ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি কেন বারবার আরব দেশ সফর করছেন
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৬ জুলাই,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৩:৪৪ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ফ্রান্সের পর এবার সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর শেষ করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শনিবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ানের সাথে আলোচনার পর তিনি ভারতীয় রুপি ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুদ্রা দিরহামে ব্যবসা করার ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদি আশা প্রকাশ করেছেন যে শিগগিরই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৮৫ বিলিয়ন থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। দুই দেশের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্যের ঘোষণা ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর এটি নরেন্দ্র মোদির পঞ্চম সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর। গত কয়েক বছরে ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্কের মধ্যে অনেক উষ্ণতা দেখা দিয়েছে।
গত বছর যখন মোদি সংযুক্ত আরব আমিরাত পৌঁছেছিলেন, তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ানকে প্রোটোকল ভেঙে মোদিকে স্বাগত জানাতে আবুধাবি বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত নরেন্দ্র মোদিকে তার সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘অর্ডার অফ জায়েদ’ প্রদান করেছে।
আট বছরে মোদির পঞ্চম ইউএই সফর
নরেন্দ্র মোদি গত ৯ বছর ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে আছেন। এ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক জোরদারের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন।
মোদি যখন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তখন ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গাকে ঘিরে উপসাগরীয় দেশগুলোয় তার যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল ভারতের সাথে ওইসব দেশের সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
কিন্তু উল্টো তিনি উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক জোরদার করার পদক্ষেপ নিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। তিনি তার শাসনকালের আট বছরের উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন।
মোদি এ নিয়ে একাধিকবার সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউএইতে সফর করেছেন। দেশটিতে তার প্রথম সফর ছিল ২০১৫ সালে আগস্টে, দ্বিতীয়টি ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং তৃতীয়টি ২০১৯ সালের আগস্টে এবং চতুর্থটি ২০২২ সালের জুনে। বর্তমান সফরটি তার সংযুক্ত আরব আমিরাতে পঞ্চম সফর।
২০১৫ সালের আগস্টে মোদি যখন প্রথমবারের সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন, এটি ছিল ৩৪ বছরের ইতিহাসে কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ওই দেশে প্রথম সফর। মোদির আগে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেছিলেন।
২০১৭ সালে প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে মোদির পররাষ্ট্র নীতিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়ে মনোযোগ দেয়া হয়েছিল। সেই সময় মোহম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল মোদি সরকার। তখন মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন না, তখন তিনি ছিলেন আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স।
ঐতিহ্য অনুসারে ভারত তাদের প্রজাতন্ত্র দিবসে কোনো একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানায়। আল নাহিয়ান ওই পদে না থাকা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি এসেছিলেন।
ভারত-ইউএই সম্পর্কের তিনটি ভিত্তি
ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ইংরেজি বর্ণমালার তিনটি ই’র উপর ভিত্তি করে আছে। সেগুলো হলো- এনার্জি, ইকোনমি ও এক্সপ্যাট্রিয়েট অর্থাৎ জ্বালানি, অর্থনীতি ও জনশক্তি (প্রবাসী)।
গত অর্থ বছরে (২০২২-২৩), ভারতে অপরিশোধিত তেল সরবরাহকারী তৃতীয় বৃহত্তম দেশ ছিল ইউএই। ভারতের তেল আমদানিতে এর ১০ শতাংশ শেয়ার ছিল।
কিন্তু ভারত এখন ২০৩০ সালের মধ্যে ইউএই থেকে তেলের বাইরে অন্যান্য ব্যবসা ১০০ বিলিয়ন ডলারে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত বছর দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সিইপি (কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ) চুক্তি ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
গত এক দশকে ভারতের স্বাক্ষরিত এটিই প্রথম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। ২০১১ সালে ভারত জাপানের সাথে সর্বশেষ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল।
পারস্পরিক বাণিজ্য ৮৫ বিলিয়ন ডলার, লক্ষ্য ১০০ বিলিয়ন ডলার ভারত ২০২৭ সালের মধ্যে তার অর্থনীতির আকার পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে তার রফতানি এক ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়। সিইপি চুক্তি এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৯৭০-এর দশকে মাত্র ১৮০ মিলিয়ন ডলার ছিল, যা এখন ৮৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে ২০২১-২২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। আমেরিকার পর ভারত সবচেয়ে বেশি রফতানি করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত সঞ্জয় সুধীরের মতে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ভারতের বাণিজ্য এক বছরে ১৯ শতাংশ বেড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার বর্তমান সফরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের সাথে জ্বালানি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষাসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০২২ সালে সিইপি চুক্তির পর্যালোচনাও মোদি ও মোহাম্মদ বিন জায়েদের এজেন্ডায় ছিল।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ভারতের ব্যবসায়িক সম্পর্ক যে গতিতে বাড়ছে তা অনেক বিশ্লেষকের কাছেই বিস্ময়কর।
ইউএই ভারতে চতুর্থ বৃহত্তম বিনিয়োগকারী
ইউএই এখন ভারতে চতুর্থ বৃহত্তম বিনিয়োগকারী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে ভারতে দেশটির বিনিয়োগ তিন বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
২০২০-২১ সালে ভারতে এর বিনিয়োগ ছিল ১.০৩ বিলিয়ন ডলার। সে সময় ইউএই ছিল ভারতে সপ্তম বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ। অর্থাৎ মাত্র এক বছরে তিন ধাপ এগিয়েছে।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সের ফেলো এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ফাজজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, “ইউএই মোদি সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এবং স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়ার মতো সরকারের প্রচারাভিযানে বড় সম্ভাবনা দেখছে এবং সেগুলোয় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।”
তিনি দুই দেশের সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা হলো ভারতে ইউএই’র বিনিয়োগ ও ব্যবসায় একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। এটি একটি বড় ব্যাপার। কারণ আমরা অনেক দেশের সাথে ব্যবসায়িক চুক্তি করি, কিন্তু বিনিয়োগ ও ব্যবসার প্রসার দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
‘এই গতি বজায় রাখতে নরেন্দ্র মোদি বারবার সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করছেন। এটি তার পঞ্চম সফর,’ বলেন তিনি।
কেন ইউএই’র ভারতের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে?
সৌদি আরবের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাতও তার অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে চায়।
আরব আমিরাত চায় তেলভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরতা কমাতে। সে কারণেই দেশটি বিশ্বজুড়ে নতুন বিনিয়োগের জায়গা খুঁজছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত তার ‘সার্কুলার ইকোনমিক পলিসি’ নিয়ে কাজ করছে।
এটি ২০৩১ সালের মধ্যে দেশটি তাদের উৎপাদন খাত দ্বিগুণ করতে চায়। এ জন্য তারা ২.৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবেন।এর সাথে তারা বর্তমানে খাদ্য ব্যবসা, সবুজ অবকাঠামো এবং রিয়েল এস্টেট ব্যবসার দিকে মনোযোগ বাড়াচ্ছে।