পেগাসাস কেলেঙ্কারিতে টাস্কফোর্স গঠন
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৩ জুলাই,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:১১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ইসরায়েলভিত্তিক গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা প্রযুক্তি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের উদ্ভাবিত সফটওয়্যার পেগাসাস ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিকদের ফোনে নজরদারি চালানোর ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর তা সামাল দিতে একটি ‘টাস্ক ফোর্স’ গঠন করেছে সেদেশের সরকার।
বুধবার (২১ জুলাই) এক প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্যের জাতীয় দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান এ তথ্য জানিয়েছে। ইসরায়েলের সরকারি কর্মকর্তা ও দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাত দিয়ে করা ওই প্রতিবেদনে গার্ডিয়ান জানিয়েছে, দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার বিভাগ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ও ইসরায়েলের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়েছে এই টাস্কফোর্স।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক এনজিও ফরবিডেন স্টোরিজ এবং দ্য গার্ডিয়ান, দ্য অ্যায়ারসহ ১৬ টি সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, এনএসও গ্রুপ থেকে এই স্পাইওয়্যার কিনে নিজের দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি চালিয়ে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন ‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকার।
পাশাপাশি অভিযোগ উঠেছে – এই কর্মকাণ্ডে বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী সরকারসমূহের সঙ্গে ইসরায়েলের সরকার ও দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাসমূহও যুক্ত। তবে ইসরায়েলের সরকার ও এনএসও গ্রুপ দৃঢ়ভাবে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
Dutch Bangla Bank Agent Banking
মঙ্গলবার (২০ জুলাই) দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গ্যান্তেজ ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক সাইবার সম্মেলনে, এনএসওর পেগাসাস প্রকল্পটি ‘খতিয়ে’ দেখছে দেশের সরকার।
এ সম্পর্কে সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমরা শুধুমাত্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে এসব সাইবার পণ্য বিক্রির অনুমতি দিয়েছি এবং এই অনুমোদনের প্রধান ও প্রাথমিক শর্ত হলো- অবশ্যই বৈধ ও আইনসম্মতভাবে এসব পণ্য ব্যবহার করতে হবে।’
ইসরায়েলের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, গোয়েন্দা নজরদারীভিত্তিক সফটও্যার পেগাসাস কোথাও বিক্রি করতে হলে অবশ্যই দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থাৎ সরকারের অনুমোদন নিতে হয়।
এছাড়া এ পণ্যটির ক্রয়-বিক্রয়বিষয়ক শর্ত অনুযায়ী, শুধু অপরাধীদের উপর নজরদারি চালাতে কোনো দেশের সরকার বা অনুমোদিত সরকারি সংস্থার কাছেই বিক্রি করা যাবে পেগাসাস। কোনো দেশের সরকারের বা সরকারি সংস্থার কাছে পণ্যটি বিক্রির আগে সংশ্লিষ্ট দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে ইসরায়েল সরকার।
সাইবার সম্মেলনে বক্তৃতায় গ্যান্তেজ আরও বলেন, ‘যেসব দেশ এ ধরনের ব্যবস্থা কিনেছে, তাদের অবশ্যই ব্যবহারবিধি মেনে চলতে হবে।’
এদিকে, পেগাসাস প্রকল্পের গোমর ফাঁস হওয়ার পর অন্যান্য ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় এর কী প্রভাব পড়বে এবং ইসরায়েলের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সাইবার অস্ত্র শিল্পখাতের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন দেশটির এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা ইসরায়েলের মারিভ নিউজকে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা আমাদের জন্য……আমরা পুরো ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করছি এবং ভবিষ্যতে এর যে ফলাফল হাজির হবে, তা কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে- সে উপায় বের করার চেষ্টা করছি।’
নবগঠিত এই টাস্কফোর্সের বিষয়ে মন্তব্য জানতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল দ্য গার্ডিয়ানি, তবে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সম্প্রতি বিশ্বের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের গতিবিধির ওপর নজরদারী সংক্রান্ত একটি ডাটাবেইস আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক এনজিও ফরবিডেন স্টোরিজের হস্তগত হয়। পরে এই সংস্থা দুটি দ্য গার্ডিয়ানসহ ১৬ টি পত্রিকাকে এ তথ্য জানায়।
