avertisements 2

দক্ষিণ এশিয়া কি অন্ধকার পথে এগুবে?

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৬ অক্টোবর,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০১:৩০ এএম, ২৫ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪

Text

যদি কিছু ভারতীয় (সবাই না) ভারতের মুসলমানদের তামাশা, নির্যাতন, ক্ষতি, আঘাত, সন্ত্রাস বা হত্যা করে, তাহলে অন্য দেশে বসবাসকারী হিন্দু এবং শিখরাও কি তামাশা, নির্যাতন, ক্ষতি, আঘাত, সন্ত্রাস বা হত্যাকান্ডের শিকার হবে না? সহজেই জ্বলে উঠা উপমহাদেশে, 'ক্রিয়া' এবং 'প্রতিক্রিয়া' কখনোই ভালোভাবে আলাদা করা যায় না।

ভারতের প্রখ্যাত ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে লেখা এক কলামে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা এবং দেশটির সাবেক কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম এমন মন্তব্য করেছেন।

 'সীমানা মানুষকে ধরে রাখতে পারে না' উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, সীমানার মাধ্যমে দেশসমূহ নির্ধারিত হলেও পৃথিবীর ইতিহাসে প্রচুর সংখ্যক মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যাওয়ার ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। বিশ শতক এবং বর্তমান একুশ শতক- অভিবাসনের জন্য উল্লেখযোগ্য।

 জাতিসংঘের অধীনে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ মাইগ্রেশন (এইওএম) নামে একটি সংস্থা রয়েছে। ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি অভিবাসন এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের সাথে সাথে চলাফেরার স্বাধীনতার অধিকারের মধ্যে যোগসূত্রকে স্বীকৃতি দেয়। অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত- অভিবাসন বন্ধ করা যাবে না। (ভারতে সাড়ে ৬ কোটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় অভিবাসী রয়েছে) আমরা ‘অভিবাসনের সুশৃঙ্খল ও মানবিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে’ আইওএম এর মতো কাজ করতে পারি।

 পি চিদাম্বরম মনে করেন মানুষের দেশান্তরী হওয়ার কারণ হলো দেশভাগ এবং যুদ্ধ। ভারতের ক্ষেত্রে উক্ত দুটোই ঘটেছে মন্তব্য করে তিনি লিখেছেন, ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনকে মানব ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ 'জোরপূর্বক' অভিবাসনের কারণ বলে মনে করা হয়।

সংখ্যাটি আনুমানিক ১ কোটি ৮০ লাখ। বাংলাদেশের জন্ম দেয়া মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে ৮০-৯০ লাখ শরণার্থী ভারতে আসে। তাদের অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গে বসতি স্থাপন করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অংশ আসামে বসতি স্থাপন করেছে। তাদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান ছিল। একই সময়ে লাখ লাখ মুসলমান ভারতে থেকে যায়, হাজার হাজার হিন্দু ও শিখ পাকিস্তানে ফিরে যায় এবং বিপুল সংখ্যক হিন্দু বাংলাদেশে ফিরে যায়। এই তিনটি দেশের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশ স্বঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র, দুটোই কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

 বছরের পর বছর ধরে, হিন্দু, মুসলিম এবং শিখ সহ লাখ লাখ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়। আমরা গর্বের সাথে তাদের প্রবাসী ভারতীয় বলি। তবে, তারা ধর্মনিরপেক্ষ হলেও মূলত খ্রিস্টান একটি দেশে সংখ্যালঘু। একইরকমভাবে ভারতীয় অভিবাসীরা অনেক ইউরোপীয় দেশ সহ কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেছে। তাদের মধ্যে কেউ জাতিগত বা ধর্মীয় কুসংস্কারের শিকার হলে ভারত সরকার স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন হয়।

২১ কোটি ৩০ লাখ মুসলমানদের ভারতে নিজেদের বাড়ি রয়েছে যেখানে তাদের পূর্বপুরুষরা বসবাস করতেন। একইভাবে, বাংলাদেশের দেড় কোটি হিন্দু (১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে) সেইসব পরিবারের বংশধর যারা দেশভাগ বা মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে চলে আসেনি।

 ভারতীয় নাগরিকদের বংশধর এবং অভিবাসী - দুই ধরনের মুসলমানরাই ভারতে বসবাস করে। তারা বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় কুসংস্কারের শিকার হচ্ছে। তবুও, মোদি সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে বা তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা জানাতে অস্বীকার করে। যদি কোন দেশ প্রশ্ন উত্থাপন করে, মোদি সরকার তাদের 'ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের' বিরুদ্ধে সতর্ক করে। বাংলাদেশে হিন্দু ও হিন্দুদের উপাসনালয়ে হামলার সময় ভারতের উদ্বেগ প্রকাশ করার সাথে বিষয়টি সাংঘর্ষিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্পষ্ট বক্তব্য এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি তার দৃঢ় নির্দেশাবলীও বিবেচনা করুন।

আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পিতা এম এস গোলওয়ালকর তার বই 'উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড' এ যা লিখেছিলেন তা স্মরণ করিয়ে দিই: "মুসলমানরা অবশ্যই হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির প্রসিদ্ধি ভিন্ন অন্য কোন ধারণা (সমূহ) নিয়ে ভাবতে পারবে না। দেশটিতে সম্পূর্ণরূপে হিন্দু জাতির অধীনস্থ থাকতে হবে, কিছুই দাবি না করে... এমনকি নাগরিক অধিকারও নয়।" আরএসএস/বিজেপির বর্তমান নেতারা কি সেই দর্শন থেকে নিজেদের দূরে রেখেছেন? ধরে নিলাম দূরে রেখেছেন। তাদের কাজ ও কথা কিন্তু সেই ধারণাকেই বিশ্বাস করে। প্রকৃতপক্ষে, মুসলমানদের উপর বাড়াবাড়িতে তাদের নীরবতা আমাদের আরও কিছু জানান দেয়।

 - কোনো ধর্মনিরপেক্ষ জাতি কি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) -এর মতো একটি বৈষম্যমূলক আইনকে সমর্থন করবে যা মুসলমানদের বাদ দিয়ে সকল ধর্মের মানুষকে গ্রহণ করে? কেউ কি বলতে পারেন যে সিএএ এবং হাজার হাজার কথিত 'বিদেশি' আটকের হুমকি বাংলাদেশে এবং অন্য কোথাও প্রভাব ফেলবে না?

- কোনো সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জাতি কি পেহলু খানকে হত্যা করবে, যিনি রাজস্থানে তার ছোট দুগ্ধ খামারে গরু পরিবহন করছিলেন, অথবা আখলাককে এই সন্দেহে যে তিনি ইউপি (ভারতের উত্তর প্রদেশে) তে তার বাড়িতে গরুর মাংস রেখেছিলেন?

 - কোনো বহু-ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর দেশ কি ভিন্ন ধর্মের দুটি মানুষ প্রেমে পড়লে বা বিয়ে করতে চাইলে তাকে লাভ জিহাদের মতো বাজে তত্ত্বে ফেলায় সহ্য করবে?

- কোনো আধুনিক জাতি কি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড 'তানিষ্ক'কে এমন বিজ্ঞাপন সরানোর জন্য চাপ দেবে যাতে বলা হয়েছিল দুই ভিন্ন বিশ্বাসের দম্পতি স্বামীর পরিবারে সুখে বসবাস করছে?

- কোনো বহু ভাষিক দেশ কি উর্দু নামকে অপরাধগণ্য করবে যেটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ফ্যাবিন্ডিয়া কর্তৃক জামাকাপড়ের লাইন চালু করার জন্য দেওয়া হয়েছিল? এই অভিযোগে যে তা দুই সপ্তাহ পর হওয়া একটি হিন্দু উৎসবকে ইসলামিক রঙ দিয়েছে?

- মুজাফফরনগর এবং উত্তর-পূর্ব দিল্লির সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় অভিযুক্তদের তদন্ত ও বিচারে যে ফল এসেছে সেই আইনকে সমর্থন করতে কি বাধ্য কোনো পক্ষপাতহীন রাষ্ট্র?

বহুত্ববাদকে বাস্তবতা বলে মনে করেন চিদাম্বরম। তিনি লিখেছেনঃ যদি কিছু ভারতীয় (সবাই না) ভারতের মুসলমানদের তামাশা, নির্যাতন, ক্ষতি, আঘাত, সন্ত্রাস বা হত্যা করে, তাহলে অন্য দেশে বসবাসকারী হিন্দু এবং শিখরাও কি তামাশা, নির্যাতন, ক্ষতি, আঘাত, সন্ত্রাস বা হত্যাকান্ডের শিকার হবে না? সহজেই জ্বলে উঠা উপমহাদেশে, 'ক্রিয়া' এবং 'প্রতিক্রিয়া' কখনোই ভালোভাবে আলাদা করা যায় না।

বহুত্ববাদ একটি বাস্তবতা। প্রতিটি দেশকে অবশ্যই বিভিন্ন সংস্কৃতির, বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী, বিভিন্ন ভাষা ও ধারা অনুসরণকারী লোকদের সাথে বসবাস করতে শিখতে হবে। যা একটি জাতিকে গ্রহণযোগ্যতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার সাথে আবদ্ধ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।

মনে হচ্ছে সহিষ্ণুতার জায়গা দখল করেছে সহিংসতা। এটি যে কোনখানে, যে কোনও সময়ই ঘৃণ্য। সহিংসতা সহিংসতারই জন্ম দেবে। চোখের বদলে চোখ নেয়া পৃথিবীকে অন্ধ করে দেবে। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, কে এটা বলেছিল?

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2