শ্রমবাজার
মালয়েশিয়া যেতে না পারা স্বপ্নভঙ্গ শ্রমিকদের কী হবে
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২ জুন,রবিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৩:৫১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ছবি : সংগৃহীত
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া কর্মী নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে গতকাল শনিবার। গত ১৫ বছরে এ নিয়ে চার দফায় দেশটিতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ হলো। প্রতিবারই শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট গঠনের বিষয়টি সামনে এসেছে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এ চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার তেমন নজির নেই। ভিসা এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার সব ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পরও শুধু বিমানের টিকিট না পাওয়ায় সর্বমোট ৩০ হাজার ৮৪৪ জন শ্রমিকের যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
নির্ধারিত ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে এফডব্লিউ সিএমএস প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের দেশটিতে প্রবেশের সবশেষ সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় ৩১ মে। এর ফলে বাংলাদেশি কর্মীদের ৩১ মের মধ্যে দেশটিতে প্রবেশের হিড়িক পড়েছে। শেষ মুহূর্তে কয়েকটি বিশেষ ফ্লাইট আয়োজন করেও এ বিপুলসংখ্যক ভিসাপ্রাপ্ত কর্মীদের পাঠানো যায়নি। এসব কর্মীর মধ্যে বেশিরভাগই জমি বা শেষ সম্বলটুকু বেচে ও চড়া সুদে ঋণ নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার টাকা জোগাড় করেন। নির্দিষ্ট সময় শেষে নিদারুণ স্বপ্নভঙ্গের মাধ্যমে তাদের সে আশা শূন্যে মিলিয়ে গেছে। কর্মীদের মধ্যে অনেকে তিন-চার দিন ধরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থান করছিলেন। এই কয়েকটি দিন আশা-নিরাশার দোলাচলে সময় কেটেছে তাদের।
গত দেড় বছরে প্রায় পাঁচ লাখ কর্মী যাওয়া মালয়েশিয়ার রাস্তা বন্ধ হওয়ায় বড় ধাক্কা খেল বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। গত শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকে বাংলাদেশসহ ১৪ দেশের জন্য বন্ধ হয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। দুর্নীতি, অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের কারণে এ পর্যন্ত চারবার বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ করতে বাধ্য হয় মালয়েশীয় সরকার।
বাংলাদেশি সিন্ডিকেটের কাছে নিজেদের অসহায়ত্বের কথাও তুলে ধরেছিলেন ঢাকায় মালয়েশীয় হাইকমিশনার হাযনাহ মো. হাশিম। মালয়েশিয়া সরকারের পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত দেশটিতে বন্ধ থাকবে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ।
বায়রা মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আজ (শনিবার) আমাদের অফিস বন্ধ থাকায় কতজন বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন এবং কতজন সেখানে যেতে পারেননি, তার চূড়ান্ত সংখ্যা আমরা এখনো পাইনি। আমরা আগামীকাল (আজ) বলতে পারব।’
মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. শামীম আহসান গণমাধ্যমকে বলেছেন, যারা ভিসা পেয়ে মালয়েশিয়ায় আসতে পারেননি, তাদের নিয়ে আসার ব্যাপারে হাইকমিশনের পক্ষ থেকে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমরা নিয়োগ কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, তারা যেন এসে এখানে (মালয়েশিয়া) কাজ পায়।
আটকে পড়া শ্রমিকদের বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ কী এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না—এমন প্রশ্নে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, এই ভোগান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী, তাদের ব্যাপারে আমরা তদন্ত কমিটি করব। তদন্তে যারা দোষীসাব্যস্ত হবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে আমরা আছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ সব সমস্যার সমাধান হবে।’ গতকাল দুপুরে সিলেটে সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা পরিদর্শন ও মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, পাঁচ লাখের ওপরে কর্মী প্রেরণের জন্য মালয়েশিয়া সরকার কোটা দিয়েছিল। সেই কোটা পূরণে কাজ করেছিল বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে রিক্রুটিং এজেন্টদের সংগঠন বায়রার সঙ্গে কথা বলে কাদের ভিসা হয়েছে আর কাদের ভিসা হয়নি, সেই তথ্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বায়রা সেই তালিকা দিতে পারেনি। ফলে ফ্লাইটের সমস্যা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে কর্মী পাঠানোর জন্য ২২টি বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়। একই সঙ্গে মালয়েশিয়া সরকারকে সময় বাড়ানোর জন্যও চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে এখনো সেই চিঠির উত্তর আসেনি।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, এ সমস্যা সমাধানে দূতাবাস ও মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এ সংকট তৈরির পেছনে যে বা যারা জড়িত, অনুসন্ধান করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যাদের অবহেলার কারণে ৩১ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারছেন না, তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তিনি।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সরকার নির্ধারিত ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা হলেও ৭ লাখ টাকা দিয়েও অনেকেই যেতে পারেননি মালয়েশিয়া। বাংলাদেশ থেকে কৃষি, নির্মাণ, সেবা ও কারখানা ভিসায় মূলত শ্রমিক নিয়েছে মালয়েশিয়া। কৃষি ভিসায় সর্বমোট খরচ হয় ৩৫ থেকে ৩৮ হাজার টাকা। মালয়েশিয়া থেকে ভিসা ক্রয় ৩ হাজার ৫০০ টাকা। বিএমইটি খরচ ১৫ হাজার টাকা। মেডিকেল বাবদ খরচ ১০ হাজার। ভিসা প্রসেসিং ১৫ হাজার এবং বিমান টিকিট ২৩ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অথচ কৃষি শ্রমিকদের কাছ থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো।
নির্মাণ শ্রমিকদের ভিসা ক্রয় বাবদ সর্বোচ্চ খরচ হয় ৭ হাজার টাকা। অন্যান্য সব খরচ মিলে ৩৫ হাজার টাকা। অথচ বিদেশগামী শ্রমিকদের গুনতে হয়েছে সাড়ে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা। সেবা ভিসায় সর্বসাকল্যে খরচ হয় ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা। অথচ প্রার্থীদের কাছ থেকে নিয়েছে সাড়ে ৬ লাখ থেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা। কারখানা ভিসায়ও সর্বমোট খরচ হয় ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা। অথচ বিদেশগামীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৭ লাখ থেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা।
ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরের ভাড়া সাধারণ সময়ে ২৫ হাজার টাকা হলেও কর্মীর ঢলে ফ্লাইট সংকটে তা ওঠে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায়। তার পরও মেলেনি টিকিট। টিকিটের আশায় হাজারো কর্মী ভিড় করেন বিমানবন্দরে। ভাগ্যবানরা অশেষ ভোগান্তি সয়ে দেশ ছাড়েন। যারা টিকিট পাননি, তারা কান্নাকাটি শুরু করেন।
গত মার্চে মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, আপাতত আর শ্রমিক নেওয়া হবে না। আর অনুমোদন ও ভিসা পাওয়াদের ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় ঢুকতে হবে। প্রায় আড়াই মাস সময় পাওয়ার পরও ভিসা পাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত ফ্লাইট নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। ফ্লাইট বৃদ্ধির ব্যবস্থা না করে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্মীদের প্রবেশের সময়সীমা বৃদ্ধির অনুরোধ করে। এতে সাড়া না দিয়ে গতকালই সব দেশের কর্মীদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ করে মালয়েশিয়া। পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত বিদেশি কর্মী নিয়োগ করবে না দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি। ফলে যেসব বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালকে টাকা দিয়েও স্বপ্নের দেশে যেতে পারেননি, তারা পড়েছেন অথৈ সাগরে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত শুক্রবার রাত ১২টা পর্যন্ত মালয়েশিয়া যেতে পেরেছেন ৪ লাখ ৯৪ হাজার ১০২ জন। সে হিসাবে মালয়েশিয়া যেতে পারেননি ৩০ হাজার ৮৪৪ জন ভিসা ও অনুমোদন পাওয়া বাংলাদেশি কর্মী।