পুরান ঢাকায় বারবার কেন আগুন লাগে
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৫ এপ্রিল,
বুধবার,২০২৩ | আপডেট: ০৩:০০ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
পুরান ঢাকাকে বারবার গ্রাস করছে সর্বনাশা আগুনের লেলিহান শিখা। নিমতলী ট্র্যাজেডি থেকে চুড়িহাট্টা– ৯ বছরের ব্যবধানে ভীতিজাগানিয়া এ দুই অগ্নিকাণ্ডেই প্রাণ গেছে অন্তত ১৯৫ জনের। এর আগে-পরে ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকায় ঘটেছে আরও অসংখ্য আগুনের ঘটনা। প্রতিবারই হতাহত হয়েছেন অনেক মানুষ। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুনে পুড়ল হাজার হাজার দোকান। ঘুরেফিরে যেন আগুনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে পুরান ঢাকা। বারবার প্রাণ ও সম্পদহানির পরও কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় এমন ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
যেমন ২০১৯ সালে বঙ্গবাজারকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পরও এই মার্কেটের কাউকে সরানো যায়নি। গতকাল এ তথ্য জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল এই ভবনটিকে আমরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছি এবং ব্যানার টাঙিয়েছি। এর পরে ১০ বার নোটিশ দিয়েছি। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে যা যা করা সম্ভব ছিল, আমরা করেছি। তার পরও এখানে ব্যবসা চলছে।
তবে গত পাঁচ বছরে সারাদেশে শপিং মল, মার্কেট ও হাটবাজারের দোকানে ১৭ হাজার দুটি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এতে পুড়ে গেছে ২৩৫ কোটি ৫৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯১৭ টাকার মালপত্র। এর মধ্যে গত তিন বছরের আগুনের ঘটনায় ২২ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১১৬ জন।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান সমকালকে বলেন, পুরান ঢাকা এমনিতেই ঘিঞ্জি এলাকা, তার ওপর কেউ কোনো নিয়মকানুন মেনে স্থাপনা নির্মাণ করেন না। তাছাড়া দাহ্য পদার্থের আধিক্যের কারণে এলাকাটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। আবার আগুন লাগলে নেভানোও কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না, সরু রাস্তার কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে পারে না। সমস্যা হলো, আমরা কেউ অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন নই। এ ক্ষেত্রে কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না।
ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা জানান, পুরান ঢাকার অগ্নিনিরাপত্তার জন্য উপযুক্ত স্থানগুলোয় হাইড্রান্ট স্থাপন করতে হবে। সব ভবনে রাখতে হবে পানির রিজার্ভার। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নিয়মিত পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে হবে। তবে মানুষ ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের কথা ততটা আমলে নেন না। এ জন্য ফায়ার সার্ভিসকে পুনর্গঠন করে জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় সর্বোচ্চ প্রাণহানি হওয়া তিনটি অগ্নিকাণ্ডের দুটিই ঘটে পুরান ঢাকায়। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে রাসায়নিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। এর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে ফের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে অন্তত ৭১ জন মারা যান। পুরান ঢাকায় বারবার আগুনের একটি বড় কারণ হচ্ছে– বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম। বহু আবাসিক ভবনের নিচতলায় এমন রাসায়নিকের মজুত আছে। প্রতিবার দুর্ঘটনার পর এগুলো সরানোর বিষয়ে আলোচনা জোরদার হলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠে না। এ ছাড়া অনেক বাড়ির নিচতলায় জুতা বা প্লাস্টিকসামগ্রী তৈরির কারখানা আছে। নিয়ম না মেনে চলা এসব কারখানায় প্রায়ই অগ্নিকাণ্ড ঘটছে।
এদিকে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের আধুনিক সুবিধাসংবলিত বহুতল শপিং মল থেকে শুরু করে সাধারণ টিনশেড বিপণি বিতানের অনেকগুলোই রয়েছে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিতে। এর মধ্যে কোনোটিতে এক বা একাধিকবার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, আবার কোনোটির অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় রয়েছে শঙ্কা। শক্তিশালী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার পরও পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে তিনবার আগুন লেগেছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ ২১ তলায় আগুন লেগে সাতজন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হন। এর পর ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মূল বিপণি বিতানের অষ্টম তলায় একটি খাবারের দোকানে আগুন লাগলেও বেশি ক্ষতি হয়নি। ২০১৬ সালের আগস্টে লাগা আগুনে বেশ কয়েকটি দোকান পুড়ে যায়, বিপুল ক্ষতি হয়।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, সারাদেশে গত বছর শপিং মল ও মার্কেটে ৫৮৯টি আগুনের ঘটনা ঘটে। একই সময়ে হাট-বাজারের দোকানপাটে ১ হাজার ৯৫ এবং মুদি দোকান-টংঘরে আরও ২ হাজার ১১৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এগুলোয় পুড়েছে ১৪৫ কোটি ৩৪ লাখ ৩৩ হাজার ৯৭০ টাকার মালপত্র। এর আগে ২০২১ সালে শপিং মল-মার্কেটে ৪৫৮, হাট-বাজারে ৭১০ ও মুদি দোকানে ১ হাজার ৬৭৪টি এবং ২০২০ সালে শপিং মল-মার্কেটে ৪২৮, হাট-বাজারে ৬৭২ ও মুদি দোকানে ১ হাজার ৮৮৪টি আগুনের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৫৭ ও ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৩২১টি অগ্নিকাণ্ড হয়।