avertisements 2

নতুন প্রত্যাশায় বিদায় ২০২৩

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১ জানুয়ারী,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০৬:০০ এএম, ৪ মে,শনিবার,২০২৪

Text

পৃথিবীতে কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সময় তো, নয়ই। ‘যেতে নাহি দিব’ এ বিলাপধ্বনির ভেতরে আবহমান সূর্য একটি পুরনো দিবসকে আজ কালের স্রোতের ঊর্মিমালায় বিলীন করে পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে যাবে। কেমন করে যেন কেটে গেল একটা বছর, ১২টা মাস, ৩৬৫ দিন। অনেক ঘটন-অঘটন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, চড়াই-উৎরাই, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আনন্দ-বেদনার সাক্ষী হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে ২০২৩ সাল। জীর্ণ ঝরাপাতার মতো আজ ঝরে যাবে ক্যালেন্ডার পাতাটি। পরমায়ুর বৃক্ষ থেকে ঝরে যাবে আরও একটি পাতা।

যে বছরটি হারিয়ে গেল জীবন থেকে, তার সবই কি হারিয়ে যাবে? মুছে যাবে সব? না, সবকিছু মুছে যায় না। যদিও অনেক ঘটনা মুছে যাবে বিস্মৃতির ধুলোয়। আবার পাওয়া-না পাওয়ার অনেক ঘটনা থাকবে উজ্জ্বল হয়ে।

অতীতও মাঝেমধ্যে স্মৃতির অলিন্দে কড়া নাড়বে ঘটনাবহুল-২০২৩। বছর ধরে কত আশা-নিরাশায় চলতে হয়েছে পথ। কখনো বন্ধুহীন, কখনো স্বজনের হাতে হাত রেখে পাড়ি দিতে হয়েছে নানা বাধার বিন্দাচল। এর মধ্যেই যোগ-বিয়োগের খাতায় লেখা হয়ে গেছে কত পাওয়া-না পাওয়ার গল্প। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নিরিখে যদি পেছনে তাকাই আমরা, তা হলে দেখব একটি প্রাপ্তির উজ্জ্বল কিছু সোনালি শস্য, অন্যদিকে অতৃপ্তির কিছু শীর্ণ ঝরাপাতার মতো রিক্ততারও আর্তি জেগে আছে। তাহলে এক পলক দেখে আসা যাকÑ কী পেয়েছি আর কী পায়নি।

বছরের শুরুতে নতুন রাষ্ট্রপতি পায় বাংলাদেশ। ২৪ এপ্রিল দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। চলতি বছর দ্বাদশ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়। আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকে ঘিরে একদিকে সহিংসতা ও অন্যদিকে উৎসব বিরাজ করছে দেশজুড়ে। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছেন শেখ হাসিনা। ২০২৩ সালের স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে দ্বাদশ নির্বচন।

বছরজুড়েই নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস : করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে যুদ্ধের দামামা আঘাত করে বিশ্ব অর্থনীতিকে। খাদ্য সংকটের আভাসের সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি ভুগিয়েছে সাধারণ মানুষকে। বছরজুড়েই মধ্যবিত্তের লড়াই চলে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষ চরম দুর্দশায় পড়ে। খরচে মধ্যবিত্তের কাটছাঁট, নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস ওঠে। বছরের পুরো সময়টাই ‘এত দাম-কী খাব’ সেই দুশ্চিতায় দিন কেটেছে নিম্ন আয়ের মানুষের। সঞ্চয় ভেঙে দিন পার করেন উচ্চ-মধ্যবিত্তরা। বাম্পার ফলন ও রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয় আসার পরও মূল্যবৃদ্ধি লাগাম টানা যায়নি। মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বাজারে গিয়ে মানুষ ভুগেছে। কখনো চালের দাম বেড়েছে। কখনো বা তেলের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। আবার কখনো ডিমের ডজন দেড়শ’ টাকা ছাড়িয়ে যায়। পেঁয়াজ ২৫০ টাকায়, আলু ৮০ টাকায় বিক্রি হয়। কাঁচামরিচ ১ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এভাবেই বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনযাপনকে কঠিন করে তোলে। হঠাৎই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, মাছ, মাংস, ডিম ও শাকসবজির দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। এক পর্যায়ে ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দামও নির্ধারণ করে দিতে হয়েছে সরকারকে। এরপরও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, রিজার্ভে টান:চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় পর্যায়ে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেটিকে আরও উসকে দেয়। আবার বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে মার্কিন ডলারের দাম বাড়তে থাকে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ে। ফলে ২০২৩ সালের শেষদিকে আরেক দফা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে।

ডলার-সংকটের মধ্য দিয়েই বছর শুরু হয়েছিল। বছরটা শেষ হলেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। সারা বছর শরিয়াভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকে তারল্যসংকট দেখা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে এসব ব্যাংকের ঘাটতি ছিল।

আতঙ্কের নাম ‘ভিসানীতি’:এদিকে রাজনীতি যখন সংহিসতায় রূপ নেয় তখন আগুনে ঘি ঢালেন আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার। চলতি বছরের ২৪ মে তিনি ঘোষণা দেন, বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি প্রয়োগ করতে যাচ্ছে আমেরিকা। যারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধা দেবে বা এই কাজে সহযোগিতা করবে তাদের ভিসা দেবে না আমেরিকা। এই ভিসানীতিতে দেশের বর্তমান-সাবেক-সরকারি-বিরোধীদলীয় যে কেউ পড়তে পারেন। পাশাপাশি থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগের সদস্যরা। এই ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতা একে-অন্যকে লক্ষ্য করে কথা বলতে শুরু করেন। রাজনীতির মাঠে আতঙ্ক তৈরি করে ‘ভিসানীতি’। দেশের বুদ্ধিজীবী মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই এক রকম উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনায় এ নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করে। রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের দিকে আঙুল তুলে কথা বলতে শুরু করে। এরপর ম্যাথিউ মিলারের ঘি ঢেলে দেওয়া আগুনে পানি হিসেবে কাজ করে শেখ হাসিনা ও তার মেয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অটিজম বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এক সেলফি। প্রতিবেশী ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিত জি-২০ সম্মেলনে সবচেয়ে আলোচিত এই সেলফি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে শুরু করে বিশ্বনেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। অনেকেই একে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের বরফ গলার লক্ষণ হিসেবে বর্ণনা করেন।

বিএনপির নির্বাচন বর্জন : ২০২৩ সালে রাজনীতির মাঠে ছিল অস্থিরতা। দ্বাদশ নির্বচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর হরতাল-অবরোধে অগ্নিসংযোগ করে প্রায় ৩০০টি পরিবহণ পুড়িয়েছে। এর মধ্যে বাস, ট্রেন ও ট্রাকের সংখ্যা বেশি। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপি মহাসমাবেশ ডাকে। সমাবেশ কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটায় বিএনপি-জামায়াত। প্রধান বিচারপতির বাসাসহ অনেক স্থানে ভাঙচুর, অগ্নিকাণ্ড, পুলিশ ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করে তারা। এরপর অগ্নিকাণ্ড, সন্ত্রাসী ও সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীসহ অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। সারা বছরই নেতাকর্মীদের মধ্যে ছিল গ্রেপ্তার ও সাজা আতঙ্ক।

এ বছর দুর্নীতি মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ৯ বছর ও তার স্ত্রী জোবাইদা রহমানকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থতার মধ্যে বছর পার করেন। ৯ আগস্ট তিনি আবার হাসপাতালে ভর্তি হন।

গোপন ষড়যন্ত্র ও জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করার আশঙ্কায় এবং সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড় থেকে বুয়েটের ২৪ শিক্ষার্থীসহ ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ বছর কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। এর মধ্যে একটি জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া। ২০২৩ হাতের কবজি কেটে টিকটক আলোচনায় ছিল কিশোর গ্যাং।

ডেঙ্গুতে বেশি মৃত্যু:দেশে ২২ বছর পর চলতি বছরের জুলাইয়ে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৩০৩ জন। এ বছর নতুন ধরনের করোনা রোগে কয়েকজনের মৃত্যু হয়। রাজধানীর নিউ মার্কেট ও বঙ্গবাজারের আগুনে ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বছরে একাধিকবার মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কাঁপে দেশ।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সমালোচনা : দেশের শিক্ষাঙ্গনে বিদায়ী বছরে আলোচনার বড় অংশজুড়ে ছিল নতুন শিক্ষাক্রম। করোনা-পরবর্তী স্বাভাবিক ধারায় ফেরার পাশাপাশি শিক্ষকদের আন্দোলন, রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরিসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় স্থান পায় ২০২৩ সালে। হরতাল-অবরোধের আতঙ্কের মধ্যে পরীক্ষায় বসে শিক্ষার্থীরা। সমালোচনা ছিল বিনামূল্যের বই বিতরণ নিয়েও। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে শিক্ষার্থীদের পাসের হার ৭৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি:এ বছর পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রেডভেদে সর্বনিম্ন ৫৪ থেকে সর্বোচ্চ ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়েছে শ্রমিকদের মজুরি। যেখানে আগে ৮ হাজার টাকা পেতেন, সেখান থেকে ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা করার পাশাপাশি তাদের (শ্রমিক) জন্য বছরে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট (বেতন বৃদ্ধি) সুবিধা। পাশাপাশি আগের বেতন গ্রেড ৭টি থেকে কমিয়ে ৫টি নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিকরা মোট বেতনের ৬৩ শতাংশ পাবেন বেসিক হিসেবে। ইতোমধ্যে নতুন এই মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে বলে জানান বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।

অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ:বৈশ্বিক সংকটে যখন বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশগুলোও বিপর্যস্ত, তখনো বর্তমান সরকারের অসামান্য কৃতিত্বে দেশের অর্থনীতির চাকাকে শুধু সচল রাখাই নয়, ২০২৩ সালে মেগা প্রকল্পগুলোর সফল বাস্তবায়ন গোটা বিশ্বকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সারাবিশ্বের সামনে বাংলাদেশ আবারও তার নিজস্ব সক্ষমতার জানান দিয়েছে। সারাবিশ্বের সামনে উন্নয়ন-সাফল্যের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ আজ এক বিস্ময়ের নাম। সাফল্যের মুকুটে একের পর এক যোগ হয়েছে অনেক অগ্রগতির পালক।

২০২৩ সালে এশিয়ার সেরা ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় জায়গা করে নেন বাংলাদেশের দুই নারী বিজ্ঞানী। সিঙ্গাপুরভিত্তিক সাময়িকী ‘এশিয়ান সায়েন্টিস্ট’ এর সেরা এশীয় বিজ্ঞানীদের তালিকায় ওঠে তাদের নাম। তারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী ও বাংলাদেশের চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) অণুজীব বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা।

মেট্রোরেল:প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি বছরের ৪ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেল সার্ভিসের দ্বিতীয় ধাপের উদ্বোধন করেন। এরপর ৫ নভেম্বর থেকে উত্তরা-মতিঝিল রুটে প্রতিদিন চলছে মেট্রোরেল। এর আগে ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের প্রথম ধাপের উদ্বোধন করা হয়। মূলত যানজট নিরসনে রাজধানীজুড়ে মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। রাজধানীর চিরচেনা যানজটে পড়তে হবে না, আশা যাত্রীদের। ক্রমেই যানজটের ঢাকায় আশার ভরসা হয়ে উঠছে মেট্রোরেল। মেট্রোরেল বছরে ৬ কোটির বেশি কর্মঘণ্টা বাড়াবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল : চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর বহুল প্রত্যাশিত চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম যোগাযোগ পথ টানেলের ফলক উন্মোচন করা হয়। উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নদীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম সড়ক টানেল এটি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে : চলতি বছরের ২ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ওইদিন বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক্সপ্রেসওয়ের ১১.৫ কিলোমিটার অর্থাৎ বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন করেন। দ্রুতগতির এই উড়াল সড়কের দৈর্ঘ্য ১৯.৭৩ কিলোমিটার।

পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ : চলতি বছরের ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-ভাঙ্গা রুটে নতুন ট্রেন সার্ভিস উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেল ট্র্যাক নির্মাণ করেছে রেলওয়ে। এর ৮২ কিলোমিটার অংশ ঢাকা ও ভাঙ্গাকে সংযুক্ত করেছে। ঢাকা-কক্সবাজার রুটে রেল :১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা-কক্সবাজার রেল সংযোগ উদ্বোধন করেন। ১ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ ঢাকার উদ্দেশে কক্সবাজার আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে যায়। আবার রাত ৯টা ১০ মিনিটে এই ট্রেন ঢাকায় পৌঁছাচ্ছে নিয়মিতভাবে।

বিমানবন্দরে থার্ড টার্মিনাল:গত ৭ অক্টোবর দেশের প্রথম ও বৃহত্তম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দৃষ্টিনন্দন তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে একসময় বাংলাদেশই হবে সারা বিশ্বের যোগাযোগের হাব। কক্সবাজার বা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, এটাই হবে আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহণের হাব। রিফুয়েলিংয়ের জন্য অনেকেই এখানে আসবে, থামবে; বাংলাদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করবে।

উন্নয়নে পারমাণবিক বিদ্যুৎ :বিদায়ী বছরে বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে যাত্রা করেছে বাংলাদেশ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান দেশে আসে সেপ্টেম্বরে। যার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় ৫ অক্টোবর। এতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøালাদিমির পুতিনের ভার্চুয়ালি হাজির ছিলেন।

আলোচনায় আদালতপাড়া: বিদায়ী এ বছরে উচ্চ আদালতের কয়েকটি মন্তব্যে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রপতি নিয়োগ নিয়ে রিট খারিজ, রিটকারীকে লাখ টাকা জরিমানা, প্রধান বিচারপতির বিদায়, নতুন প্রধান বিচারপতির শপথ, কক্সবাজারের বিচারককে তলব, অপর এক বিচারককে সাজা, নওগাঁয় র‌্যাব হেফাজতে ভূমি অফিসের কর্মী সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা অনুসন্ধানে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা-সব মিলিয়ে সারা দেশের মানুষের নজর ছিল বিচারাঙ্গনে।

আলোচনায় সর্বোচ্চ আদালত টালমাটাল অর্থনীতি ক্রীড়াঙ্গন : সবকিছু ছাপিয়ে দর্শকপ্রিয়তায় এগিয়ে ছিল ক্রিকেটই। তবে তাদের আশা খুব বেশি পূর্ণ করতে পারেননি আমাদের ক্রিকেটাররা। এ বছর সবটা মিলিয়ে ৩২টি ওয়ানডে খেলেছে বাংলাদেশ। এটা এক বছরে সর্বোচ্চ সংখ্যা ম্যাচ খেলা টাইগার বাহিনীর। তবে জয় এসেছে মাত্র ১১টিতে। ওয়ানডে বিশ্বকাপে লক্ষ্যপূরণ করতে পারেনি সাকিবরা। ভালো করতে পারেনি এশিয়া কাপেও। আগের বছর নারী ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়া সেরা হলেও এ বছর ভালো যায়নি সাবিনাদের। অর্থাভাবে তাদের মিয়ানমারে পাঠাতে পারেনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। যেখানে অলিম্পিক বাছাইয়ে অংশ নেওয়ার কথা ছিল তাদের।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি:২০২৩ সাল ‘যুগান্তকারী সাফল্য’ দেখিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি। এটি ভালো বা মানবতার জন্য বিধ্বংসী কোনো প্রযুক্তি কিনা, তা নিয়ে নিয়মিত বিতর্ক চললেও ‘এআই’ শব্দটিকে ‘ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার’-এর খেতাব দিয়েছেন ইংরেজি অভিধান ‘কলিন্স ডিকশনারি’র প্রকাশকরা।

২০২৩ সর্বোচ্চ গরমের বছর : পৃথিবীর তাপমাত্রার আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে ২০২৩ সাল। যা তাপমাত্রা রেকর্ড শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত নথিভুক্ত উষ্ণতার রেকর্ডে সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালে দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর ইউরোপের দেশ ফ্রান্স, স্পেন এবং পর্তুগালে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ দাবানল। ইউরোপ থেকে আমেরিকা নয়, তীব্র তাপদাহে বিপর্যস্ত হয় এশিয়ার দেশগুলো। বাংলাদেশে খরায় পুড়ে ফসলের মাঠ। চলতি বছর ঢাকায় ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৪ ডিগি সেলসিয়াস। আর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায় ৪৩ ডিগ্রি। মরুভূমির দেশের চেয়েও বেশি তাপমাত্রায় পুড়ছে বাংলাদেশ। দুঃসহ গরমে মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখিরও বেহাল দশা হয়।

গাজা-ইসরাইল যুদ্ধ :ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত গাজা ভূখণ্ড ইসরাইলের বোমা হামলায় ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তস্নাত হয়েছে এ বছর। ৭ অক্টোবর গাজা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাস ইসরাইলে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সহস্রাধিক লোককে হত্যা ও শতাধিক ব্যক্তিকে বন্দি করে নিয়ে যায়। এরপর আন্তর্জাতিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে ইসরাইলি বাহিনী নির্বিচারে বেসামরিক অবস্থানের ওপর হামলা শুরু করে। এতে গাজা পরিণত হয়েছে এক মৃত্যুপুরীতে। এর মধ্যে ২১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিপাকে পড়েছে আমদানিনির্ভর দেশগুলো। কারণ জ্বালানি রপ্তানিতে যেমন রাশিয়া শীর্ষে রয়েছে, তেমনি খাদ্য রপ্তানিতে ছিল ইউক্রেনের অন্যতম অবদান। ইউক্রেনের শস্যের ওপর বিশ্বের অনেক দেশ নির্ভরশীল। তাই দেশে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে জ্বালানির ক্ষেত্রে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে আকাশচুম্বী। তৃতীয় বিশ্বে সংকট আরও গভীর। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। ২০২৩ সালে এ যুদ্ধের এক বছর পার হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন এই যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই।

বিধ্বংসী ভূমিকম্প: বিদায়ী ২০২৩ সালে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি এসব দুর্যোগের কারণে সীমাহীন মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে দেশে দেশে। ভূমকিম্প, অতিবৃষ্টি, বন্যা, দাবদাহ, দাবানল, বায়ুদূষণ, তুষারপাতের মতো নানা দুর্যোগে হতাহতসহ ভোগান্তিতে পড়েছে লাখো মানুষ। ২০২৩ সালের শুরু ও শেষের দিকে স্মরণকালের ভয়াবহ ও বিধ্বংসী দুটি ভূমকিম্প দেখেছে বিশ্ব। গত ৬ ফেরুয়ারি তুরস্ক ও সিরিয়ায় এবং ৮ সেপ্টেম্বর মরক্কোয় বড় ভূমিকম্প হয়। এসব ভূমিকম্পে নিহত হয় অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। এ বছর সবচেয়ে আলোচনায় এবং অধিকাংশের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আইফোন ১৫। গত ১২ সেপ্টেম্বরে বহুল প্রতীক্ষিত আইফোন ১৫ সিরিজ উন্মোচন করে প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপল। এর মধ্যে বেশি আলোচনা হয়েছে আইফোন ১৫ প্রো এবং আইফোন ১৫ প্রো ম্যাক্স নিয়ে। এতে আগের মডেলগুলোর তুলনায় অনেক নতুনত্ব এনেছে অ্যাপল।

যাদের হারালাম:২০২৩ সালে অনেক গুণীজনকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে রয়েছেন-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, রাজনীতির রহস্যপুরুষ সিরাজুল আলম খান (দাদাভাই), ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, সাবেক আইজিপি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল আনোয়ার, জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আব্দুল মালিক, জলবায়ু বিজ্ঞানী সালিমুল হক, কওমি মাদ্রাসা দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর প্রধান মুফতি ও মুহাদ্দিস মাওলানা নূর আহমদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী উকিল আব্দুস সাত্তার ভূঁঞা। শিক্ষক ও সমাজসেবক সুফিয়া খাতুন, কারুশিল্প আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ রুবি গজনবী, ভাস্কর শামীম সিকদার, শব্দসৈনিক বুলবুল মহলানবিশ, গবেষক, শিশু সংগঠক পান্না কায়সার, ভাওয়াইয়া শিল্পী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নাদিরা বেগম। শোবিজ অঙ্গনের অনেককেই ২০২৩ সালে হারিয়েছি। এই তালিকায় আছেÑ নায়ক ফারুক, চলচ্চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান, সালাউদ্দিন জাকী, নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী জিনাত বরকতউল্লাহ, টেলিভিশন অভিনেত্রী হুমায়রা হিমু, গীতিকার রাজীব আশরাফ। অভিনেত্রী মিতা চৌধুরী, নির্মাতা ও কবি তারেক মাহমুদ প্রমুখ।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2