসা করছেন পাঠান। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে যারা ফেরত আসে, তাদের পাশে মানসিকভাবে সবার দাঁড়ানো প্রয়োজন। তাকে সুস্থভাবে বাঁচার মতো পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব সমাজের। মিরপুর থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, সমাজ বাস্তবতার কারণে এমন সমস্যার প্রতিকার চেয়ে কেউ থানায় জিডি করতে পারেন– এটা প্রায় অচিন্তনীয়। আমরা তাঁকে সব ধরনের সহযোগিতা করব।