avertisements 2

আফগান আকাশে তালেবান মেঘ

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ জুলাই,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:১৩ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪

Text

মাঝ আকাশে ঘুড়ি উড়ানোর আনন্দে আর উদ্বেলিত হবে না আফগান কিশোর। দেখা হবে না শখের কবুতর দৌড়। কিংবা মনের আনন্দে গলা ছেড়ে গাইতে পারবে না গান। বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে আফগান-জীবনে ভর শরিয়াহ শাসনের পুরোনো তালেবান মেঘ। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আফগান শাসনামলের কথা এখনো ভোলেনি তারা। আতঙ্ক-শঙ্কার সেই সময়ের কথা মনে পড়লেই এখনো শিউরে ওঠেন আফগানরা। টিভি দেখা, অভিনব চুল কাটা-এ রকম বেশকিছু শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞায় অসাড় হয়ে উঠেছিল আফগানদের জীবন। সেই স্মৃতি রোমন্থন করে এএফপিকে তাদের আতঙ্ক আর সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন কয়েকজন দুর্ভাগা আফগান।

মোহাম্মদ (৪০) ছিলেন কান্দাহারের পেশাদার সংগীতশিল্পী। জাপানি ইন্সট্র–মেন্টালে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বাল্যকালেই তার সংগীত ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল এশীয় ঘরানার বাদ্যযন্ত্র দিয়ে। স্মৃতি হাতড়ে জানালেন দুই দশক আগের কথা। খালি কণ্ঠে স্রষ্টার গুণগান ছাড়া অন্য কোনো গান গাওয়া যাবে না, তালেবানদের এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই বন্ধুদের সঙ্গে সংগীতের আড্ডায় ছিলেন তিনি। ঘরে ঢুকে পড়ল তালেবান কর্মকর্তারা। মোহাম্মদ বললেন, ‘আমি খুব ছোট ছিলাম বলে আমাকে বন্ধুদের তুলনায় কম শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তবু আমি তিনদিন উঠে দাঁড়াতে পারিনি। আমি খুব ভাগ্যবান ছিলাম। অন্য একটি গানের আসরে জাপানি ইন্সট্রুমেন্ট বাজানোর দরুন তার আঙুলগুলো কেটে দেওয়া হয়েছিল।

ছেড়ে যেতে হবে মাতৃভূমি : রাজধানী কাবুলের একটি ছোট্ট দোকানে বিউটিশিয়ানের চাকরি করেন ফরিদা। অনেক সুন্দর করে সাজানোই তার কাজ। আইল্যাশ, আইশ্যাডো, লিপস্টিক দিয়ে অলংকৃত করেন সাজতে আসা গ্রাহকদের। কিন্তু এখন তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কারণ, মহিলারা এখন আর ঘর থেকে বের হতে পারবে না। আগের শাসনামলে দেশজুড়ে থাকা শত শত বিউটি পার্লার নিষিদ্ধ করেছে তালেবানরা। আশঙ্কা প্রকাশ করে ২৭ বছর বয়সি ফরিদা বলেন, ‘ওরা (তালেবানরা) যদি ফিরে আসে, আমরা আমাদের স্বাধীনতা হারাব। নারীরা কাজ করুক, এটা ওরা চায় না। বাধ্য হয়ে আমাদেরকে এ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে হবে।

কালো মেঘে উড়ে না ঘুড়ি : প্রায় তিন দশক ধরে কাবুল মার্কেটের একটি দোকানে রং-বেরঙের ঘুড়ি বানানোর ব্যবসা করেন ৫৯ বছর বয়সি জেলগাই। এ কারণে নিজেকে সবসময় বাতাসের কাছাকাছি থাকা একজন মানুষ হিসাবে অহংকার করেন তিনি। এ ব্যবসার আয় দিয়েই মোটামুটি কেটে যাচ্ছে তার সংসার। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এ ব্যবসা চলছে তার পরিবারে। কিন্তু ঘুড়ি উড়ানো মানুষকে ধর্মকর্ম থেকে দূরে রাখে বলে তালেবানের আইনে এটি নিষিদ্ধ। তবু ব্যবসা কখনো বন্ধ করেননি

