avertisements 2

রাতের ভোটের কারিগররা অধরা, আমলারাও আরামে

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩০ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০২:০১ পিএম, ২ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২৫

Text

একাদশ সংসদ নির্বাচনে দেশের অন্যান্য নির্বাচনী এলাকার মতো অবিশ্বাস্য ফলাফল ছিল বরিশাল-১ আসনে। শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ২ লাখ ৫ হাজার ৫০২ ভোটের বিপরীতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির জহিরউদ্দিন স্বপন ১ হাজার ৩০৫ ভোট পেয়েছিলেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের সেই নির্বাচনে বরিশালের জেলা প্রশাসক তথা রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন আজিয়র রহমান। জেলার পাঁচটি আসনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রার্থীরা বৈধ ভোটের ৯৩ থেকে ৯৯ শতাংশ পেয়ে জয়ী হন বলে ফল ঘোষণা করেছিলেন।

জালিয়াতি ছাড়া এমন ফল সম্ভব না হলেও অন্য সব রিটার্নিং কর্মকর্তার মতো আজিয়র রহমানও আওয়ামী লীগ আমলে পদোন্নতি পেয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাঁকে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে রাবার বোর্ডে বদলি করা হয়েছে। আজিয়রের ব্যক্তিগত ফেসবুকে দেখা যায়, সরকার বদলের সঙ্গে ভোল বদলেছেন। গত ২৬ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘কর্মজীবনে সব সময় চেষ্টা করেছি দায়িত্ব, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার।’ 


জহিরউদ্দিন স্বপন সমকালকে বলেছেন, ‘রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন রাতের ভোটের মূল হোতা। শেখ হাসিনার পরিকল্পনায় পুলিশ, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ব্যালট বাক্স ভরলেও রিটার্নিং এবং সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা রাতের ভোটের মূল বাস্তবায়নকারী। তাদের সাজা দিতে হবে।’ বরিশালে অস্বাভাবিক ফলাফলের বিষয়ে জানতে আজিয়রের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে সমকাল। তিনি কথা না বলে বরং প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধের জন্য বিএনপি নেতাকে দিয়ে তদবির করান। 

একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৬৪ জেলায় ৬৫ রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন। ফেনীতে তপশিল ঘোষণার পর জেলা প্রশাসক বদল হয়েছিল। ঢাকা মহানগর ও চট্টগ্রাম মহানগরে বিভাগীয় কমিশনাররা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। দুই মহানগরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকরা ছিলেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে। ৪৯৪ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তারা ছিলেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা। ৬৭ রিটার্নিং ও ৫১২ সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার সবাই চাকরিতে রয়েছেন। সমকাল ১৩ সাবেক রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। সবাই বিষয়টি এড়িয়েছেন। তাদের চারজনের কর্মক্ষেত্রে গিয়েও সাক্ষাৎ মেলেনি। 


আওয়ামী লীগ শাসনামলের অন্যান্য অনিয়মের প্রতিকারে অন্তর্বর্তী সরকার উদ্যোগ নিলেও নির্বাচনে জালিয়াতিতে জড়িতদের শাস্তির কথা নেই এখন পর্যন্ত। অন্তর্বর্তী সরকার একাদশ নির্বাচনের ছয় রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ওএসডি করেছে। কয়েকজনকে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি করা হয়েছে। বাকিরা আগের পদেই রয়েছেন। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সমকালকে বলেছেন, ‘যেসব কর্মকর্তা চাকরিবিধি ও আইন লঙ্ঘন করে ভোট কারচুপিতে জড়িত ছিলেন, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের।’ কবে কীভাবে এই ব্যবস্থা নেওয়া হবে– তা স্পষ্ট করেননি উপদেষ্টা। 

এখনও দায় নিচ্ছেন না আমলারা

গুম, গায়েবি মামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে পুলিশ ও র‌্যাব ক্ষমা চাইলেও ভোট কারচুপিতে জড়িত আমলারা তা করেননি। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে ৯ ডিসেম্বর বিগত নির্বাচনের ৩০ রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা বৈঠক করেন। তারা নির্বাচনে অনিয়মের জন্য পুলিশকে দায়ী করেন। তাদের ভাষ্য, রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা অসহায় ছিলেন। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কথা শুনত না। 

তবে নির্বাচনের নিয়মানুযায়ী, ভোটে সর্বোচ্চ ক্ষমতা রিটার্নিং কর্মকর্তার। একাদশ নির্বাচনে কারচুপির বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ আসার পরও রিটার্নিং কর্মকর্তা ব্যবস্থা নেননি, বরং তড়িঘড়ি করে গোঁজামিলের ফলাফল প্রকাশ করেন। 

২৫ ডিসেম্বর মতবিনিময়ে পুলিশ, আনসার ও বিজিবির কর্মকর্তারা ভোট জালিয়াতির দায় কিছুটা হলেও স্বীকার করেন। অতীতে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা ৩০ কর্মকর্তা কমিশনকে জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও নির্বাচনী দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের নগদ টাকা দেওয়া হয়েছিল।

পুলিশ কর্মকর্তারা ক্ষমতার পরিবর্তনের পর অপরাধ স্বীকার করলেও ২০১৮ সালের নির্বাচন ‘সফলভাবে’ সম্পন্ন করায় ৬৪ জেলার এসপি সেবার পুলিশ পদক পেয়েছিলেন। 

সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেছেন, নির্বাচনে অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তির সুপারিশ করার বিষয় বিবেচনায় রয়েছে। 

সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, জালিয়াতিরই পরিকল্পনা ছিল 

নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ অধিকাংশ নিবন্ধিত দল। ২০১৮ সালে বহুল আলোচিত সংলাপে শেখ হাসিনার কাছ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি পেয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভোটে অংশ নেয়। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে তাঁর কথায় বিশ্বাস রাখতে বলেছিলেন। 

একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৩৩ সদস্যের নির্বাচনী কোর কমিটি করেছিল দলটি। এর কো-চেয়ারম্যান ছিলেন প্রয়াত এইচ টি ইমাম। এ কমিটির একজন সদস্য সম্প্রতি সমকালকে বলেছেন, শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিলেও পরাজয়ের আশঙ্কা থাকায় আওয়ামী লীগের সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিকল্পনা কখনোই ছিল না। শেখ হাসিনার পরিকল্পনায় ছিল ৬০ থেকে ৮০ আসন বিএনপিকে দেওয়া হবে। বাকি আসন আওয়ামী লীগ ও শরিকরা নেবে। সেগুলোতে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। 

এই নেতার ভাষ্য, এইচ টি ইমাম এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম একটি আসনেও সুষ্ঠু নির্বাচনে রাজি ছিলেন না। এ দুই সাবেক আমলা ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, বিএনপি জোটকে ছাড় দেওয়া যাবে না। এসপিদের প্রতি নির্দেশ ছিল, বিএনপি জোটের প্রার্থীদের প্রচারে নামতে দেওয়া যাবে না। সেই নির্বাচনে বিএনপি জোটের ২৩ প্রার্থী কারাগারে ছিলেন। ৫৪ জন হামলার শিকার হন ভোটের প্রচারে। 

কেন ও কীভাবে জালিয়াতি

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিভাগওয়ারি যে জরিপ করেছিল, তার প্রতিবেদন সমকালের কাছে রয়েছে। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, একাদশ নির্বাচনে মাত্র ২২ আসনে আওয়ামী লীগের জয় নিশ্চিত ছিল। বাকিগুলোতে বিএনপি কিংবা জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা ছিল। আওয়ামী লীগের মিত্র জাতীয় পার্টির জয়ের সম্ভাবনা ছিল একটি আসনে। বিএনপি জোটের ২১১ আসন জয়ের সম্ভাবনা প্রবল ছিল। লড়াই হতে পারে, এমন আসনে বিরোধী জোট এগিয়ে ছিল। 

ঢাকা-১৫ আসনের মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছয়টি ভোটকেন্দ্রের একটির সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ছিলেন একজন ব্যাংকার। তিনি সমকালকে জানিয়েছেন, ২৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে একজন উপপরিদর্শকের নেতৃত্বে কয়েক পুলিশ সদস্য এসে ব্যালট পেপার এবং সিল চান। পরে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার নির্দেশে তা পুলিশকে দেন। সেই কেন্দ্রে চার হাজার ৮০০ ভোটের তিন হাজারই আগের রাতে বাক্সে ভরে পুলিশ। 

আগের রাতে তিন হাজার ব্যালট বাক্সে ভরায় পরদিন সকাল ৯টার দিকে ব্যালট সংকট দেখা দেয়। তখন ভোটারদের কেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেয় পুলিশ। বিতাড়িত ভোটাররা বাইরে এসে সেনাবাহিনীর গাড়ির কাছে যায়। প্রতিকার না করে সেনাবাহিনীর গাড়ি দ্রুত ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করে। এ ভিডিও সে সময় সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ছিলেন কলেজ প্রভাষক নুরুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। সমকাল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে প্রথমে দাবি করেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে যুক্ত ছিলেন না। নির্দিষ্ট করে বলার পর দাবি করেন, ছয় বছর আগের ঘটনা মনে নেই। এক পর্যায়ে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার চাকরিটার ক্ষতি করিয়েন না। আমার বাচ্চাকাচ্চা আছে। তখন আমি পুলিশের ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারি নাই।’

অনিয়মে জড়িত রাষ্ট্রযন্ত্র 

একাদশ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ছিল ৪০ হাজার ১৮৩। সমান সংখ্যক প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তারা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সহকারী প্রিসাইডিং, পোলিং কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বাহিনীসহ সাত লাখের বেশি সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন। সেই সময় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশের মাধ্যমে ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী যাচাই-বাছাই করা হয়। 

ঢাকার একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক যিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ সমর্থক ছিলেন, সমকালকে বলেন, ‘গোয়েন্দা পরিচয়ে যোগাযোগ করে আমার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজ করা হয়। বলেছিল, সহকারী প্রিসাইডিং বানাবে। আমার ছাত্রলীগ পরিচয়ে তারা সন্তুষ্ট হলেও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রা বিএনপির পদে থাকায় দায়িত্ব দেয়নি।’ 

বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের অনুগত না হলে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা হয়। একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভোটের বস্তা গণনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। 

ময়মনসিংহ জেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছিলেন এমন একজন সমকালকে জানিয়েছেন, রিটার্নিং, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, এসপি ৫০ লাখ করে টাকা নিয়েছিলেন। ওসি নিয়েছিলেন ৩০ লাখ টাকা। প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়েছিল। ভোটকেন্দ্রের পুলিশ কনস্টেবলদেরও পাঁচ-সাত হাজার টাকা দিতে হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনও অনিয়মে যুক্ত ছিল

বিরোধী দলের প্রার্থীরা একের পর এক আক্রান্ত হলেও কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ছিল নির্বিকার। ২৯ ডিসেম্বর রাত ৯টার দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, ব্যালটে সিল শুরু হয়ে গেছে। পরদিন দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নির্বাচন কমিশনে লিখিতভাবে জানান, ২২৯ আসনে আগের রাতে ভোট হয়েছে।

অতীতের কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের পার্থক্য ১৫ শতাংশের বেশি না হলেও একাদশে তা ছিল ৬৪ শতাংশ! বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জনসংখ্যার সাড়ে ৩ শতাংশ অর্থাৎ ৫৮ লাখ বাংলাদেশি বিদেশ থাকেন। কিন্তু একাদশ নির্বাচনে ১০৩টি আসনের ২১৩ ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ে। ১ হাজার ২০৫ কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়ে ৬ হাজার​ ৪৮৪টি কেন্দ্রে। অর্থাৎ ৭ হাজার ৯০২ কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে, যা মোট ভোট কেন্দ্রের প্রায় ২০ শতাংশ। সাধারণত ৭৫ শতাংশের বেশি ভোটার উপস্থিতিকে অস্বাভাবিক মনে করা হয়। ৫৮৬ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের নৌকা শতভাগ ভোট পায়। ধানের শীষ ১ হাজার ২৮৫ কেন্দ্রে একটি ভোটও পায়নি।

এমন অস্বাভাবিক ফলাফলের পরও কে এম নুরুল হুদা বলেছিলেন নির্বাচনে তিনি তৃপ্ত। তাঁর কমিশন আইনের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ায় ১৪টি আসনে শেষ পর্যন্ত বিএনপির প্রার্থীই ছিল না। সুশাসনের জন্য নাগরিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের আইন অনুযায়ী উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রদের এমপি প্রার্থী হতে পদত্যাগের বাধ্যবাধতা নেই। নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ গৃহীতের শর্ত জুড়ে দেওয়ায় ৪৬ জনের প্রার্থিতা বাতিল হয়।

সেই সময়কার আরেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘কীভাবে কী হয়েছিল, তা আমার ধারণার বাইরে।’ রাতে ভোট হয়েছে কিনা– প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ ধারণা তো মানুষের মধ্যে আছে।’ এখনও কষ্ট পান জানিয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি লজ্জিত অনুতপ্ত।’ নির্বাচন কমিশন তখন কোনো প্রতিকার না করার বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘সেই পরিবেশ কি দেশে ছিল? চাইলেই পদত্যাগ করতে পারতাম?’

সেই আমলারা কোথায়

আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য এবং আমলাদের ভাষ্য অনুযায়ী, রাতে ভোট এইচ টি ইমাম, সেই সময়কার নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ, পুলিশপ্রধান ড. জাবেদ পাটওয়ারী, সচিব কবির বিন আনোয়ারসহ কয়েকজনের মস্তিষ্কপ্রসূত হলেও সব আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তা তা বাস্তবায়ন করেন। কেউ প্রতিরোধের চেষ্টাও করেননি। তৎকালীন সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদও সহায়তাকারী ছিলেন।

ব্যতিক্রম ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। জেলার দুটি আসনে বিএনপি জয়ী হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা এ জেড এম নুরুল হক এখন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। তিনি সমকালকে বলেছেন, ‘সারাদেশে যাই হয়েছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমার নাম নষ্ট করিনি।’

কখনও লক্ষ্মীপুর-১ আসনে পরাজিত না হওয়া বিএনপি সেখানে ২ দশমিক ০২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। অবিশ্বাস্য ফলাফলের রিটার্নিং কর্মকর্তা অঞ্জন চন্দ্র পাল বর্তমানে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে গিয়ে তাঁর দেখা মেলেনি। দু’দিনের চেষ্টায় ফোনে পাওয়া গেলেও নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠতেই কথা বন্ধ করে দেন।

একই রকম প্রতিক্রিয়া বাকিদেরও। নোয়াখালীর রিটার্নিং কর্মকর্তা তন্ময় দাস পরের পাঁচ বছরে দুটি পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হন। তাঁকে ৭ সেপ্টেম্বর ওএসডি করা হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের শায়লা ফারজানা, নোয়াখালীর তন্ময় দাসও ওএসডি হয়েছেন। কুমিল্লার রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল ফজল মীরকে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে বদলি করা হয়েছে। আরও কয়েকজনকে বদলি করা হলেও গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও। যেমন কৃষি থেকে পরিকল্পনায় গিয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ে রিটার্নিংয়ের দায়িত্ব পালন করা ড. কে এম কামরুজ্জামান সেলিম।

একাদশের যে রিটার্নিং কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের আমলের পদে আছেন, তারা হলেন– ফেনীর দুই রিটার্নিং কর্মকর্তা সেবাস্টিয়ান রেমা, আবদুল মতিন, বাগেরহাটের তপন কুমার বিশ্বাস, বরগুনার কবীর মাহমুদ, বগুড়ার ফয়েজ আহাম্মদ, চাঁদপুরের মো. মাজেদুর রহমান খান, ঢাকার আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান, খুলনার মোহাম্মদ হেলাল হোসেন, ময়মনসিংহের ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস, নরসিংদীর সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন, নাটোরের মো. শাহরিয়াজ, নীলফামারীর নাজিয়া শিরিন, রাজশাহীর এস এম আবদুল কাদের, সাতক্ষীরার এস এম মোস্তফা কামাল, শেরপুরের আনার কলি মাহবুব, সিরাজগঞ্জের কামরুন নাহার সিদ্দিকা প্রমুখ।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2