জন্মহার বাড়াতে অর্থ খরচ করছে এশিয়ার কিছু দেশ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৮ মে,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৮:৩৭ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
জাপানের সরকার ১৯৯০ দশক থেকেই দম্পতিদের বেশি সন্তান নেয়ায় উৎসাহিত করার নীতি গ্রহণ করে। ২০০০ সালের পর দক্ষিণ কোরিয়াও একই নীতি নেয়। সিঙ্গাপুরে হ্রাস জন্মহার ঠেকানোর জন্য বিশেষ নীতি নেয়ার ইতিহাস আরো পুরনো। চীনও এখন একই পথ অনুসরণ করছে। কারণ ৬০ বছরের মধ্যে চীনেও প্রথমবারের মতো জনসংখ্যা কমতে শুরু করেছে।
জন্মহার বাড়ানোর নীতি কার্যকরী করতে এসব দেশ ঠিক কত খরচ করছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন, তবে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক-ইয়ল সম্প্রতি বলেছেন, জনসংখ্যা বাড়াতে তার দেশ গত ১৬ বছরে দুই হাজার কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ খরচ করেছে।
তবুও গত বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রজনন হার ছিল বিশ্বে সবচেয়ে কম। নারী প্রতি শিশু জন্মের হার ছিল মাত্র ০.৭৮। জাপানের অবস্থাও প্রায় একইরকম। গত বছর জাপানে আট লাখেরও কম শিশু জন্ম নিয়েছে। এক বছরে এত কম শিশুর জন্ম ওই দেশে আগে কখনো হয়নি।
জন্মহার বাড়াতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা শিশু-কল্যাণের বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়নে বর্তমানের ১০ ট্রিলিয়ন ইয়েন (সাত হাজার ৪৭০ কোটি ডলার) বাৎসরিক বরাদ্দ দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই অর্থ জাপানের জিডিপির দুই শতাংশেরও বেশি।
বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে তাদের জন্মহার কমাতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে কিছু দেশ জন্মহার বাড়াতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। জাতিসঙ্ঘের সর্বশেষ এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে এমন দেশের সংখ্যা তিনগুণ হয়েছে।
কেন কিছু দেশ জনসংখ্যা বাড়াতে মরিয়া
এক কথায় উত্তর- জনসংখ্যা বাড়লে কাজের জন্য বেশি লোক পাওয়া যাবে এবং এর ফলে পণ্য ও সেবার উৎপাদন বাড়বে। একই সাথে বাড়বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। জনসংখ্যা বাড়লে সরকারের খরচ বাড়ে ঠিকই, কিন্তু কর থেকে সরকারের আয়ও বাড়ে।
এশিয়ার অনেক দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। জাপানের জনসংখ্যার ৩০ ভাগের বয়স এখন ৬৫ বা তার বেশি। এশিয়ার আরো কিছু দেশের অবস্থাও কম-বেশি একইরকম।
অথচ জনসংখ্যার দিক দিয়ে যে দেশটি এখন চীনকে ছাড়িয়ে গেছে সেই ভারতের জনসংখ্যার ২৫ ভাগেরও বয়স দশ থেকে বিশের কোঠায়। ফলে, অনেক দেশের তুলনায় ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে এই জনসংখ্যা ভারতের জন্য ইতিবাচক হতে পারে।
যখন দেশে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা কমতে থাকে, তাদের দেখাশোনার জন্য রাষ্ট্রের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়।
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জুজিয়ান পেং বলেন, ‘জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি যদি নেতিবাচক হয়, তাহলে অর্থনীতির ওপর তার খারাপ প্রভাব পড়ে। একই সাথে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকলে অনেক দেশই বয়স্কদের দেখভাল করার ক্ষমতা হারায়।’
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জন্মহার বাড়ানোর জন্য নেয়া প্রণোদনামূলক নীতিমালা কম-বেশি একইরকম। নতুন মা-বাবার জন্য সরকার থেকে বাড়তি অর্থ, বিনামূল্যে বা খুব কম মূল্যে শিক্ষার সুযোগ, নার্সারি সুবিধার প্রসার যাতে কাজের সময় মায়েরা নিরাপদে বাচ্চা রাখতে পারে, নতুন মা-বাবার জন্য কর ছাড় এবং বাচ্চা হওয়ার পর লম্বা ছুটির সুবিধা।
কিন্তু এসব ব্যবস্থা কি কাজ করে?
জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে পাওয়া গত কয়েক দশকের পরিসংখ্যান বলে, জন্মহার বাড়াতে নেয়া বিভিন্ন নীতি খুবই কম কাজে দিয়েছে। সম্প্রতি জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের এক গবেষণা রিপোর্টে বলেছে, ‘নীতিগুলো ব্যর্থ হয়েছে।’
জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষণও প্রায় একইরকম।
জাতিসঙ্ঘ পপুলেশন ফান্ডের অ্যালানা আর্মিটেজ বলেন, ‘ইতিহাস থেকে আমরা জানি নীতিমালা দিয়ে জনসংখ্যা বাড়ানো-কমানোর কৌশল, প্রণোদনার লোভ দিয়ে নারীদের বেশি সন্তান নিতে উৎসাহিত করার কৌশল কাজ করে না। কেন নারীরা বেশি সন্তান নিতে চাইছে না তার অন্তর্নিহিত কারণগুলো আমাদের বুঝতে হবে। মূল সমস্যা হচ্ছে বেশিরভাগ সময়ই নারীরা তাদের কর্মজীবনের সাথে পারিবারিক জীবনের তাল রাখতে পারে না।’
জুজিয়ান পেংয়ের মতে, এশিয়ার চাইতে স্ক্যান্ডেভিয়ান দেশগুলোতে এসব নীতি অনেক বেশি কাজ করেছে। তিনি বলেন, ‘এর প্রধান কারণ ওই দেশগুলোতে সামাজিক সুরক্ষা অনেক ভালো, সন্তান মানুষ করার খরচ অনেক কম। নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে অনেক কম।’
এসব ব্যয়সাপেক্ষ নীতিগুলোর অর্থ কিভাবে আসবে তা নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে, বিশেষ করে জাপানের মতো দেশে যার সরকারি ঋণ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।
জনসংখ্যা বাড়ানোর তহবিল সংগ্রহে জাপানে যেসব বিকল্প ভাবা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত সরকারি বন্ড বিক্রি, বিক্রয় কর বাড়ানো বা সামাজিক বীমার প্রিমিয়াম বাড়ানো।
সরকারি বন্ড বিক্রির মান সরকারি ঋণ বৃদ্ধি, যার অর্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ। আর অন্য যে দুই বিকল্প বিবেচনা করা হচ্ছে তা গরীব জনসাধারণের ওপর চাপ তৈরি করবে, যার জেরে তাদের মধ্যে সন্তান নেয়ার ইচ্ছা আরো কমতে পারে।
কিন্তু ফ্রান্সের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইনসিডের অর্থনীতির অধ্যাপক আন্তোনিও ফাতাস মনে করেন এসব নীতি কাজ করুক আর না করুক এসব ব্যবস্থায় তহবিল যোগাতেই হবে।
তিনি বলেন, ‘হয়তো এগুলোতে জন্মহার বাড়ছে না, কিন্তু এসব ব্যবস্থা না থাকলে তখন কী হতো? হয়তো জন্মহার আরো কমতো।’
সহজ করা হচ্ছে অভিবাসন
ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যার জন্য অর্থনীতিকে প্রস্তুত করতে বিনিয়োগ করছে অনেক সরকার।
জুজিয়ান পেং বলেন, ‘শ্রমশক্তি কমতে থাকায় অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব কমাতে চীন প্রযুক্তি এবং বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনে প্রচুর বিনিয়োগ করছে।
রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের নীতিনির্ধারকরা তাদের অভিবাসন নীতি সহজ করার কথা চিন্তা করছেন যাতে বাইরের দেশ থেকে শ্রমিক আনা যায়।
তিনি বলেন, ‘পৃথিবী জুড়েই জন্মহার কমছে, ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে কাজের জন্য তরুণ-যুবক নিয়ে আসার প্রতিযোগিতা বাড়তে থাকবে।’
জন্মহার বাড়ানোর পেছনে টাকা খরচ করে কাজ হোক আর নাই হোক, দেশগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য বিকল্পও তেমন নেই।