জেলগাই। নিষিদ্ধ সময়েও গোপনে ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি ধৈর্যের ফল পেয়েছি, ওরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আমার ব্যবসা আবার চাঙ্গা হয়েছে। হাজার হাজার ঘুড়ি উড়েছে আফগানিস্তানের নীল আকাশে।’ কিন্তু এখন? জেলগাই বলেন, ‘কালো মেঘ’। বললেন, ‘এ সময়ে ঘুড়ি উড়বে না। এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কয়েকশ পরিবারের জীবনে নেমে আসবে দুঃখ-দুর্দশা।’

ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার : অষ্টাদশী মনিজা তালাশ জানতেন, যে কাজ তিনি বেছে নিয়েছেন, এতে তালেবানদের লক্ষ্য হতে পারেন তিনি। কিন্তু কিছু করার নেই। একজন খ্যাতনামা ব্রেকডান্সার মনিজা। কাবুলে ছেলেদের একটি দল হাজরার একমাত্র মহিলা সদস্য তিনি। তবে বেশ গোপনে। কয়েক বছর আগে মেয়েটির বাবা হারিয়ে গেছে। সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে তার মায়ের। মাকে

সহযোগিতা করতেই এ কাজে নেমেছেন তিনি। বলেন, ‘আমি তো আর অন্য কোনো কাজ জানি না।’ অলিম্পিকে আফগানদের প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন দেখেন হাজরা সম্প্রদায়ের এ সদস্য। তিনি বলেন, ‘তালেবানদের আইন যদি আগের মতোই

থাকে, এখনো যদি তারা নারীদের ঘরের ভেতর তালাবদ্ধ করে রাখতে চায়, তাহলে আমার মতো লাখ লাখ আফগান নারীর জীবনে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। তবু আমি এ কাজ ছাড়ব না।’

শেষ হয়ে আসছে সিসা পানের দিন : জালালাবাদ শহরের পূর্বদিক দিয়ে বয়ে গেছে ছোট একটি নদী। তার পাড়ে বসেই বন্ধুদের সঙ্গে সিসা পান করছে মোহাম্মদ সেলিম। তিনি বলেন, ‘আজকের যুগে আফগানিস্তানে সিসা পান খুবই সাধারণ বিষয়। ধরুন, হুক্কার মাধ্যমে আমরা ফলের সুগন্ধযুক্ত তামাক খাচ্ছি। এই আর কী!’ কিন্তু তালেবানদের ভাষায় (ইসলামি শরিয়াহ মতে) এটি মাদক। তালেবানদের ক্ষমতাচ্যুতির পর এ ব্যবসার প্রসার ঘটেছে। ক্যাফে মালিকদের মতে পাইপের মাধ্যমে ‘জাফরান-চা’ সরবরাহ করছেন তারা। ক্যাফে মালিক বখতিয়ার আহমাদ বিশ্বাস করেন, যুবক-যুবতীদের ঘরের ভেতর ধরে রাখার উত্তম উপায় এটি। তিনি বলেন, ‘এখানে শান্তি আছে। সিসা পানের পাশাপাশি এখানে সংগীতেও বুঁদ হয়ে থাকেন ভোক্তারা।’ তবে, ভবিষ্যতের শঙ্কায় পড়ে গেছেন সেলিম। তিনি বলেন, ‘নদীর পাশে বসে পিকনিক করে সিসা পানের দিন শেষ হয়ে আসছে।’

তরুণরা এখন ফ্যাশন সচেতন : আফগানিস্তানের পশ্চিমা শহর হেরাত। এখানেই মোহাম্মদ গাদেরির সেলুন। তিনি তরুণদের পছন্দমাফিক তারকার ছাঁচে চুল কেটে দিতে সিদ্ধহস্ত। শাহরুখ-সালমান থেকে শুরু করে ডোয়েইন জনসন (রক) কিংবা আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের চুলের কাটিং তার মুখস্থ। তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছরে মানুষের চুল কাটার স্টাইল বুঝিয়ে দিচ্ছে আফগানিস্তান নতুন বিশ্বে প্রবেশ করেছে। তরুণরা চুলে স্টাইল করতে শিখেছে। তাদের ফ্যাশন সচেতনতার কারণে, এ পেশায় লোকজনও আসতে শুরু করেছেন। আবার এখনকার সরকারও তালেবানদের মতো এ কাজের বিরুদ্ধে নয়।’ চুল কাটাতে আসা সানাউল্লাহ আমিন বলেন, ‘২০ বছর আগের তালেবানরা বদলেছে বলে আমার মনে হয় না। সামনের দিনগুলোতে নারীরা তো অবশ্যই, পুরুষরাও স্বাধীনতা হারাবে।’

