avertisements 2

ডেঙ্গু পরীক্ষা নিয়ে ‘বর্ষসেরা’ প্রতারণা

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ০২:১১ পিএম, ৭ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪

Text

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টসের (বিআরআইসিএম) উদ্ভাবিত ডেঙ্গু পরীক্ষা কিটের সংবেদনশীলতা আশানুরূপ নয় এবং এটি দেশীয় কোনো উদ্ভাবনও নয়। একাধিক ল্যাবে পরীক্ষায় এর প্রমাণ মিলেছে।

অথচ এটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবনী উদ্যোগ নির্বাচিত হয়। সরকারি পর্যায়ে এ কিট ব্যবহারে ১৪৫ কোটি টাকার প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে।
তবে আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকারের পতন হওয়ায় প্রকল্পটি আর এগোয়নি।

বিআরআইসিএমের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালা খানের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী কিটটি তৈরি করার কথা দাবি করেন। গত ২১ জানুয়ারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে এ কিট কেনার জন্য চিঠি দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৎকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান ব্যক্তিগত সখ্যের কারণে ১৪৫ কোটি টাকার প্রকল্পটি বিআরআইসিএমের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালা খানকে দেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় নির্ভুল ফলাফল পেতে হলে কিটের মান খুব জরুরি। এরপর নমুনার মান এবং সংক্রমণের কোন পর্যায়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে—সেটি। মানহীন কিটে বা নমুনার মান খারাপ হলে ফলস নেগেটিভ আসার আশঙ্কা বেশি। এই ভুলে অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর কারণও হতে পারে।

বিআরআইসিএমের এই কিট তৈরির ড্রাগ লাইসেন্স ও কিটটির বাণিজ্যিক উৎপাদনের অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ)। তবে এর মান নিশ্চিতের বিষয়টি নিয়ে সংশয় রয়েছে।

অনুমোদন পাওয়ার আগে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ-আইসিডিডিআরবির ল্যাবে এ কিটের সংবেদশীলতা যাচাই  করা হয়। এসব ল্যাবের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে কিটের সংবেদনশীলতা আশানুরূপ না হলেও মালা খান শতভাগ প্রমাণিত বলে ঘোষণা করেন। সম্প্রতি প্রতিবেদনগুলো কালের কণ্ঠের হাতে এসেছে।

ল্যাবসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা জানা যায়, ডেঙ্গু পজিটিভ ও নেগেটিভ মিলিয়ে সর্বোচ্চ ১০টি করে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে পজিটিভ শনাক্তে কিটের সংবেদনশীলতা ছিল কোথাও শূন্য শতাংশ এবং কোথাও ৫৬ শতাংশ। কোথাও আবার অস্পস্ট হওয়ায় এ ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়।
নিয়ম হলো, এ ধরনের কিটের মান যাচাইয়ে নমুনা হবে তিন ধরনের—উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন। প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ পজিটিভ বা উচ্চ নেগেটিভ মানের নমুনা ল্যাবে পরীক্ষার জন্য দেয়, যা দিয়ে ভালো মানের কিট নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ ছাড়া ন্যূনতম ২০০ নমুনা পরীক্ষা করার কথা থাকলেও করা হয়েছে মাত্র ১০টি করে।

ল্যাবের ফলাফলে যা জানা গেল 

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শাহেদ আলী জিন্নাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিআরআইসিএমের পাঁচটি পজিটিভ ও পাঁচটি নেগেটিভ নমুনা পরীক্ষা করে আমরা দেখেছি, পজিটিভ শনাক্তে এই কিটের সংবেদনশীলতা শূন্য শতাংশ। নেগেটিভ শনাক্তের ক্ষেত্রে এ হার ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ এ কিট দিয়ে পরীক্ষা করে একটি নমুনার ক্ষেত্রেও পজিটিভ শনাক্ত করা যায়নি। নেগেটিভের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।’

নিপসমের ল্যাব ইনচার্জ সহকারী অধ্যাপক ডা. ফাহমিদা খানম কালের কণ্ঠকে বলেন, বাজারে থাকা অ্যাবোট কিটের সংবেদনশীলতা ৮০ শতাংশ, ডেঙ্গু চেক কিটের সংবেদনশীলতা শতভাগ। এর তুলনায় বিআরআইসিএমের কিটের সংবেদনশীলতা খুব কম—মাত্র ৬৬ শতাংশ। পজিটিভ শনাক্তে ৫৭ শতাংশ ও নেগেটিভ শনাক্তে ৩৩ শতাংশ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইসিডিডিআরবির একজন কর্মকর্তা জানান, ডেঙ্গু পজিটিভ শনাক্তের বিষয়টি ছিল অস্পষ্ট। এতে টেকনিশিয়ানদের ভুল ফলাফল দেওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। নেগেটিভ নমুনা শনাক্তে সাদা দাগ আসে, যা ফলাফল ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকে বিভ্রান্ত করে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ধরনের অ্যান্টিজেন টেস্ট মূলত ভাইরাস শনাক্তের জন্য ব্যবহার হয়। আর ভাইরাস শনাক্তের মূল কাজটি করে থাকে এক ধরনের প্রোটিন অংশ। এটি তৈরির জন্য যে টেকনোলজি সক্ষমতা বা ল্যাব প্রয়োজন, তা বাংলাদেশে নেই। এ প্রোটিন বিদেশ থেকে আনা হয়। কাঁচামালও আসে চীন থেকে।  এ কাজটি ওএমসি ছাড়াও আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান করে থাকে।

কিট উদ্ভাবনে জড়িত বিআরআইসিএমের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের সহযোগিতায় ১৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প পেতে ডেঙ্গু কিট উদ্ভাবনের নাটক সাজানো হয়। মালা খান কিট উদ্ভাবন নিয়ে যেসব তথ্য গণমাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন, সবই ভিত্তিহীন। কিটটি ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্তে শতভাগ কার্যকর নয়। দেশীয়ভাবে উদ্ভাবনও করা হয়নি। চীন থেকে কাঁচামাল এনে বাজার থেকে দেশীয় উপকরণ কিনে সংযোজন হয়েছে। এখানে নতুন উদ্ভাবনের কিছু নেই।

বিআরআইসিএম সূত্র জানায়, কিটের কাঁচামাল আনে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান শিকদার এন্টারপ্রাইজ। মালা খানের সঙ্গে সখ্য থাকায় বিআরআইসিএমের বেশির ভাগ কাজ পেয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। কিটের কাঁচামাল আনার মতো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাদের কাজটি দেওয়া হয়।

শিকদার এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার আউয়াল শিকদার বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালা খানের নির্দেশনায় চীন থেকে কিটের কাঁচামাল আনা হয়। আমার প্রতিষ্ঠানের কোনো অফিস নেই। পরিচিতদের অনুরোধে কিছু কাজ করে থাকি। মালা খান আমার পূর্বপরিচিত।’

এমন অভিযোগের বিষয়ে মালা খান মন্তব্য করতে রাজি হননি। এর আগে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ২০২১ সাল থেকে তাঁরা কিট তৈরির কাজ শুরু করেন। ২০২২ সালে এটি বাংলাদেশ মেডিক্যঅল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) কাছে জমা দেন। পরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট মধ্যে কিটটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়।

মালা খানের নেতৃত্বে মামুদুল হাসান রাজু, রাইসুল ইসলাম রাব্বি, জাবেদ বিন আহমেদ, খন্দকার শরীফ ইমাম, মো রাহাত, নাফিসা চৌধুরী এবং মো. সোহেলসহ একদল বিজ্ঞানী কিটটি তৈরি করেন। ওই সময় দাবি করা হয়, কিটটির সংবেদনশীলতা শতভাগ। এটি কোনো ভুল রিপোর্ট দেয়নি।

ওই সময় দেওয়া মালা খানের বক্তব্য অনুযায়ী, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, গবেষণা ও পরীক্ষার প্রতিষ্ঠিত নিয়ম মেনেই প্রতিটি ধাপ এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। সব তথ্য পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল—বিএমআরসির অনুমোদন মেলে।
 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2