দিল্লিতে ব্লিঙ্কেন, আলোচনায় থাকবে পারে বাংলাদেশের নির্বাচন!

ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ‘টু প্লাস টু’ মন্ত্রী পর্যায়ের সংলাপে যোগ দিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বৃহস্পতিবারই দিল্লিতে পৌঁছেছেন। শুক্রবার (১০ নভেম্বর) ভারতের রাজধানীতে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।

এই বৈঠকের আগে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’- অর্থাৎ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কিভাবে আরো ‘মুক্ত, অবাধ, নিরাপদ ও সমৃদ্ধশালী’ করে তোলা যায়, সংলাপের একটা বড় অংশে তা নিয়ে আলোচনা হবে।

আর ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত জুন ও সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রেসিডেন্ট বাইডেন ভারত-মার্কিন অংশীদারিত্বের যে ‘ভবিষ্যৎমুখী রোডম্যাপে’র রূপরেখা দিয়েছেন- এই বৈঠকে দু’দেশের মন্ত্রীরা সেটাকেই আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

দিল্লি ও ওয়াশিংটনে বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, এই সংলাপে দুই স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার দেশ যেমন নিজেদের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলবে, তেমনি এশিয়া-প্যাসিফিকের বৃহত্তর পরিসরে সার্বিক স্ট্র্যাটেজিক ইস্যুগুলোও আলোচনায় উঠে আসবে।

আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, সেই পটভূমিতে ভারত-মার্কিন আলোচনায় বাংলাদেশ পরিস্থিতিও ছায়াপাত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আলোচনায় আসবে কি-না, তা নিয়ে দিল্লি বা ওয়াশিংটন কারো পক্ষ থেকেই নির্দিষ্টভাবে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভারত অবশ্য বলেছে, ‘আঞ্চলিক ইস্যু’গুলো নিয়ে অবশ্যই এই বৈঠকে কথাবার্তা হবে। প্রসঙ্গত, ‘টু প্লাস টু’-র পর দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও দুই প্রতিরক্ষামন্ত্রীও নিজেদের মধ্যে আলাদাভাবে বৈঠকে বসবেন।

তবে এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক ‘ইনপুট’ দিতে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা ইতোমধ্যেই দিল্লি পৌঁছেছেন বলে জানা গেছে। দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কূটনীতিবিদরাও যথারীতি এই বৈঠকের গতিপ্রকৃতির দিকে যথারীতি সতর্ক নজর রাখছেন।

তবে দিল্লিতে ভারতের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আলোচনায় বাংলাদেশ অবশ্যই আসবে, কিন্তু সেটা মেইন কোর্সের অংশ হিসেবে নয়।’ তিনি জানান, ‘শুক্রবারের মেনুতে এটাকে সাইড ডিশ বা ডেজার্ট বলা যেতে পারে, যদিও সেটার গুরুত্ব মোটেই কম নয়!’

ডোনাল্ড লু-এর বিশেষ ব্রিফিং
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এই মুহূর্তে এশিয়াতে একটি লম্বা সফরে রয়েছেন, এতে তিনি মোট ছয়টি দেশে সফর করছেন। ইসরাইল, জর্ডন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার পর তিনি সবার শেষে পৌঁছেছেন ভারতে।

সফরের ভারত অংশটুকুতে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনও ব্লিঙ্কেনের সাথে যোগ দিচ্ছেন, যেখানে তারা দু’জন মিলেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে ‘টু প্লাস টু’ ডায়ালগে বসছেন।

ভারত-মার্কিন আলোচনার এই কাঠামোটি ২০১৮ থেকে শুরু হয়েছে, আর প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে দ্বি-পক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলেও মনে করা হয়।

ব্লিঙ্কেনের এই সফরের ঠিক আগে মধ্য এশিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ওয়াশিংটনে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ভারত-মার্কিন আলোচনার মূল ফোকাসটাই হবে ‘এশিয়া-প্যাসিফিক’।

এশিয়া-প্যাসিফিক হচ্ছে একটি ‘বায়ো-জিওগ্রাফিক্যাল’ (জৈব-ভৌগোলিক) এলাকা, যার মধ্যে সমগ্র ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পশ্চিম ও মধ্যভাগ।

যে সাউথ চায়না সি-এর (দক্ষিণ চীন সাগর) প্রায় পুরোটাই চীন নিজেদের বলে দাবি করে থাকে, সেটাকেও এই এশিয়া-প্যাসিফিকের অংশ বলেই ধরা হয়।

ফলে এশিয়া-প্যাসিফিক নিয়ে যে কোনো আলোচনা চীনের প্রসঙ্গ আসবে অবধারিতভাবে, আর লু-ও জানিয়েছেন এই অঞ্চলে চীনের ভূমিকা ও সক্রিয়তা নিয়ে দু’দেশেরই পরস্পরের কাছ থেকে জানার আগ্রহ থাকবে।

তিনি বলেন, ‘যেমন সীমান্তে অচলাবস্থা নিয়ে নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে যে আলোচনা চলছে তাতে কতদূর কী হলো, সেটা নিয়ে অবশ্যই ওয়াশিংটন জানতে চাইবে।’

ডোনাল্ড লু আরো বলেন, ‘আবার আমি নিশ্চিত আমাদের ভারতীয় কাউন্টারপার্টরাও (চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ওয়াং ইয়ি-এর মার্কিন সফর নিয়ে জানতে চাইবেন। অ্যাপেক সামিটে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও প্রেসিডেন্ট শি-এর মধ্যে আগামী সপ্তাহে যে দেখা হবে, সে বিষয়েও নিশ্চয় তারা প্রশ্ন করবেন।’

এছাড়াও ‘ইসরাইল-হামাস সঙ্ঘাত’ এবং ‘ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ’ নিয়েও অবশ্যই দু’দেশ কথা বলবে বলেও জানানো হয়েছে।

বৈঠকে দু’দেশের চার মন্ত্রী মিলে সার্বিকভাবে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি’ নিয়েও আলোচনা করবেন বলে ডোনাল্ড লু মন্তব্য করেছেন, কিন্তু এই প্রসঙ্গে কোনো বিশেষ দেশের নাম তিনি উল্লেখ করেননি।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) বিশেষজ্ঞ রিক রসো মনে করেন, ভারত-মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ইস্যুগুলোর প্রভাবই কিন্তু বেশি থাকবে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘গাজা বা ইউক্রেনের যুদ্ধের চেয়ে বাংলাদেশ কিংবা শ্রীলঙ্কায় কী ঘটছে, সেটাই কিন্তু ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ!’

নির্দিষ্ট কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেমন ধরুন বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সাথেও দু’দেশ আলাদাভাবে কথা বলছে। ওদিকে মালদ্বীপে একটি নতুন চীনপন্থী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। অস্থিরতার আশঙ্কা আছে শ্রীলঙ্কা বা নেপালে। ভারতের কাছে এই ইস্যুগুলোর গুরুত্ব অনেক বেশি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অনেক সরাসরি যুক্ত।’

অর্থাৎ তিনি মনে করছেন সার্বিক আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারত-মার্কিন বৈঠকে আলোচনা হলেও ভারতের কাছে ‘ঘরের পাশে’ বাংলাদেশের মতো ইস্যুগুলোই বেশি প্রাধান্য পাবে।

দিল্লিতে কূটনীতিক বিশ্লেষক ও থিঙ্কট্যাঙ্ক ওআরএফের সাবেক ফেলো শশাঙ্ক মাট্টু আবার মনে করেন, বাংলাদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যুতে ভারত কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘সঙ্ঘাতে’ যেতেও দ্বিধা করছে না।

তার মতে, ‘এর কারণটাও খুব সহজ, যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এই অঞ্চলে ভারতের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পার্টনারকে হুমকির মুখে ফেলেছে।’

তিনি আরো জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর যেন ‘খুব বেশি চাপ’ প্রয়োগ না-করা হয়, সে ব্যাপারেও ভারত কিন্তু ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়েছে।

শশাঙ্ক মাট্টুর ভাষায়, ‘ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শেখ হাসিনাই হলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। অন্য দিকে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সাথে ভারতের সম্পর্ক মোটেই সহজ নয়। তিনি যদি কোনো কারণে আসন্ন নির্বাচনে পরাজিত হন তাহলে ভারতের গোটা নেইবারহুড পলিসিই সঙ্কটের মুখে পড়বে।’

অর্থাৎ দিল্লির কূটনীতিক পর্যবেক্ষকদের একটা অংশ মনে করছেন, দিল্লি নিজেদের স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের আলোচনায় বাংলাদেশের প্রসঙ্গ তুলবে।

ভারতের বক্তব্য
বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) সন্ধ্যায় দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি জানিয়েছেন, ভারত-মার্কিন সংলাপে কী কী বিষয়ে আলোচনা হবে তা তিনি ‘প্রি-জাজ’ করতে চান না- অর্থাৎ আগে ভাগে সেটা অনুমান করতে চান না।

তিনি বলেন, ‘তবে আমাদের দু’দেশের সম্পর্কের যা গভীরতা, তাতে ধরেই নেয়া যায় সব ধরনের সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ও আঞ্চলিক ডেভেলপমেন্টগুলো নিয়ে এই বৈঠকে কথাবার্তা হবে।’

তবে ‘টু প্লাস টু’ ডায়ালগ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে এর আগে বলা হয়েছে, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা খাতে দু’দেশের সম্পর্কে কতটা অগ্রগতি হলো, এই বৈঠকে তারই একটা ‘হাই লেভেল রিভিউ’ (উচ্চ পর্যায়ের পর্যালোচনা) করা হবে।

এছাড়া ‘টেকনোলজি ভ্যালু-চেইন কোলাবরেশন’ এবং দু’দেশের মানুষে-মানুষে-সম্পর্ক (পিপল টু পিপল কনট্যাক্ট) বৃদ্ধির ওপরেও এই বৈঠকে জোর দেয়া হবে বলে দিল্লির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

তবে এদিনের ব্রিফিংয়েই অন্য একটি প্রশ্নের জবাবে অরিন্দম বাগচি জানান, বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া বা রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারত কোনো মন্তব্য করতে চায় না।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন একান্তভাবেই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরা তৃতীয় কোনা দেশের নিজস্ব নীতি নিয়ে মন্তব্য করি না, এখানেও করতে চাই না।’

তিনি যোগ করেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ নিজেরাই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন। ঘনিষ্ঠ মিত্র ও পার্টনার হিসেবে আমরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মর্যাদা দেই। একই সাথে একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে ভিশন, সেটাকেও আমরা সমর্থন জানিয়ে যাব।’