মরলেও এ দেশ ছেড়ে যাব না : স্থানীয়ভাবে মাদকাসক্তদের ‘মা’ বলে খ্যাত লায়লা হায়দারী। মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রের মাধ্যমে আফগান নেশাগ্রস্ত তরুণদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সফল একজন মানুষ। তালেবানরা ক্ষমতায় ফিরে এলে তার জীবন হবে হুমকির সম্মুখীন। তাই পরিবারের লোকজন এবং বন্ধুরা তাকে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যেতে বলছেন। তিনি বলেন, ‘না, মরে গেলেও আমি এদেশ ছেড়ে যাব না। ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। আমি ভয় করি না।’ লায়লা জানান, মাদকাসক্তরা তালেবানদের চোখে মারাত্মক অপরাধী। বিচারের আওতায় এনে ওদের শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু ওদের অসুস্থতার কথা মাথায় রাখে না তারা। তিনি বলেন, ‘ওদের এভাবে রেখে আমি চলে যেতে পারি না।’ মাদকবিরোধী বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশই মাদকাসক্ত। এমনকি মাদক সেবনকারীদের মধ্যে ৪ থেকে ৬ শতাংশই কঠোর উত্তেজকে আসক্ত। ইরানে বেড়ে ওঠা হায়দারীর বিয়ে হয়েছিল ১২ বছর বয়সে। এর এক দশক পরেই তাকে তালাক দেন তার স্বামী মোল্লা। অগত্যা তাকে ফিরে আসতে হয় আফগানিস্তানে। এসেই আবিষ্কার করেন তার ভাই হাকিমকে, যিনি হেরোইনে আসক্ত ছিলেন। কোনোমতে কাবুলের একটি সেতুর নিচে দিন-রাত কাটত ওই যুবকের। এই অবস্থাতেই জীবন্মৃত ভাইকে আসক্তিমুক্ত করতে শুরু হয় তার সংগ্রাম। সে সময় প্রায় পাঁচ হাজার মাদকাসক্ত যুবকের সন্ধান পান লায়লা, যাদের বয়স ১৫ থেকে ১৮ বছর। হাকিমসহ বহু যুবককে ওই পথ থেকে ফিরিয়ে এনে ‘মাদকাসক্তদের মা’ নামধারণ করেন তিনি।

আমি কি আর বাঁচব : নিখুঁত হাতে নিজের প্রতিকৃতি। স্থান পেয়েছিল একটি প্রদর্শনীতে। প্রশংসিত আলোকচিত্রী রাদা আকবর বুঝিয়ে দিয়েছেন শিল্প-সংস্কৃতির কোনো অংশেই পিছিয়ে থাকতে চান না আফগান নারীরা। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে তারা আবারও মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ে আতঙ্কে রয়েছেন। ৩৩ বছর বয়সি এই শিল্পী এখন প্রদর্শনী করে যাচ্ছেন অনলাইনে। আফগানিস্তানে এরইমধ্যে মিডিয়া কর্মী, বিচারক এবং নেতাকর্মীসহ হাইপ্রোফাইল ১৮০ নারী খুন হয়েছেন। আফগান সরকার ধারণা করছে, এসব মৃত্যুর পেছনে তালেবানদেরই হাত থাকতে পারে। রাদা আকবর বলেন, ‘আমরা সংখ্যালঘু হিসাবে লড়াই করে যাচ্ছি। আমাদের কয়েকজনকে মেরে বাকিদের চুপ থাকতে বাধ্য করতে চায় তারা।’ মেক্সিকান নারীবাদী শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর অনুসারী রাদা আরও বলেন, ‘তারা বলতে চায়, আফগানিস্তানে আপনাদের (নারীদের) কোনো জায়গা নেই।

আমি সবই হারাতে চলেছি : নারী আশ্রয়কেন্দ্রের পুরোধা ব্যক্তি মেরি আকরামি। বিভিন্ন সহিংসতা থেকে বেঁচে যাওয়া নারী যারা তার পরিবারে ফিরে যেতে আগ্রহী নন এদের পুনর্বাসনের জন্যেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীদের পরিবারে ফিরিয়েও দিয়েছেন তিনি। নারী অধিকার পুনরুদ্ধারে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া এই নারীও আতঙ্কে রয়েছেন। তালেবানরা এলে মেরি আকরামির সংস্থাসহ এ ধরনের সব কর্মকাণ্ডই ধ্বংস করে দেবে বলে তাদের ধারণা।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2