হারিয়ে যাচ্ছে নদীর বাঁকে বেদেদের নৌকার সারি
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ অক্টোবর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:৩৮ এএম, ২৫ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
বেদেরা জাতিগতভাবেই যাযাবর। এক সময় এ গোষ্ঠিকে দেখা যেত খোলা আকাশের নিচে, গাছতলায়, অস্থায়ী ঝুপড়িতে, রেললাইনের ধারে অথবা নদীর বাঁকে নৌকায় বসবাস করতে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের আবাস ও জীবিকা নির্বাহে পরিবর্তন এসেছে।
কালের বিবর্তনের সাথে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও বাংলাদেশের কিছু কিছু জায়গায় এখনো গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে বসবাস করছে বেদেরা। আধুনিক সভ্যতার চরম উৎকর্ষের পরও তাদের জীবন প্রবাহ আজো যেন স্রোতের বিপরীতে বহমান। সামাজিক ও নাগরিক অধিকার থেকে তারা এখনো বঞ্চিত। ভবঘুরে যাযাবর জীবনের শিকলে আবদ্ধ হয়ে দুর্বিষহ গতিধারায় কোনো রকমে নিজেদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে এই বিলুপ্ত প্রায় জনগোষ্ঠীটি।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে আগে তাদের অবাধ বিচরণ দেখা গেলেও এখন বিবর্তনের হাওয়াতে দিন কিংবা মাস পার হলেও তাদের চাক্ষুষ দর্শন যেন দুরূহ ব্যাপার।
বর্তমান আবাসস্থল
এক সময় বেদেরা নৌকায় বাস করলেও বর্তমান সময়ে তাদের বেশিরভাগই স্থলে বাড়ি-ঘর তৈরি করে বসবাস করছে। তাদের বাড়ি-ঘরের রয়েছে বেশকিছু স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। সাভারের বক্তারপুর, কাঞ্চণপুর, অমরপুর এলাকায় বর্তমানে অনেক বেদে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন।
স্থানভেদে বেদেদের বসবাস
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ৮০টি বেদে পরিবারের মধ্যে বর্তমানে নদীতে বসবাস করছে ১৪টি, ডাঙায় ৪২টি এবং নদীতে ও ডাঙাতে মিলে ২৪টি পরিবার বসবাস করছে।
নদীতে
এক সময় বেদে জনগোষ্ঠীর একমাত্র আবাসস্থল ছিল নৌকা। নদীমাতৃক বাংলাদেশ হওয়ায় তাদের জীবিকার প্রধানতম উপায় ছিল মৎস্য শিকার। ক্রমেই নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় ও খাল, বিল বা জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় এবং যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে নৌকায় তাদের বসবাস কমেছে। তবে এখনো কিছু কিছু এলাকায় বেদেরা পরিবার নিয়ে নৌকায় বসবাস করে। ঘনশ্যামপুর, মরিচা ও তুলসীখালীর বেশিরভাগ পরিবারের বসবাস এখনো নৌকাতেই। এছাড়া বিক্রমপুর, সাভার পোড়াবাড়ি এসব এলাকার প্রায় ১৭ শতাংশ বেদে পরিবার এখনো নৌকায় বসবাস করছে।
ডাঙায়
নদীনালা ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় বর্তমান সময়ে বেদেদের মধ্যে নৌকার পরিবর্তে ডাঙায় বসবাস করা ও জমি কিনে বাড়ি করার প্রবণতা বেড়েছে। বিক্রমপুরের ঘনশ্যামপুরের প্রায় ১০০টি পরিবার এবং পোড়াবাড়ি এলাকার চারটি গ্রামের প্রায় ছয় হাজার মানুষ এখন নৌকা ছেড়ে নিজ ঘরবাড়িতে বসবাস করছে। তেঘুরিয়ার বেদেদের নিজস্ব ঘরবাড়ি না থাকায় তারা ভাড়া ঘরে বসবাস করছে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব অঞ্চলের প্রায় ৫৩ শতাংশ পরিবার ডাঙায় বাস করছে এবং নৌকায় বসবাসরত পরিবারগুলোও এখন নিজস্ব জায়গা জমির স্বপ্ন দেখছে।
নদীতে এবং ডাঙায়
বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠীর কথা আসলেই মনে ভেসে ওঠে সারি সারি নৌকার ছবি। কারণ পূর্বে বেদেদের একমাত্র আবাসস্থল ছিল নৌকা। নৌকাতেই তাদের ঘর-সংসার, আবার এই নৌকাই তাদের যাতায়াতের বাহন। তাইতো পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের সোজন বাদিয়ার ঘাটে ফুটে উঠেছে বেদে নৌকার দৃশ্য- ‘মোরা এক ঘাটেতে রান্ধি-বাড়ি, আরেক ঘাটে খাই, মোদের ঘরবাড়ি নাই।’
আর তাই স্থায়ী বাড়ি-ঘর, জায়গা-জমি থাকা সত্ত্বেও অনেক বেদে পরিবার নৌকায় বাস করতে পছন্দ করে।
ঘনশ্যামপুরের বেদেনী তাসলিমা বলেন, ‘এ পাড়ায় তার ঘর আছে। তবে প্রায় সারাদিন তাদের নৌকাতেই কাটে। স্বামী সারারাত নৌকায় করে মাছ ধরে সকালে ফিরে নৌকাতেই ঘুমায়। তিনিও বেশিরভাগ সময় নৌকাতেই কাটান। তবে বাচ্চারা ঘরবাড়িতে খেলতে পছন্দ করে। আবার এমন অনেকেই আছে যারা সারাদিন বাড়ি-ঘরে কাটালেও রাতে নৌকায় ঘুমায়। পানির ঠাণ্ডা হাওয়ায় নাকি ঘুম ভালো হয়।‘
এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ৩০ শতাংশ পরিবার একই সাথে নৌকায় ও ডাঙায় বসবাস করছে। নদীর রূপ বদলের সাথে সাথে বেদেদের চলার পরিধিও ছোট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই অনেকে ছাড়তে শুরু করেছে নদী। কিন্তু নদী ছেড়ে কোথায় যাবে তারা?
পৃথিবীতে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। জীবনপ্রবাহের ধারা বদলে গেছে। জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আজো বেদে সমাজের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হয়নি। সেই ষোড়শ শতাব্দীতে শুরু করা অজ্ঞতা আর অন্ধকারে ঘানি এখনো টানতে হচ্ছে তাদের। জীবনমানে আজো আসেনি সামাজিক মর্যাদা, মেলেনি নাগরিক অধিকার। এমনকি শিক্ষা, চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার থেকেও তারা এখনো বঞ্চিত। নেই কোনো শিক্ষা, নেই কোনো কাজেরই বা জীবিকার বিশেষ সুযোগ। সমাজে শ্রেণি বিভাজন না থাকলেও বেদেদের দেখা হয় কিছুটা আলাদা চোখে। আর তাই সমাজের মূলস্রোতে মেশাটাও খুব একটা সহজ নয় তাদের জন্য।
নৃবিজ্ঞানিরা বলছেন, বেদেরা হারিয়ে গেলে বাংলাদেশের পুরনো ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির একটি অংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হয়তো খুব শিগগিরই তারা পানি ছেড়ে ডাঙায় চলে আসবে। অথচ মাত্র ১৫ বছর আগেও যারা ছিল পানিরই অধিবাসী। খুব দ্রুতই হয়তো তেমন দিন আসবে, যখন আর কোনো বেদেকে নৌকাবাড়িতে করে নদীপথে ঘুরতে দেখা যাবে না।