তারপর সবাই বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে এবং এই অনুসন্ধানের নাম দেওয়া হয় ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’। এ সম্পর্কে অ্যমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট স্পর্ষকাতর বিষয়ে সরকার নজরদারি করতেই পারে, কিন্তু এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে।’
‘আমাদের হাতে যেসব তথ্য আছে, তাতে দেখা যাচ্ছে- এখানে এ বিষয়ক কোনো আইন মানা হয়নি।’
ফাঁস হওয়া সেই ডাটাবেইসে ৫০ হাজারেরও বেশি ফোন নম্বর পাওয়া গেছে বলে গত রবিবার (১৮ জুলাই) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই নম্বরসমূহের কিছু ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষায় অর্ধেকের বেশিগুলোতে পেগাসাস সফটওয়্যারের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
ইতোমধ্যে একাধিক বিবৃতিতে এনএসওর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে ওই তালিকাটি শুধু নজরদারির জন্যই ব্যবহার করা হতো। তাদের বক্তব্য- তালিকার নম্বরগুলো একটি বৃহত্তর তালিকার অংশ যেখানে এনএসওর কর্মীরা তাদের গ্রাহকদের সঙ্গে অন্যান্য কাজেও যোগাযোগ করে থাকতে পারেন।
তবে তালিকা পর্যালোচনা করে বোঝা গেছে , যে যেসব ব্যক্তির ফোন নম্বর চিহ্নিত করা গেছে তাদের বিষয়ে এনএসওর গ্রাহক সরকারগুলোর আগ্রহ রয়েছে। তাদের মধ্যে এমনসব ব্যক্তিও রয়েছেন যাদের ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষায় এনএসওর ফোন-হ্যাকিং স্পাইওয়্যারের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে।
পেগাসাস প্রজেক্টের বিস্তৃত তদন্তে দেখা গেছে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সঙ্গে এনএসওর নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে, এবং ২০১৭ সালে ইসরায়েলের সরকার কোম্পানিটিকে তাদের হ্যাকিং টুল সৌদি আরবের কাছে বিক্রির চেষ্টা করতে অনুমতিও দিয়েছিল। যে বিক্রয় চুক্তির মূল্য কমপক্ষে সাড়ে ৫ কোটি ডলার বলে অনুমান করা হচ্ছে।
ভারত, হাঙ্গেরিসহ যে ১০টি দেশ এসএসওর স্পাইওয়্যার ব্যবহার করেছে বা করছে বলে ফরেনসিক বিশ্লেষণে প্রমাণ মিলেছে, তাদের সবার সঙ্গেই ইসরায়েলের বাণিজ্যিক বা কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে।
কোন কোন দেশের সরকারের কাছে এনএসও তাদের প্রযুক্তি বিক্রি করেছে তা নিশ্চিত না করলেও কোম্পানিটি জানিয়েছে ইসরায়েলের সরকারের সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সংস্থার অনুমোদনের পরই তারা প্রযুক্তি বিক্রির পথে আগায়।
পেগাসাস প্রজেক্টের সংবাদ প্রচারের ফলে ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেত নবগঠিত জোট সরকার শুরুতেই একটি কূটনৈতিক সংকটে পড়েছে। এই অনুসন্ধানের বেশিরভাগই তার পূর্বসূরি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
মঙ্গলবার জানা গেছে ফ্রান্সের পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া দে রুগির আইফোনেও পেগাসাস স্পাইওয়্যারের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে।
তবে এসএসওর একজন মুখপাত্র দাবি করেছেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, মন্ত্রী দে রুগি এবং অন্যান্য ফরাসি মন্ত্রীরা, যাদের ফোন নম্বর ওই ডেটাবেজে পাওয়া গেছে, কখনই পেগাসাসের লক্ষ্য ছিলেন না।
‘এটা এনএসওর গ্রাহকদের টার্গেট বা সম্ভাব্য টার্গেটদের তালিকা নয়।’- দাবি করেন ওই মুখপাত্র।
এনএসও জানিয়েছে যে তাদের গ্রাহক সরকারগুলো চুক্তির আওতায় শুধু অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বৈধ তদন্তের কাজে তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে, তবে তারা এও স্বীকার করেছে যে গ্রাহকরা হয়তো সফটওয়্যারের অপব্যবহার করেছে।
পেগাসাস প্রজেক্ট প্রকাশ হওয়ার পর একমাত্র প্রকাশ্য মন্তব্যে এনএসওর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী শালেভ হুলিও বলেন, ফাঁস হওয়া তথ্যউপাত্তের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তিনি সংশয় জানিয়ে যাবেন এবং ‘এর সঙ্গে এনএসওর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই’-বলে দাবি জানানো অব্যাহত রাখবেন।
তবে তিনি আরও জানিয়েছেন, যে খবরগুলো প্রকাশ হয়েছে তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এসব ঘটনা তদন্ত করে দেখবেন।
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান