পুতিনের শাটডাউনের পর রাশিয়ান সাংবাদিকরা ইস্তাম্বুলে পালিয়েছেন
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৯ মার্চ,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:২০ এএম, ২৭ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
রাশিয়ার স্বাধীন মিডিয়া আউটলেটগুলির ওপর নেমে এসেছে পুতিনের শাটডাউনের খাঁড়া। মারিয়া বোরজুনোভা এবং সোনিয়া গ্রয়সম্যান এই মাসের শুরুর দিকে স্বাধীন রাশিয়ান মিডিয়া আউটলেট ডজড টিভিতে একটি ব্রিফিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন, যদিও এটি মস্কোর প্রচলিত পাড়ায় তাদের অফিসে হয়নি। কারণ তাদের চ্যানেল হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন মারিয়া ও সোনিয়ার প্রাক্তন সহকর্মীরা রাশিয়া থেকে পালিয়ে গিয়ে ইস্তাম্বুলে মিলিত হয়েছিলেন আলোচনার জন্য।
সংবাদ উপস্থাপক বোরজুনোভা বলছেন, 'এই মুহূর্তে আমাদের কোন পরিকল্পনা নেই। আমরা সবাই আগামী দিনে কী করব তা বোঝার চেষ্টা করছি। ” ১ মার্চ রাশিয়ান ইন্টারনেট প্রদানকারীরা দেশের একমাত্র স্বাধীন টেলিভিশন চ্যানেল Dozhd TV-র ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ বন্ধ করে দেয়, যা Rain TV নামেও পরিচিত। ইউক্রেন আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার বাকস্বাধীনতার ওপর নজিরবিহীন আক্রমণের অংশ ছিল এই পদক্ষেপ। সংবাদ সাইট মেডুজা এবং দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত রেডিও স্টেশন একহো মস্কভিসহ কার্যত সমস্ত স্বাধীন রাশিয়ান-ভাষার মিডিয়া আউটলেটগুলি অবরুদ্ধ বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
এর পাশাপাশি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং টুইটার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিবিসি, ডয়চে ভেলে এবং রেডিও ফ্রি ইউরোপসহ বিদেশী সংবাদ আউটলেটগুলির অ্যাক্সেস সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। রাশিয়া একটি আইনও পাস করেছে , যাতে বলা আছে ইউক্রেনে ক্রেমলিনের যুদ্ধ সম্পর্কে "ভুয়া" তথ্য ছড়ালে শাস্তিস্বরূপ ১৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে । ডজডের একজন ভিডিও রিপোর্টার গ্রয়সম্যান বলছিলেন, ''আমাদের অফলাইন করে দেবার পরেও আমরা সত্যিই কাজ চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম'' । কিন্তু যখনি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ জানতে পারে যে পুলিশ তাদের অফিসে হামলা চালাতে চলেছে, তখন বোরজুনোভা এবং গ্রয়সম্যান বাকি সহকর্মীদের সাথে বিদেশে পালানোর জন্য বিমানের টিকিট খুঁজতে শুরু করেন। অন্তত ১৫০ জন রাশিয়ান সাংবাদিক, যার মধ্যে ডজডের বেশিরভাগ সাংবাদিক রয়েছেন তাঁরা রাশিয়া থেকে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বেশিরভাগ দেশ রাশিয়ান এয়ারলাইনগুলির জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধ করার পরে ইস্তাম্বুল একটি জনপ্রিয় গন্তব্য হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। কিছু মিডিয়া, যেমন ইন্ডিপেন্ডেন্ট নিউজপেপার, নোভায়া গেজেটা প্রাণপনে তাদের পাঠকদের ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। অন্যরা, যেমন মেডুজা এবং মস্কো টাইমস তাদের পুরো অফিস দেশের বাইরে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ডজডের জন্য, উভয় বিকল্পই নিরর্থক বলে মনে হয়েছিল। যেহেতু টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য একটি স্টুডিও এবং উপযুক্ত সরঞ্জামের প্রয়োজন, তাই ডজডের পক্ষে বিদেশ থেকে চ্যানেলের কাজ চালানো সম্ভব ছিল না। তাই চ্যানেল বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না বলে জানাচ্ছেন বোরজুনোভা। ইস্তাম্বুলের পাশাপাশি তিবিলিসি-ও রাশিয়ানদের জন্য পছন্দের আরেকটি আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে। রাশিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকরা ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রের দ্বারা নিপীড়নমূলক কৌশলের জটিল আবর্তে পড়েছেন , যার মধ্যে একটি আইন রয়েছে যা অনেক স্বাধীন মিডিয়া সংস্থাকে "বিদেশী এজেন্ট" বলে উল্লেখ করেছে। গ্রয়সম্যান বলছেন তিনি আগে থেকেই এসবের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ডজড টিভিতে কাজ করার আগে গ্রয়সম্যান Proekt-এর একজন সাংবাদিক ছিলেন, যেটিকে একটি "অবাঞ্ছিত" সংস্থা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, এবং তাকে ব্যক্তিগতভাবে একজন "বিদেশী এজেন্ট" বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এর কিছুক্ষণ পরেই, Proekt বন্ধ হয়ে যায় এবং পুলিশ তার কিছু কর্মীদের অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশি চালায়। গ্রয়েসম্যান বলেছিলেন, ''ডজড ব্লক করার পর প্রথম কয়েক ঘণ্টা আমরা বিশ্বাস করতে পারেনি চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে গেছে , আমরা কেউ হাল ছেড়ে দিতে চাইনি। তবে জানতাম যে, আমরা সিস্টেমের বিরুদ্ধে জিততে পারব না''। দীর্ঘদিন ধরে, রাশিয়ান সাংবাদিকরা সরকারের সঙ্গে বিড়াল এবং ইঁদুর দৌড় খেলে কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই যুদ্ধ স্বাধীন সাংবাদিকতাকে হত্যা করেছে বলে মনে করছেন রুশ সাংবাদিকরা। একজন সাংবাদিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং স্বাধীন ওয়েবসাইট হোলোডের সম্পাদক আলেকসান্ডার গর্বাচেভ ( যিনি ইস্তাম্বুলে চলে এসেছেন )বলেছেন , গত বছরের শেষের দিকে বেশিরভাগ স্বাধীন মিডিয়াকে 'বিদেশী এজেন্ট' হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, কিন্তু আপনি চাইলে এখনও তাদের অ্যাক্সেস করতে পারেন। আপনি Meduza পড়তে পারেন, Dozhd, Mediazona বা BBC দেখতে পারেন। যদিও সাংবাদিকদের কাছে এই পরিস্থিতি খুবই অসহনীয় ছিল। গর্বাচেভ এবং তার স্ত্রী যিনি বিবিসির সাংবাদিক, পুতিন আক্রমণের ঘোষণা করার সাথে সাথে রাশিয়া ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন । বিদেশ থেকে কর্মরত সাংবাদিকরা এখন রাশিয়ার অভ্যন্তরের জীবন সম্পর্কে, বিশেষ করে প্রতিবাদ বা অন্যান্য সংবেদনশীল গল্পের বিষয়ে রিপোর্ট করার জন্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। রাশিয়া ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপ নিয়েছে, বিশেষ করে ২০১৯ সালে একটি আইন প্রবর্তনের সাথে সাথে ইন্টারনেট অবকাঠামোর উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত হয়েছে । কিছু পর্যবেক্ষক আশঙ্কা করছেন যে এই যুদ্ধ ক্রেমলিনকে চীনের মতো একটি সীমাবদ্ধ ইন্টারনেট পরিষেবার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।ইন্টারনেট নীতি বিশেষজ্ঞ কনস্টান্টিনোস কোমাইটিস বলেছেন, "এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে কোনওভাবে রাশিয়ার মধ্যে তথ্যের প্রবাহ অব্যাহত রাখা , কারণ ভেতরে থেকে তবেই শাসনের পরিবর্তন করা সম্ভব।"রাশিয়ান সাংবাদিকদের অনেকেই হতাশা থেকে বেরিয়ে এসে ইউক্রেন আক্রমণ সম্পর্কে রাশিয়ান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই স্বরূপ খবর পরিবেশন করতে চাইছেন । ইউটিউব শো হোস্টকারী শেপেলিন বলছেন , '' আমি নিজেকে সাংবাদিক বলতে রাজি নই, আমি আমার কাজকে এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রচার হিসেবে দেখছি। আমি নিশ্চিত রাশিয়ার সরকারি মিডিয়াগুলি খুব শিগগিরই বুঝতে পারবে ক্রেমলিন এই যুদ্ধ নিয়ে মিথ্যা বলে আসছে এবং সেই সময়ে তাদের সত্যিটা বলার জন্য প্রস্তুত থাকবো আমরা। ''
সূত্র : www.theguardian.com, মানবজমিন ডিজিটাল