মহাবিজয়ের মহানায়ক
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৬ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৩১ পিএম, ১১ মে,শনিবার,২০২৪
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর, আজ থেকে ৫০ বছর আগে আমরা যারা এই সময়কে প্রত্যক্ষ করেছি, তাদের কাছে সেই দিনের স্মৃতি অসাধারণ আবেগের এবং আনন্দের। বিকেলের আলো নম্র হয়ে এসেছে, এরকম সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। রেসকোর্স ময়দানের সেই সময়টা বাংলার আকাশের রং বদলে দিয়েছিল। হাজার বছরেরও বেশি সময়ের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে সীমাহীন ত্যাগ আর ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সেদিন অর্জিত হয়েছিল বাঙালির বিজয়। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' ধ্বনিতে মুখর ছিল রাজধানী, গ্রামগঞ্জ- সর্বত্র। এই যে মহাবিজয়, এ বিজয়ের মহানায়ক একজন। তিনি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। তাকে হত্যা করার জন্য ইয়াহিয়া বিচারের নামে প্রহসন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই কঠিন সময়ে অন্নদাশঙ্কর রায় তার বিখ্যাত- 'যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/ গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান' কবিতাটি রচনা করেন। একাত্তরের ৭ মার্চের সেই অগ্নিগর্ভ ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে ১৬ মার্চ কবি জসীম উদদ্ীন বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করেছিলেন ভিসুভিয়াসের সঙ্গে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের হুঙ্কারে আমরা দেখি তার সেই অমর ভাষণের প্রতিধ্বনি। বিশ্বসভায় তিনি গপরিণত হয়েছেন 'পোয়েট অব পলিটিক্স' হিসেবে। এপ্রিল মাসে 'নিউজ উইক' পত্রিকা তাকে আখ্যা দিয়েছিল 'রাজনীতির কবি' নামে। বস্তুত পদ্মা-যমুনার জলস্রোত এবং ভিসুভিয়াসের অগ্নি উদ্গিরণ আর একটি জাতির স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করার এই বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। তিনি ছিলেন আলাদা ও স্বতন্ত্র। সত্যিকার অর্থেই বাঙালির চিরকালের প্রতীক।
মুক্তির যে অন্বেষা বঙ্গবন্ধু সারাজীবন লালন করেছেন, তার মূলে ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো অদম্য এক ইচ্ছা এবং স্বপ্ন। তার জীবনচর্চা, রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং বক্তৃতায় সেই স্বপ্ন উঠে এসেছে বারবার। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সহযোগী জাতীয় চার নেতা এবং অন্যরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন ও চেতনাকে ধারণ করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর পরিচালনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ। তাদের হৃদয়ে সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিনটি অবিমিশ্র আনন্দের ছিল না। একদিকে বিজয়ের আনন্দ, অন্যদিকে স্বজন হারানোর শোক। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। মানুষের মনে হয়েছে, এই বিজয় যেন অপূর্ণ। মুক্তির মহানায়ক ফিরে আসেননি তখনও। তারা অপেক্ষা করেছে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনে। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে তার প্রিয় স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন। সেদিন পূর্ণতা পেয়েছিল স্বাধীনতা; পূর্ণতা পেয়েছিল আমাদের বিজয়।
এখন আমরা পালন করছি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। এ বছর বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মবার্ষিকী চলছে। করোনা পরিস্থিতিতে জন্মশতবার্ষিকীর অনেক কাজ সমাপ্ত হয়নি বিধায় মুজিববর্ষের মেয়াদও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। যে জাতিকে দীর্ঘ অত্যাচার-নিপীড়নের নাগপাশ থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু; এনে দিয়েছেন আরাধ্য বিজয়, সেই বিজয়েরও সুবর্ণজয়ন্তী। আজ এ যেন বাঙালির গৌরবের এক মিলিত মোহনা।
একই সঙ্গে মুজিববর্ষ এবং সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সুযোগ পাওয়া অত্যন্ত গৌরবের, যার অংশীদার আমরা সবাই। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু নিরন্তর পরিশ্রম করেছেন। সে সময়ের প্রশাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের যারা প্রত্যক্ষ সাক্ষী, তাদের স্মৃতিকথা থেকে আমরা জানতে পারি, তিনি কীভাবে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তার যাত্রা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। পদে পদে প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে, কিন্তু তিনি দমে যাননি। বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তিনি, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। ঘাতকের বুলেটে তার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন অসমাপ্ত থেকে গেছে।
আজ বিজয়ের ৫০ বছরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকালে আরেকটি কঠিন ও দীর্ঘ লড়াইয়ের চিত্র আমাদের চোখে ভাসে। সেটি করেছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার- এ রকম কঠিন কাজ সম্পাদনের পাশাপাশি সোনার বাংলা গড়ার যাত্রাকে তিনি আলাদা মাত্রা দিয়েছেন। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়নের এই ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্য শেখ হাসিনার হাতে আলাদা গতি পেয়েছে।
এই ৫০ বছরে বিশ্বসভায় আমাদের অবস্থান এখন অনেক সুদৃঢ়। দীর্ঘ যাত্রার এই সময়ে বাঙালির মহাবিজয়কে উদ্যাপন ও মহানায়কের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর একটা সুযোগ এসে গেছে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে এক দিন যারা কাঁপিয়ে দিয়েছিল সারা পৃথিবী, সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতিও শ্রদ্ধা জানানোর এটি প্রকৃষ্ট সময়।
বঙ্গবন্ধু এক দিন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে বলেছিলেন, 'বুলেট শরীরকে ধ্বংস করতে পারে, আত্মাকে নয়।' বঙ্গবন্ধু আজ শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে উপস্থিত নেই, কিন্তু তার সংগ্রাম-আন্দোলন এবং ত্যাগের আলোকশিখা চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে। এই আলো প্রতিদিন উজ্জ্বলতর হচ্ছে। বিজয়ের এই ৫০ বছরে আমরা নানা আয়োজনের মাধ্যমে যেমন উদ্যাপন করব বিজয়ের আনন্দ এবং আবেগ, সেই সঙ্গে মহাবিজয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিও জানাব আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।
কামাল চৌধুরী: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক