পানি শেষ, বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়ছে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু এলাকা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৩ আগস্ট,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:২১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ইরানের উর্মিয়া হ্রদের ছোট দ্বীপগুলো একসময় পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত ছিল। মাত্র দুই দশক আগেও উর্মিয়া ছিল মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম হ্রদ এবং এখানে অবস্থিত পর্যটন কেন্দ্রের হোটেল ও রেস্তোরাঁয় প্রচুর মানুষের আনাগোনায় স্থানীয় অর্থনীতিও বেশ ভাল অবস্থায় ছিল।
মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএনের একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হ্রদটি শুকিয়ে লবণাক্ত সমতলভূমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং ফেরিগুলো চলতে পারছে না।
উর্মিয়া হ্রদ পাঁচ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার (দুই হাজার ৮৫ বর্গমাইল) থেকে ছোট হয়ে মাত্র দুই হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার (৯৬৫ বর্গ মাইল) হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ইরানের পশ্চিম আজারবাইজান অঞ্চলের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা বিভাগ। কর্মকর্তারা আশংকা করছেন, হৃদটি পুরোপুরি শুকিয়ে যেতে পারে।
ইরানের মতো মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। বস্তুত দেশগুলোতে পানির সরবরাহ শেষ হয়ে যাচ্ছে।
এই অঞ্চলটি বেশ কিছুদিন ধরে বিরামহীন খরা ও উচ্চ পর্যায়ের তাপমাত্রার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের বৈরি পরিবেশে জীবনধারণ করা প্রায় অসম্ভব। সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, পানির অব্যবস্থাপনা ও অতিরিক্ত ব্যবহার যোগ হওয়াতে ভবিষ্যতে আশংকাজনক পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।
ওয়াটার রিসোর্সেস ইন্সটিটিউটের (ডব্লিউআরআই) পরিচালক চার্লস আইসল্যান্ড জানান, খাদ্য উৎপাদনে আত্ননির্ভরশীলতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ইরান, ইরাক ও জর্ডানসহ কিছু মধ্যপ্রাচ্যের দেশ প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে জমিতে সেচ দিচ্ছে। একই সঙ্গে অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে গেছে।
'বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে যে পরিমাণ পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করছে, তারচেয়েও অনেক বেশি পানি তারা ব্যবহার করছেন। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে, কারণ সেখানে যে গতিতে পানি জমা হয় তারচেয়েও অনেক দ্রুত পানি তুলে ফেলা হচ্ছে', জানান চার্লস।
ইরানে পানির অভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। জুলাইতে এক সপ্তাহের মধ্যে নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে তিন জন আন্দোলনকারী নিহত হন। তারা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে পানির সংকট নিয়ে বিক্ষোভ করছিলেন।
ইরানের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশটি গত পাঁচ দশকের মধ্যে শুষ্কতম সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এ মাসের শুরুর দিকে প্রকাশিত জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেলের প্রতিবেদনে দেওয়া পূর্বাভাষ থেকে জানা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের শীতকাল আরও শুষ্ক হবে, গ্রীষ্মকাল আরও আর্দ্র হবে এবং উচ্চ গরম বৃষ্টির পানি শুকিয়ে দেবে।
বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছে, বৃষ্টির পরিমাণ বাড়লেও বাড়তি গরমের কারণে পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে। এছাড়াও অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চীন, জার্মানি ও বেলজিয়ামের মতো বন্যা হতে পারে।
ইরানের জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উর্মিয়া হ্রদ ছোট হয়ে যাওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের অবদান ৩০ শতাংশেরও বেশি।
সবচেয়ে আশংকাজনক বিষয় হচ্ছে, এ পরিবর্তনের কারণে পানির প্রাপ্যতার পাশাপাশি এর গুণগত মানও প্রভাবিত হয়।
উর্মিয়া হ্রদের পানিকে এখন বলা হচ্ছে হাইপারস্যালাইন, অর্থাৎ এটি অনেক বেশি লবণাক্ত। একদিকে হ্রদটি ছোট হয়ে আসছে আর অপরদিকে এতে লবণের পরিমাণ বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। লবণাক্ত পানি দিয়ে জমিতে সেচ দেওয়ায় ফসলের ক্ষতি হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন কৃষকরা।
মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি পানি সংকটে ভুগতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে জর্ডান অন্যতম। সে দেশের মানুষ কম পানি ব্যবহার করে জীবন ধারণ করায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
জর্ডানের জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমির এক গবেষণায় দেখা গেছে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ জর্ডানের নাগরিকদের জনপ্রতি পানি ব্যবহারের পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমাতে হবে। অর্থাৎ দরিদ্রদের দিনে ৪০ লিটার পানি দিয়ে চলতে হবে। এই পরিমাণ পানি দিয়ে তাদেরকে গোসল, ধোয়ামোছা ও পান করার কাজ চালাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক দৈনিক গড়ে ৪০০ লিটার বা তারচেয়েও বেশি পানি ব্যবহার করেন।
জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড্যানিয়েল রোজেনফেল্ড বলেন, 'জর্ডান এখন পানির মারাত্মক সংকটে ভুগছে। জর্ডানের বাড়িগুলোতে সপ্তাহে এক বা দুইদিন পানি পাওয়া যায়, এমনকি রাজধানী আম্মানও এর ব্যতিক্রম নয়।'
জর্ডানের পানিসম্পদ বিভাগের মহাসচিব বাশার বাতায়নেহ সিএনএনকে জানান, দেশটিতে পানির চাহিদা মেটানোর জন্য বহির্বিশ্বের সহায়তা ও তহবিল প্রয়োজন। তিনি জানান, দেশটিতে ২০২০ সালে এর আগের বছরের তুলনায় অনেক কম বৃষ্টি হয়েছে এবং এ কারণে পানীয় জলের উৎস অর্ধেকে নেমে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
মূলত খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেচের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হচ্ছিল। কিন্তু অতিরিক্ত সেচ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন চাষাবাদ থেকে শুরু করে সকল ধরনের কর্মকাণ্ডের ওপর প্রভাব পড়ছে, যা প্রকারান্তর খাদ্য নিরাপত্তার প্রতি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে।