দিল্লির চিঠি : বাংলাদেশকে বেশি প্রয়োজন ভারতের
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১:০৭ পিএম, ৭ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২০ | আপডেট: ০২:৪৫ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর পররাষ্ট্রনীতির রূপায়ণের প্রশ্নে ভারতের অবস্থান নিয়ে সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন। গত বৃহস্পতিবার দিল্লিতে বইটি ভার্চুয়ালি মুক্তি পেল অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে। এই বই জয়শঙ্কর আসলে লিখেছিলেন সচিব পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর। তখন তো তিনি জানতেনই না, তাঁকেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বইটি প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন। মন্ত্রী হিসেবে যে কথা বলা অনুচিত, ধরে নেওয়া যায় সেগুলো তিনি সচেতনভাবে পরিহার করেছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মনে করে, চীন সম্পর্কে অনেক কথাই তিনি এই বইয়ে খোলাখুলি লিখতে পারেননি। যেভাবে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব, সাবেক রাষ্ট্রদূতরা খোলাখুলি চীন নিয়ে বলতে পারেন। চীন নিয়ে সত্য স্বীকারোক্তি না থাকলেও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব এবং এই সার্বভৌম রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বন্ধন দৃঢ় করা যে এখন খুব জরুরি, সে কথা তিনি বলেছেন।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স আয়োজিত ‘ব্রড ক্যানভাস অব ইন্ডিয়ান ডিপ্লোমেসি ডিউরিং দ্য প্যানডেমিক’ শীর্ষক আলোচনায় গত শুক্রবার পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হলো, ‘প্রথমে প্রতিবেশী’ নীতি। যেটা বলেননি তিনি তা হলো, এই মুহূর্তে চীন ও পাকিস্তান যৌথ অক্ষ ভারত-চীন সীমান্তে নতুন করে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে—এমনটাই খবর দিচ্ছে ভারতীয় গোয়েন্দারা। বিপিন রাওয়াত হুংকার দিচ্ছেন আমরাও কম যাই না। ভারতকেও চীনবিরোধী আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। মস্কোয় গিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং চীনা প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। মস্কোর মনও বুঝতে চাইছেন। এমন অবস্থায় চীন, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার সবার চেয়ে বেশি প্রয়োজন বাংলাদেশকে, এটা বোঝার জন্য পিএইচডি করার প্রয়োজন হয় না।
এদিকে কি ভারত, কি বাংলাদেশ—দুই দেশেই সংবাদমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী প্রচার শুরু করে দিয়েছে যে চীন এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধকের জন্য ঢাকায় ট্রায়াল করার প্রস্তাব দিয়েছে শেখ হাসিনা সরকারকে। ট্রায়ালে ঢাকা রাজিও হয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের এত বড় বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও ভারত কিছুই তো করছে না! ভারতে প্রচার চালানো হচ্ছে, ঢাকা গোপনে চীনের সঙ্গে আঁতাত করে ফেলেছে। কোনো এক ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছে, হাতি কাদায় পড়লে ব্যাঙেও লাথি মারে। আবার বাংলাদেশের সংবাদপত্রে লেখা হচ্ছে, ঢাকার জন্য ভারত এই করোনা সংকটে কী সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে? বরং চীন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরকে বুঝতে হবে ঠিক এ পটভূমিতেই। আর এই সফরের পর দেশে ফিরে এসে ভারতে মোদি সরকারের মন্ত্রিসভা গত বৃহস্পতিবারই বৈঠক ডেকে করোনা প্রতিষেধক সর্বপ্রথম ঢাকাকে দেওয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। মন্ত্রিসভায় দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তিপত্রকে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, যাতে বলা হয়েছে প্রতিষেধক আসার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত তা বাংলাদেশকে দেবে। যদি অক্সফোর্ড বা অন্য যেকোনো সংস্থা, যেকোনো দেশ এই প্রতিষেধক ভারতকে দেয়, তাহলে ভারতের ইনস্টিটিউট অব সিরামোলজি তার কাউন্টার পার্ট হিসেবে সেগুলো দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে পাঠিয়ে দেবে। ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে তা বণ্টন করা হবে। সরকারি মধ্যস্থতাতেই হবে।
বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কভিড প্রতিষেধক দেওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশকে ভারত বলেছে ‘স্ট্র্যাটেজিক’ অংশীদার। কূটনীতিজগতের মানুষ জানেন, স্ট্র্যাটেজিক শব্দটি এখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস কভিড ভ্যাকসিনের জন্য ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে। অন্যদিকে চীনা ভ্যাকসিনের সঙ্গে ঢাকা কোনো চুক্তি করেনি এখনো। শুধু ট্রায়াল চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো ফার্মের সঙ্গে ওই ভ্যাকসিনের ব্যাপারে কোনো চুক্তিই কিন্তু হয়নি।
এখানে বাংলাদেশের পাঠকসমাজকে মনে করিয়ে দিই, মোদি ও জয়শঙ্করের নির্দেশে শ্রিংলা করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই যে ঢাকায় যান, হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন, সেখানে কভিড ভ্যাকসিন নিয়ে সবিস্তার আলোচনা হয়। এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির খসড়া এই বৈঠকে চূড়ান্ত হয়। এই চুক্তিতে দুই দেশের মধ্যে সাবেকি বন্ধুত্বের জয়গান আবার সূচিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়ে যে দ্বিপক্ষীয় বন্ধুত্বের যাত্রাপথ শুরু, আজও তা অব্যাহত।
খুব শিগগির ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শ্রিংলা যাচ্ছেন মিয়ানমারে। তিনি ঢাকায় শেখ হাসিনাকে আশ্বাস দিয়েছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানেও ভারত এই স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কের গুরুত্ব মাথায় রাখবে। এবার সমস্যা সমাধানে ভারত সক্রিয় ভূমিকা নেবে। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে ঘরোয়া (informal) পদ্ধতিতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেবে। এরপর ভারত এই সমস্যা উত্থাপন করবে সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সময়। করোনার জন্য সব বাধা-নিষেধ মানা হলেও এই অধিবেশন করা জরুরি। শ্রিংলা পররাষ্ট্রসচিব হয়েই ঢাকায় গিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ রুটের কথা, যাতে ঐকমত্য গড়ে ওঠে। এ ব্যাপারে ভারত বিশেষভাবে সক্রিয়। তবে মিয়ানমারের সঙ্গে ভারত তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে অবশ্য কোনোভাবেই নষ্ট করতে চায় না। এ অবস্থায় বাংলাদেশ চাইছে মিয়ানমারে গিয়ে পররাষ্ট্রসচিব, মানে ভারত সরকার যেন এমন কোনো বিবৃতি বা প্রকাশ্য বক্তব্য না দেয়, যাতে বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বার্থে আঘাত লাগে। এখন শ্রিংলার মিয়ানমার সফরের প্রস্তুতি পর্ব চলছে দিল্লিতে, পুরোদমে। মিয়ানমার সীমান্ত পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন্য চীন নানা প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। আজ হঠাৎ নয়, অনেক দিন থেকেই। মিয়ানমারে ভোট আসছে নভেম্বরে। মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভারতের জন্য জরুরি। শ্রিংলার মিয়ানমার সফর অবশ্য কিছুদিনের জন্য পিছিয়েছে।
সম্প্রতি চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কা সরকার যেভাবে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে, তা বাংলাদেশ সরকার দেখছে। ২০১৭ সালে মার্চেন্ট পোর্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের সঙ্গে যে ৯৯ বছরের লিজ চুক্তি করেছিল শ্রীলঙ্কা, তার জন্য নেয় ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এক্সিম ব্যাংক অব চীনের শর্তাবলিতেও বেশ প্যাঁচে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। পুরনো ঋণের ফাঁদ থেকে বেরোতে শ্রীলঙ্কাকে আরো বেশি ঋণ নিতে হয়েছে। এবার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের জন্য ৫০০ মার্কিন ডলার ঋণ নিতে হয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। ব্যালান্স অব পেমেন্টের অবস্থা খুবই খারাপ সে দেশে। তাই বাংলাদেশও চীনের ফাঁদে পা না দিয়ে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্বেই আস্থা রাখছে। তাই সাধু সাবধান! গুজব, অপপ্রচার কি ভারত, কি বাংলাদেশ—দুই দেশেই বড় ভয়াবহ চেহারা নেয়।
ঢাকা-দিল্লি-কলকাতা সর্বত্র লেখালেখি। ঢাকার টেলিভিশনের টক শো মধ্যরাতে গোলটেবিল-লম্বাটেবিল সেমিনার, শেখ হাসিনার ‘ভালোর পসরা’ শীর্ষক নিবন্ধে পড়েছি সামরিক শাসনের সময় এই ‘আরো ভালো চাই’-এর দলের কলমের কালি আর রিফিল শুকিয়ে যায়।
আমরা সবাই চাই, গণতন্ত্র দুই দেশেই দীর্ঘজীবী হোক। বিশেষত করোনা বা কভিড-১৯ দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। ভারত যে জিডিপির মুখে, তা ১৯৪৭ সালের পর এই প্রথম এতটা খারাপ। এই অবস্থায় চীন-ভারত উত্তেজনা বৃদ্ধিও কিন্তু কোনো কাজের কথা নয়। আর এই সময়ে মিথ্যা প্রচার বিপজ্জনক। হাসিনা সরকারের প্রতি ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ব্রিটিশ ভারতের অংশ হিসেবেও এই দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুপ্রতিম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক সাহায্যের (ঋণ ও অনুদান) এক নতুন ঐতিহ্য যুক্ত হয়।
আজ কভিড নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি তা সেই ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের যথার্থ উত্তরাধিকার।
বিশ্বায়নের যুগে কোনো রাষ্ট্রই ‘একা চলো’ নীতি গ্রহণ করতে পারে না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশ, নিরাপত্তা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ভৌগোলিক অবস্থান, এমনকি বহুমুখী প্রয়োজন এক রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্রের কাছে নির্ভরশীল করে তোলে। বাংলাদেশের মোট সীমান্তের ৭৮.৮৬ শতাংশ হলো ভারতের সঙ্গে। এই সীমান্তের তাৎপর্য অসীম। তাই বাংলাদেশকে স্ট্র্যাটেজিক অংশীদার বলে ভারত আবার এই সম্পর্কের সব ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে চাইছে। একই কারণে শ্রিংলাও ঘোষণা করেছেন, সব বকেয়া ইস্যু মীমাংসার চেষ্টা করবে ভারত। তাই গুজবে কান দেবেন না। সাধু সাবধান।