avertisements 2

বিমানবন্দরে পদে পদে হয়রানি অব্যবস্থাপনাই যেখানে নিয়তি

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৯ মে,রবিবার,২০২৪ | আপডেট: ১২:০৪ পিএম, ১০ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২৪

Text

সংযুক্ত আরব আমিরাতে অ্যামাজনে চাকরি করেন আবদুল হোসেন রকি। গত বুধবার সন্ধ্যায় এয়ার অ্যারাবিয়ার একটি ফ্লাইটে শারজাহ থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। লাগেজ হাতে পাওয়ার পরই তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কারণ, অতিযত্নে বিদেশ থেকে আনা লাগেজটি কাটা। ভেতরে কম্বল, খেলনাসহ যে জিনিসপত্র ছিল, সেগুলো ঠিক নেই।

এমন অভিযোগ শুধু রকিরই নয়, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অনেক যাত্রীই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। লাগেজ কাটা, ফাটা অবস্থায় পাওয়ার পাশাপাশি হারানো ও চুরির ঘটনাও রয়েছে। অনেকেই বিমানবন্দরে পৌঁছার পর দেখছেন, তাঁর লাগেজ উধাও। আবার কারও লাগেজ আছে, তবে ভেতরের কিছু মালপত্র বের করে নেওয়া হয়েছে। এমন চিত্র শুধু এক দিনের, নাকি নিয়মিত– তা জানতে আরও দু’দিন সরেজমিন বিমানবন্দরে বিদেশফেরত যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে সমকাল। তাতে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি ফ্লাইটের কিছু যাত্রী লাগেজ নিয়ে অভিযোগ করেছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পদে পদে হয়রানি ও অব্যবস্থাপনার শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। বিশেষ করে বিমানবন্দরের নিয়মকানুনের সঙ্গে অনভ্যস্ত যাত্রীদের ভোগান্তি বেশি। দরকার না থাকলেও যাত্রীদের ধরে একরকম জোর করেই লাগেজ র‍্যাপিং করিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। 

এদিকে, করোনাকালে বন্ধ হওয়ার পর এখনও চালু হয়নি কনকোর্স হল। ফলে তাপপ্রবাহের মধ্যেও যাত্রীকে বিদায় জানাতে আসা স্বজনকে টার্মিনালের বাইরের অংশে (ড্রাইভওয়ের পাশে) রোদে পুড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কখনও কখনও বৃষ্টিতেও ভিজতে হয় তাদের। সেই সঙ্গে নোংরা পরিবেশ অস্বস্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে বহু গুণ।

বিমানবন্দরে আরেক অত্যাচারের নাম গাড়ি ভাড়া। যাত্রী গ্রিন চ্যানেল দিয়ে বের হতেই গাড়ি নেওয়ার জন্য চারপাশে ঘিরে ধরে টানাটানি শুরু করেন পরিবহন সংস্থার কর্মীরা। টার্মিনালের বাইরের অংশে এ চিত্র আরও ভয়াবহ। 

লাগেজ অক্ষত না পাওয়াই যেন নিয়তি

সিঙ্গাপুরে স্থাপনা নির্মাণের কাজ করেন ফরিদপুরের নগরকান্দার শহিদুল ইসলাম। বুধবার সন্ধ্যায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে তিনি ঢাকায় আসেন। নিজের জিনিসপত্রের সঙ্গে স্বজনের জন্য এনেছিলেন কিছু উপহারসামগ্রী। কিন্তু যখন লাগেজ হাতে পান, তখন সেটি ছিল ফাটা। ভেতরের জিনিসপত্রও নেই। এ নিয়ে তিনি কোথাও অভিযোগ জানাননি। কারণ এমন সুযোগ আছে, সেটিই তাঁর জানা নেই।

কাছাকাছি সময়ে দুবাই থেকে এয়ার অ্যারাবিয়ার বিমানে আসেন কুমিল্লার মুরাদনগরের মো. শাহীন। টার্মিনালের বাইরে তাঁকে খুব ক্ষুব্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। কারণ, তাঁর কার্টন পুরোটাই খুলে তছনছ করা হয়েছে। জানতে চাইলে বলা হয়েছে, সিগারেটের প্যাকেট ছিল। অথচ সেখানে কোনো সিগারেট ছিল না বলে দাবি করেন তিনি।

একই দিন ওমরাহ শেষে দেশে ফেরা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর রানু বেগম জানালেন, বিমানের বিকেল সাড়ে ৫টার ফ্লাইটে এসেছেন। তাঁর লাগেজ ঠিক থাকলেও হারিয়ে গেছে সঙ্গে থাকা স্বজনের কার্টন। সেই কার্টনে ছিল প্রসাধনসামগ্রী, মসলাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র।

গতকাল শনিবার বেলা পৌনে ১১টায় ইউএস-বাংলার বিমানে দুবাই থেকে ঢাকায় আসেন টাঙ্গাইলের করটিয়ার আবদুর রহিম। তিনি লাগেজের চেইন ছেঁড়া অবস্থায় পান। ভেতরে থাকা পারফিউম গায়েব। সকাল সাড়ে ৯টায় দুবাই থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে আসা কয়েক যাত্রীও লাগেজ অক্ষত পাননি বলে জানান।

রমরমা র‍্যাপিং বাণিজ্য

বিমানবন্দরের ভেতরে ঢোকার পরপরই লাগেজ র‍্যাপিংয়ের কিছু পয়েন্ট রয়েছে। লাগেজ যথাযথভাবে সুরক্ষিত করে আনা হয়নি, এমন যাত্রীরা সেখানে র‍্যাপিং (পলিথিন দিয়ে মোড়ানো) করান। তবে দেখা গেল, যাদের এই সেবা প্রয়োজন নেই, তাদেরও সংশ্লিষ্ট কর্মীরা ডেকে নিয়ে লাগেজ র‍্যাপিং করিয়ে দিচ্ছেন।‍ 

বুধবার সৌদি আরবে কাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন জাকের হোসেন। ফটক দিয়ে ঢোকামাত্র এক কর্মী তাঁকে ডেকে প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের পাশের র‍্যাপিং পয়েন্টে নিয়ে গেলেন। পরে জাকের জানান, তাঁর লাগেজ ঠিকই ছিল, তবু র‍্যাপিং করিয়ে ৩০০ টাকা নেওয়া হয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন, এটা বাধ্যতামূলক।

প্রথমবার সিঙ্গাপুরে যাচ্ছিলেন মানিকগঞ্জ সদরের গড়পাড় এলাকার রাসেল বিশ্বাস। তাঁকেও একইভাবে ডেকে নেন র‍্যাপিং কর্মীরা। পরে তিনি জানান, হাজেরা এন্টারপ্রাইজের কর্মীরা তাঁকে বলেছেন, পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে না নিলে লাগেজ নোংরা হবে, নষ্ট হয়ে যাবে। তাই তিনি র‍্যাপিং করান। 

নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো

বিমানবন্দর মোড় থেকে টার্মিনালের দিকে যেতে শুরুতেই আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) চেকপোস্ট। যাত্রী ও স্বজনের অভিযোগ, নিরাপত্তা তল্লাশির নামে সেখানে প্রায়ই হয়রানির শিকার হতে হয়, বিশেষ করে সহজ-সরল সাধারণ যাত্রীদের নানারকম জেরা করা হয়। তাদের ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। তবে দায়িত্বরতদের ‘ম্যানেজ’ করে অনেকে ঠিকই ঢুকে যান। 

এ প্রসঙ্গে বিমানবন্দর এপিবিএনের এএসপি জুয়েল চাকমা বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য স্বজনসহ অন্য যে কারও প্রবেশ নিষেধ। 

তবে গতকাল টার্মিনালের বাইরের অংশে (ড্রাইভওয়ে) শত শত লোককে ভিড় করে থাকতে দেখা যায়। তাদের বেশির ভাগই যাত্রীর স্বজন। আবার নিয়ম না থাকলেও ড্রাইভওয়েতে যাত্রীর অপেক্ষায় একাধিক গাড়ি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এতেও দুর্ভোগ দেখা দেয়।

টার্মিনালের ভেতরে প্রবেশের ফটকগুলোয় পাসপোর্টসহ কাগজপত্র পরীক্ষা করেন আনসার সদস্যরা। তারা কেতাদুরস্ত ব্যক্তিদের দ্রুততম সময়ে, অনেক সময় পরীক্ষা ছাড়াই ঢুকতে দেন। তবে সাদামাটা পোশাকে থাকা অনেক সাধারণ যাত্রীকে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

রোদে পুড়ে স্বজনের অপেক্ষা

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে সৌদি আরবগামী স্বামী রফিক মিয়াকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন মিনা বেগম। ৯ মাসের ছেলেকে নিয়ে তিনি বসেছিলেন টার্মিনালের ড্রাইভওয়ের পাশে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই সন্তানকে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন তিনি। 

টার্মিনাল-১-এর প্রান্তে ডাস্টবিনের পাশে বসেছিলেন গাজীপুরের মাওনার রিয়াজ উদ্দিন। তাঁর ছেলে রফিকুল ইসলাম সৌদি আরবের রিয়াদে যাচ্ছেন রেস্তোরাঁকর্মী হিসেবে। তিনি জানালেন, যেখানে চেয়ার দেওয়া আছে, সেখানে অনেক রোদ। 

সুনামগঞ্জের জিয়াউদ্দিন ইউসুফ ভারত হয়ে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন। তাঁর ফ্লাইট ছিল বুধবার সন্ধ্যা ৬টায়; কিন্তু চলে এসেছেন দুপুর ২টার আগেই। স্বজনের সঙ্গে তাই বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বলেন, স্বজনরা আগে টিকিট কেটে কনকোর্স হল পর্যন্ত যেতে পারতেন। ভেতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে প্রিয়জনকে বিদায় জানাতেন। সেই সুবিধাটা চালু থাকলে ভালো হতো। 

অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ

একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশমুখেই যাত্রীদের দেখতে হয় ময়লা-অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। টার্মিনালের বাইরের অংশে পড়ে আছে কলার খোসা, সিগারেটের প্যাকেট, গুলের কৌটা, বিস্কুটের প্যাকেট, পানি-জুসের বোতল, খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ। বিজ্ঞপ্তি সাঁটানো রয়েছে, ময়লা ফেললে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা। তবে সে ব্যাপারে চূড়ান্ত রকমের উদাসীন যাত্রী ও স্বজনরা। পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে আছেন এ কে ট্রেডার্সের কর্মীরা। তাদের তৎপরতা দেখা গেলেও কিছুক্ষণ পরপরই জমে যাচ্ছে ময়লার স্তূপ। 

এদিকে, বিমানবন্দরের ভেতর ও বাইরে রয়েছে গাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যবসায় সংশ্লিষ্টদের উৎপাত। গ্রিন চ্যানেলের সামনেই একাধিক পরিবহন প্রতিষ্ঠানের বুথ। তাদের কর্মীরা যাত্রী দেখামাত্রই হাঁকডাক শুরু করেন। গাড়ি নেওয়ার জন্য রীতিমতো পীড়াপীড়ি তাদের। 

যা বলছে কর্তৃপক্ষ

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, অনেক যাত্রীর লাগেজ বা কার্টন অতিরিক্ত ওজনের হয়ে থাকে। তখন তারা লাগেজের সুরক্ষার স্বার্থে র‍্যাপিং করিয়ে নেন। তবে এ ক্ষেত্রে জোর করার কোনো অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে বিভিন্ন সময় তাদের জরিমানা ও সতর্ক করা হয়েছে। তাদের সব কার্যক্রম নিবিড়ভাবে নজরদারিতে রাখা হবে। সেবায় কোনো ব্যত্যয় পেলে লাইসেন্স বাতিল করা হবে। 

রোদে পুড়ে স্বজনের অপেক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা স্বজনের আবেগ বুঝি। কিন্তু গত বছর ৯৪ লাখ যাত্রী এই বিমানবন্দর ব্যবহার করেছেন, যা আমাদের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি। এই বিপুলসংখ্যক যাত্রীর নিরাপত্তাসহ অন্যান্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতেই হিমশিম অবস্থা। স্বজনকে বিমানবন্দরের ভেতরে নেওয়া আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। 

লাগেজ নিয়ে নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম বলেন, লাগেজ ব্যবস্থাপনার পুরো বিষয়টি প্রকাশ্যে সব সংস্থার কর্মীদের উপস্থিতিতে হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে সিসিটিভি ক্যামেরাও রয়েছে। ফলে এখানে কিছু করার সুযোগ নেই। অনেক সময় মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা যাত্রীদের লাগেজ স্ক্যানিংয়ে সন্দেহজনক কিছু পেলে সংশ্লিষ্ট বিমানবন্দরেই তা আটকে দেয়। এরপর সেই যাত্রীর অনুমতি নিয়ে লাগেজ খুলে আপত্তিকর দ্রব্য অপসারণ করে লাগেজ পাঠায় তারা।

বিমানের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) আল মাসুদ খান বলেন, ২৩ কেজি পর্যন্ত ওজনের লাগেজ নেওয়ার কথা থাকলেও যাত্রীরা অনেক সময় বাড়তি ওজনের মালপত্র বহন করেন। অতিরিক্ত ওজনের কারণেও অনেক সময় লাগেজ পড়ে ভেঙে বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যাত্রীরা এ-সংক্রান্ত অভিযোগ লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড সেন্টারে জানাতে পারেন।
 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2