ভূমধ্যসাগর শান্ত হলেই বেড়ে যায় মানবপাচার
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ আগস্ট,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:৪৪ পিএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
ভূমধ্যসাগরের আবহাওয়া শান্ত হলেই সক্রিয় হয়ে ওঠে দেশ-বিদেশের মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা। শুধু গত চার দিনেই লিবিয়া ও ইতালি উপকূল থেকে বাংলাদেশ, কংগো, ক্যামেরুন, ঘানাসহ বিভিন্ন দেশের ১০ নারী, ৯ শিশুসহ দুই হাজারের মতো অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ জুলাই লিবিয়ান কোস্টগার্ড শিপ জোয়ারা সিটির উপকূল এলাকা থেকে ১২১ জনকে উদ্ধার করে। একইভাবে পশ্চিমাঞ্চল সিটি জাওয়াইয়া থেকে উদ্ধার করে আরো ৮৪ জনকে। তাদের সবাইকে ত্রিপোলির ডিটেনশন ক্যাম্পে নেয়া হয়েছে।
এদিকে ১ আগস্ট ভূমধ্যসাগর থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বহনকারী কাঠের নৌকা থেকে বাংলাদেশীসহ ৩৯৪ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করা হলেও তাদের কোথায় নেয়া হয়েছে সে ব্যাপারে গতকাল লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানাতে পারেননি।
গতকাল দুপুর (বাংলাদেশ সময়) ১টার দিকে লিবিয়ার ত্রিপোলি দূতাবাসে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর আসাদুজ্জামান কবিরের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি তাতে সাড়া দেননি। বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মেজর জেনারেল এস এম শামিম উজ জামান।
জানা যায়, উদ্ধার অভিযানে জার্মানি ও ফ্রান্সের দু’টি দাতব্য উদ্ধারকারী জাহাজ এসব অভিবাসন প্রত্যাশীদের উদ্ধার করেছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, উদ্ধারকৃতদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ, মরক্কো, মিসর এবং সিরিয়ার নাগরিক। তবে ঠিক কতজন বাংলাদেশী নাগরিক ওই নৌকায় উঠেছিলেন, সে ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো তথ্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
জার্মানি ও ফ্রান্সের বেসরকারি সংস্থা সি-ওয়াচ ৩ এবং ওশান ভাইকিংয়ের উদ্ধারকারী জাহাজ উত্তর আফ্রিকার উপকূল থেকে ৬৮ কিলোমিটার দূরে তিউনিশিয়ার জলসীমার ভেতরে তেল স্থাপনা এবং অন্যান্য জাহাজের কাছ থেকে সাগরে ভাসমান অবস্থায় তাদের উদ্ধার করেছে। সি-ওয়াচ ৩ ভূমধ্যসাগরে রোববার রাতের ওই অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছে। জার্মানির এই অলাভজনক সংস্থা মোট ১৪১ জনকে উদ্ধার করেছে। বাকিদের উদ্ধার করেছে ওশান ভাইকিংস। রাতে ছয় ঘণ্টার অভিযানে জার্মানির আরেক এনজিও রেসকিউ শিপের ইয়াট নাদির সহায়তা করেছে। সাগরে ভাসমানদের মধ্যে কারো মৃত্যু অথবা কেউ আহত হয়েছেন কি না তা এখনো জানা যায়নি। নৌকাটির পাটাতন বাইরে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ব্যাপক ভিড় ছিল। নৌকাটি সাগরে যাত্রা শুরু করার পরপরই ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে।
আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি ঘটায় সম্প্রতি লিবিয়া তিউনিশিয়া থেকে ইতালি এবং ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পাড়ি দেয়ার প্রবণতা বাড়ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। ভূমধ্যসাগরে ছোট ছোট নৌকায় চেপে প্রায়ই ইউরোপের দেশ ইতালিসহ বিভিন্ন দেশের উদ্দেশে যাত্রা করে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা।
গতকাল লিবিয়ার ত্রিপোলি থেকে বাংলাদেশ কমিউনিটির একাধিক সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা এই দেশে বসবাস করছি। অভিবাসন নিয়ে গবেষণাও করছি। দেখেছি, গরমের মৌসুমে সাগর কিছুটা শান্ত থাকে। এই সুযোগে মানবপাচারকারী দলের সদস্যরা দলে দলে ট্রলারে বা নৌকায় করে লোক ইউরোপের ইতালি পাচারের চেষ্টা করে। কতজন যেতে পারে সেটি আমরা জানতে পারি না। তবে উদ্ধার হওয়ার তথ্য জার্মান এনজিও সি ওয়াচ ইন্টারন্যাশনাল ও অস্ট্রেলিয়ার নিউজ ব্লগ মাইগ্রেন্ট রেসকিউ ওয়াচের মাধ্যমে জানতে পারছি। তাদের দেয়া প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৩০ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ভূমধ্যসাগরের লিবিয়ার সাইডে এক হাজার এবং ইতালির সাইড থেকে এক হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী উদ্ধার হয়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, মূলত মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা একেকটি গ্রুপে বিভক্ত। কেউ বাংলাদেশ থেকে ভিজিট ভিসা করিয়ে দুবাই পর্যন্ত নিয়ে আসছে। এ পর্যন্ত এক গ্রুপের দায়িত্ব। সেখান থেকে পরিস্থিতি বুঝে ভিসা বানিয়ে লিবিয়ায় আনছে এক গ্রুপ। আরেক গ্রুপ লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল বেনগাজি সীমান্ত থেকে পশ্চিমাঞ্চল সীমান্ত আনার দায়িত্ব পালন করছে। কারণ সেখান থেকে ত্রিপোলির সীমান্ত দিয়ে ইতালি যাওয়ার দূরত্ব অন্য সীমান্ত থেকে কম। আবার ত্রিপোলির পশ্চিমাঞ্চল শহর জোয়ারা এবং সাব্রাতা (ট্রলার ছাড়ার স্থান) থেকে ইতালি সীমানায় পাঠানো পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছে আরেক গ্রুপ। মূলত এটা একটা বিশাল মানবপাচারকারী চক্র। সাগরের দিকে যারা দায়িত্ব পালন করে তাদের সাথে ইতালির নৌবাহিনী কোস্টগার্ডের একটা লিয়াজোঁ থাকে বলে শুনছি।
তাদের জানা মতে, ত্রিপোলি সীমান্ত থেকে ইতালির উপকূলে পৌঁছাতে ১০ ঘণ্টারও বেশির সময় লাগে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নৌকার চালক ভুল পথে চলে গেলে তখন সময় আরো বেশি লাগে। একজন অভিবাসীকে সাগরপথে পাড়ি দিতে কমপক্ষে লিবিয়ান দুই হাজার দিনার (এক দিনার সমান ১৮ টাকা) খরচ করতে হয়। যা বাংলাদেশী টাকায় ৩৬ হাজার টাকা।
উদ্ধার হওয়া অভিবাসীদের ডিটেনশন ক্যাম্পে নেয়ার পর সেখান থেকে কি করা হয় জানতে চাইলে ওই অভিবাসন বিশ্লেষকরা নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের দূতাবাসের মাধ্যমে দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয় তাদের। অনেকে যায়। যারা রাজি হয় তাদের বিমান টিকিটসহ ফ্রিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)। আবার অনেকে ক্যাম্পের দায়িত্বশীল লিবিয়ানদের সাথে চুক্তি করে (কমপক্ষে দুই লাখ টকা) মুক্তি পেয়ে থাকে। পরে আবারো তারা সুযোগ বুঝে ইউরোপে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে।
বাংলাদেশ থেকে কারা উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশীদের ইউরোপে পাঠানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, আমরা যতটুকু খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মূলত যারা অবৈধভাবে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইতোমধ্যে ইতালি পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে, তাদের দ্বারা এবং তাদের স্বজনদের দ্বারাই প্রলুব্ধ হয়ে বেশি লোকজন যাচ্ছে। তবে এর সাথে জড়িত রয়েছে দেশে-বিদেশের মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট। এদের চক্রকে শনাক্ত করতে হলে আগে গ্রামের দালালদের শনাক্ত করতে হবে বলেও তারা মন্তব্য করেন। উল্লেখ্য অবৈধভাবে ইউরোপ পাড়ি জমাতে গিয়ে বাংলাদেশীসহ বহু অভিবাসনপ্রত্যাশী সাগরে ডুবে মারা গেছে। অনেকের লাশ ভেসে গেছে। তারপরও থামছে না পাচার সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা। যদিও বাংলাদেশ থেকে কারা কারা পাচারের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে এমন প্রতিবেদন অতীতে লিবিয়ার দুতাবাস থেকে দেশের সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে। আর ওই প্রতিবেদনে ছিল পাচার বন্ধে নেয়া নানা সুপারিশও।