পুলিশ কর্মকর্তা আলীম মাহমুদ সম্পদের নেশায় বুঁদ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১০ এপ্রিল,বৃহস্পতিবার,২০২৫ | আপডেট: ১২:৩৩ এএম, ১৩ এপ্রিল,রবিবার,২০২৫

দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো আর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের নেশায় বুঁদ পুলিশ কর্মকর্তা মোহা. আবদুল আলীম মাহমুদ। ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজি ও বর্তমানে ওএসডি হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে সংযুক্ত। সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। ১৯৯৫ সালে আবদুল আলীম মাহমুদ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করার পরই পাল্টে যেতে থাকে চিত্র। এই পুলিশ কর্মকর্তা শুধু নিজের নামেই নন, সম্পদ গড়েছেন পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনের নামেও। সাতক্ষীরায় স্ত্রী-সন্তানের নামে কিনেছেন বিঘার পর বিঘা জমি। শ্বশুরবাড়ি রংপুরে। তিনি রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ও রেঞ্জ ডিআইজি থাকাকালে সেখানেও নামে-বেনামে গড়েছেন কোটি টাকার সম্পদ। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়।
অনুসন্ধান করতে গিয়ে এ পুলিশ কর্মকর্তা সম্পর্কে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। সাবেক এই অতিরিক্ত আইজিপি তালা উপজেলায় নিজ গ্রামে জমি কিনে বাবার নামে তৈরি করেছেন একটি এতিমখানা। সেই এতিমখানায় অনুদান নেওয়ার নামে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চাঁদা নিতেন। শ্বশুরবাড়ির এলাকা রংপুরে ‘মানবতার বন্ধন’ নামে একটি সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। অভিযোগ রয়েছে, ব্যবসায়ী, মাদক কারবারিসহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা অনুদান নেন ওই সংগঠনের নামে। এসব ছাড়াও ঘুষ এবং বিভিন্ন রকম আর্থিক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পাহাড়। এর সবই করেছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ‘ছাত্রলীগের সাবেক নেতা’ পরিচয় ব্যবহার করে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে মামলা দিয়ে হয়রানি, বদলি বাণিজ্য, জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনে বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে ভোট জালিয়াতি করে পাস করিয়ে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ মিলেছে।
জানা গেছে, মোহা. আবদুল আলীম মাহমুদ ১৯৯৫ সালে ১৫তম বিসিএসের মাধ্যমে সহকারী পুলিশ সুপার পদে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন। ফজলুল হক হলের নির্বাচিত বার্ষিকী সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার নেতৃত্ব দেওয়ায় সাধারণ ছাত্ররা আবদুল আলীমের ২৩৪ নম্বর কক্ষটি ভাঙচুর করেন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে তাকে সান্ত্বনা দেন। সেই সময়কার একটি ছবি আবদুল আলীমের কাছে সংরক্ষিত ছিল। ছবিটিকে পুঁজি করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে এই কর্মকর্তা পুলিশের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোহা. আবদুল আলীম মাহমুদ পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে নড়াইল, নোয়াখালী ও মৌলভীবাজার জেলায় দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সময় তিনি ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তী সময়ে পুলিশ টেলিকম বিভাগের এআইজি টেলিকম হিসেবে দুই দফা দায়িত্ব পালনের সময় কেনাকাটায় অনিয়ম করে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেন। এতকিছুর পরও মেধাতালিকার তলানিতে থাকা আলীম মাহমুদ ৫৩ জনকে ডিঙিয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন। দ্রুত পেয়ে যান ডিআইজি ও অতিরিক্ত আইজি পদে পদোন্নতি। পতিত সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ পছন্দের ব্যক্তি হিসেবে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রথম কমিশনার হিসেবে যোগ দেন তিনি। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ২০১৮ সালে বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেন তিনি। এর পুরস্কার হিসেবে ২০১৯ সালে তাকে বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম) সেবা পদক দেওয়া হয়। রংপুরের কমিশনার থেকে তাকে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি ও পরে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের ডিআইজি হিসেবে পদায়ন করা হয়। গত বছরের ১৩ মার্চ বহু কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে মোহা. আলীম মাহমুদ অতিরিক্ত আইজি পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তাকে নৌপুলিশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানে কর্মরত অবস্থায়ও অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে নানাভাবে ব্যবহার করেন। সর্বশেষ গত ১৬ অক্টোবর নৌপুলিশ থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে অতিরিক্ত আইজি হিসেবে বদলি ও গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ওএসডি করা হয়েছে।
প্রভাব খাটিয়ে নানা অপকর্ম
পুলিশ কর্মকর্তা মোহা. আবদুল আলীম মাহমুদ তালা উপজেলার লক্ষ্মণপুরে তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘আনছার মাহমুদ এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং’। এই এতিমখানায় অনুদান নেওয়ার নামে বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে চাঁদা আদায় করেন। ছাত্রলীগ নেতা থেকে পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ায় কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পেতেন না। কারণ তার বিরুদ্ধে গেলেই সিরিজ মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতো।
কমিশনার হিসেবে যোগদানের পর রংপুরে ‘মানবতার বন্ধন’ নামে একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন আবদুল আলীম মাহমুদ। ব্যবসায়ী, মাদক কারবারিসহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা ডোনেশন নেন তিনি। সংগঠনের আয়-ব্যয়ের হিসাব চাইলে হুমকি দিতেন। এ ছাড়া নগরীর দর্শনা এলাকায় মানবতার বন্ধন নামের একটি এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসায় লাখ লাখ টাকা অনুদান নিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অনুদান নিতে তিনি রংপুরের রয়েলেটি মেগামলের চেয়ারম্যান তানবীর হোসেন আশরাফিকেও ব্যবহার করেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আবদুল আলীম মাহমুদের বড় শ্যালক তার সব অপকর্মের সঙ্গী। তিনি মৌভাষা এলাকায় ৮৭ শতাংশ ওষুধালয়ের জমি ৯ কোটি টাকায় কেনেন। প্রকৃতপক্ষে ওই জমির দাম অনেক বেশি। আবদুল আলীমের দূরসম্পর্কের আরেক শ্যালক নগরীর মাহিগঞ্জের দেওয়ানটুলী এলাকার হুমায়ুন কবির টুলু একসময় মোটর শ্রমিক নেতা আবুল কালাম আজাদের ক্যাডার ছিলেন। র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আবুল কালাম আজাদের মৃত্যুর পর গা ঢাকা দিয়ে থাকেন টুলু। পরে আবদুল আলীম মাহমুদের আস্থাভাজন হয়ে যান।
স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পাহাড়
মোহা. আবদুল আলীম মাহমুদের ঢাকার শান্তিনগর, বনশ্রী ও পূর্বাচলে এবং সাতক্ষীরা, রংপুর ও ঢাকার ধামরাইয়ে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট ও প্লট রয়েছে। তার এক মেয়ে বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। সেই মেয়ের নামেও দেশে অঢেল সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এই পুলিশ কর্মকর্তা মেয়ের নামে ২০২২ সালে ৩০ মে রংপুর জেলার তাজহাট থানার দর্শনার ফতেপুর এলাকায় প্রায় ২০ কাঠা জমি কেনেন এবং ২০২৩ সালের ২৬ জুন রংপুরে দর্শনার দাঙ্গিরপুরে আরপিএমপি অফিসার্স হাউজিং এলাকায় ১৪ কাঠার বেশি জমি কেনেন। এ ছাড়া সাতক্ষীরার তালা উপজেলার লক্ষ্মণপুর এলাকায় হাইওয়ের পাশে ২০১৫ সালে ৯ নভেম্বর ১৫ কাঠা এবং ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর সাড়ে ৫ কাঠার বেশি জায়গা কেনেন। একই এলাকায় ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সাড়ে ১৪ কাঠা, একই বছর ১১ মার্চ ১৫ কাঠার বেশি, ও পরদিন ১২ মার্চ ৬ কাঠা জায়গা ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। লক্ষ্মণপুরে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই আরও ৬ কাঠা, ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট ৩ কাঠা, ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি প্রায় ১৯ কাঠা ও ২০২২ সালের ৩১ মার্চ প্রায় ৮ কাঠা জমি কেনেন।
এ ছাড়া ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নিজের নামে পূর্বাচলে ১৭ নম্বর সেক্টরে ৪০২/এ রোডে প্রায় ৫ কাঠার একটি প্লট কেনেন (প্লট নম্বর ১৪)। ২০১৯ সালে ২৭ জুন রাজধানীর খিলক্ষেতের ২ নম্বর সেক্টরে ২০৭ নম্বর রোড এলাকায় নিজের নামে সাড়ে ৪ কাঠার প্লট কেনেন। ২০২৩ সালের ২১ জুন ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলার কুল্লা ইউনিয়নের বড় কুশিয়ারা এলাকায় মেয়ের নামে সাড়ে ৬ কাঠার বেশি জায়গায় জমি কেনেন। ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট স্ত্রীর নামে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার লক্ষ্মণপুর এলাকায় হাইওয়ের পাশে সাড়ে ১১ কাঠা জায়গা কেনেন। ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মদনপুরের ঈদগাহের দিঘি এলাকায় মেয়ের নামে ৩ কাঠা জমি কেনেন।
এসব স্থাবর সম্পদ ছাড়াও রংপুরে হাউজিং প্রকল্পে কিনেছেন কোটি টাকার জমি। রংপুরের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে সাহেবের দিঘি এলাকায় ৫০ শতক জমি, রংপুর জেলা পরিষদ সিটি সেন্টার নামে নির্মাণাধীন একটি অভিজাত শপিংমলে আবদুল আলীম মাহমুদের স্ত্রী দুটি দোকান ক্রয় করেন। নগরীর দর্শনা এলাকার দীপ আই কেয়ারের বিপরীত পাশে পুলিশ সোসাইটিতে দুটি প্লট কেনেন আলীম মাহমুদ। এতিমখানার সামনে জায়গা দখল করে ১ বিঘা জমি কিনেছেন ৪০ লাখ টাকায়, সাতক্ষীরা হাইওয়েতে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকার জমির ওপর কোটি টাকা ব্যয়ে বসিয়েছেন নাহার ফিলিং স্টেশন। এ ছাড়া মোহা. আলীম মাহমুদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর ও ব্যাংক হিসাবে বিপুল সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
আলীম মাহমুদের বক্তব্য
পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মোহা. আলীম মাহমুদের বিপুল স্থাবর অস্থাবর সম্পদ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। বর্তমানে আমি ওএসডি হিসেবে জননিরাপত্তা বিভাগে সংযুক্ত আছি। আমি চাকরিকালীন কারও কাছ থেকে অবৈধ এক পয়সাও কামাই করিনি। যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলো যাচাই করেন। একটা পক্ষ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এসব কথা ছড়াচ্ছে।’
আরও পড়ুন
এই বিভাগের আরো খবর

আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ, দেশজুড়ে তীব্র লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা

চারুকলায় আগুনে পুড়লো ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ ও ‘শান্তির পায়রা’

'রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক’ পাচ্ছেন সেই পুলিশ কনস্টেবল রিয়াদ

আদালতের আদেশ না মানলে পলাতক ঘোষণা করা হবে টিউলিপকে: দুদক চেয়ারম্যান
