ধ্বংসস্তূপে কমছে প্রাণের সাড়া
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৮ ফেব্রুয়ারী,
বুধবার,২০২৩ | আপডেট: ১১:২৩ এএম, ২৪ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
৭.৮ মাত্রার প্রথম ভূমিকম্পের পরদিন গতকাল মঙ্গলবারও বড় মাত্রার পরাঘাত অনুভূত হয়েছে তুরস্ক ও সিরিয়ায়। দুই দিনের টানা ভূকম্পনে ধসে পড়েছে প্রায় ছয় হাজার ভবন। তুরস্ক ও সিরিয়ার জরুরি বিভাগের কর্মীরা প্রাণপণে উদ্ধার অভিযানে ব্যস্ত। বিভিন্ন দেশ থেকেও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন হাজার হাজার উদ্ধারকর্মী। তবে তুরস্কে তীব্র শীত ও তুষারে ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার অভিযান। অন্যদিকে সিরিয়ায় যুদ্ধকবলিত অঞ্চলে উদ্ধারকাজ চলছে খুব ধীরগতিতে। তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।
তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্প থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষজন এখন খাদ্য ও শীতের পোশাকের অভাবে ভুগছে। অনেকের বাড়িঘর ধসে পড়েছে। আবার বাড়ি অক্ষত থাকলেও অনেকে পরাঘাতের ভয়ে ঘরে ফিরতে পারছে না। এতে তীব্র শীতের মধ্যেও বাইরেই থাকতে হচ্ছে প্রায় সবাইকে। দুর্গত মানুষের আশ্রয়ের জন্য তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে তিন লাখের বেশি তাঁবু সরবরাহ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময় গত রাত ১টা পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তুরস্কে নিহতের সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়েছে এবং সিরিয়ায় দেড় হাজারের বেশি বলে জানা গেছে। উদ্ধারকাজ ব্যাহত হওয়ায় মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সোমবার সাত দিনের জাতীয় শোক ঘোষণার পর গতকাল তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত ১০ প্রদেশে আগামী তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থার ঘোষণা দিয়েছেন।
গত সোমবার থেকেই তুরস্ক ও সিরিয়ায় উদ্ধারকাজ শুরু হয়েছে। তবে বৈরী আবহওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার তৎপরতা। দক্ষিণ তুরস্কের শহর আদানার সব মানুষ এখন গৃহহীন। অনেকের পায়ে জুতা নেই, গায়ে শীতের পোশাক নেই। অথচ আসন্ন দিনগুলোতে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। লোকে মোবাইল ফোনও চার্জ করতে পারছে না।
মহাসড়কে গাড়ি সামনের দিকে এগোতে পারছে না। উদ্ধারকারীদের অনেকে এখনো দক্ষিণ তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশে পৌঁছতে পারেনি। উদ্ধার অভিযানে দলগুলো বিশেষ সরঞ্জাম ও ভারী যন্ত্র নিয়ে যাচ্ছে। উদ্ধারকারীরা জানান, তাঁরা দ্রুত বেঁচে থাকা লোকদের সন্ধান শুরু করতে আগ্রহী। কিন্তু তাঁরা ঘটনাস্থলের ধ্বংসযজ্ঞ কতটা ভয়াবহ তা অনুমান করতে পারছেন না।
তুরস্কের সানলিউরফা শহরের ৪২ বছর বয়সী ইমাম কাগলার বলেন, ‘আমরা বাড়ি ফিরতে ভয় পাচ্ছি। এটি মোটেও নিরাপদ নয়।’
গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের মাহমুদ আল-আলি বলেন, ‘আমার শাশুড়ি, শ্বশুর এবং শ্বশুরের দুই ছেলে ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়ে আছেন। আমরা এখানে শীত ও বৃষ্টির মধ্যে বসে উদ্ধারকারীদের জন্য অপেক্ষা করছি।’ সিরিয়ার একটি সীমান্ত এলাকায় ভূমিকম্পের পর লোকজনকে উষ্ণ থাকার চেষ্টায় রাস্তায় পড়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ পোড়াতে দেখা যায়।
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে শীতকালীন ঝড়ে অনেক সড়ক এখন ব্যবহারের অনুপযুক্ত। কিছু আবার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত। অনেক সড়ক প্রায় চলাচলের অযোগ্য। ফলে কিছু অঞ্চলে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়েছে।
দুই দেশেরই অনেক এলাকায় গতকাল পর্যন্ত উদ্ধারকমীরা ভারী যন্ত্র নিয়ে প্রবেশই করতে পারেননি। এতে এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে সংকট আরো তীব্র হচ্ছে।
অনেক জনপদে এখনো ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়নি। খালি হাতেই মানুষ ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে জীবিতদের উদ্ধারের চেষ্টা করছে। কিন্তু অনেকের ডাক শুনলেও ধ্বংসস্তূপ সরাতে না পারায় তাদের উদ্ধার করা যাচ্ছে না। সিরিয়ার জানদাইরাস শহরের বাসিন্দা আলি বাত্তাল বলেন, ‘আমার পুরো পরিবার ধ্বংস্তূপের নিচে। আমার ছেলে, মেয়ে, জামাতা...তাদের উদ্ধার করার কেউ নেই।’
তুরস্কের হাতায় প্রদেশের এক ভিডিওতে দেখা যায়, এক স্থানীয় ব্যক্তি ধ্বংসস্তূপে জীবিতদের সন্ধান করছেন। তিনি একজনের কণ্ঠ শুনতে পান এবং তাকে আরো জোরে চিৎকার দিতে বলেন। ওই ব্যক্তি বলেন, এখানে একজনের লাশ দেখা যাচ্ছে।
মৃত্যু আরো বাড়ার শঙ্কা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস বলেন, ‘এটি এখন সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই। আমরা এখন আহত ও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে জরুরি চিকিৎসাদলের নেটওয়ার্ক সক্রিয় করেছি।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা করছে, মৃতের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। সংস্থার কর্মকর্তাদের অনুমান, নিহতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়াতে পারে। এই ভূমিকম্পে মোট দুই কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে। বিভিন্ন দেশকে দ্রুত দুর্যোগ অঞ্চলে সাহায্য পাঠানোর আহ্বানও জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সিরিয়ার রেড ক্রিসেন্ট পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া ও সাহায্য দেওয়ার আবেদন জানিয়েছে। গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, তাদের মানবিক কর্মসূচির আওতায় সিরিয়ায় সাহায্য পাঠানো হচ্ছে।
ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্ক ও সিরিয়াকে সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময় জানান, ৭০টি দেশ উদ্ধার অভিযানে সাহায্য ও মানবিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
উদ্ধারকাজ ও চিকিৎসাসেবায় অংশ নিতে বাংলাদেশের একটি দল আজ বুধবারই তুরস্কে যাচ্ছে। ওই দলে সেনাবাহিনী ও দমকল বাহিনীর সদস্যরা থাকবেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি সি-১৩০ পরিবহন বিমানে করে প্রাথমিকভাবে উদ্ধারকারী ও চিকিৎসা দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তাঁরা দুটি অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল পাঠাচ্ছেন। প্রতিটি দলে থাকবেন ৮০ জন করে। রাশিয়া তুরস্ক ও সিরিয়া উভয়কেই সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, তিন শর বেশি সেনা নিয়ে রুশ সেনাবাহিনীর ১০টি ইউনিট ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কিও সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
ভারতের দুর্যোগ ও ত্রাণ মোকাবেলা বিষয়ক দুটি দল উদ্ধারকারী কুকুর ও চিকিৎসাসামগ্রী নিয়ে তুরস্কে গেছে। চীন উদ্ধারকর্মী, মেডিক্যাল টিম এবং অন্যান্য জিনিস সরবরাহ করছে। বিধ্বস্ত দেশটিতে দুটি অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল পাঠিয়েছে পাকিস্তান।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ৩০টি উদ্ধারকারী ও মেডিক্যাল দল পাঠিয়েছে। সব মিলিয়ে ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে এক হাজার ২০০-এর বেশি উদ্ধারকর্মী ও ৭০টি শনাক্তকারী কুকুর পাঠানো হবে তুরস্ক ও সিরিয়ায়।
সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সানা জানিয়েছে, মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল পর্যন্ত ইরাক ও ইরান থেকে খাবার, ওষুধ ও কম্বলবাহী বিমান দামেস্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে। মানবিক সহায়তার জন্য তহবিল পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড।
নেদারল্যান্ডসের অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা তুরস্কে সহায়তা করার জন্য রওনা দিয়েছেন। ইতালি থেকে সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তে উদ্ধার অভিযানে সহায়তা করতে গেছে প্রায় ৫০ জন অগ্নিনির্বাপণ ও চিকিৎসাকর্মী।
পরে আরো ফ্লাইটে করে চিকিৎসাকর্মী এবং সরঞ্জাম পাঠানো হবে। গ্রিস ভূমিকম্পের দিনই একটি বিমানে উদ্ধারকারী দল ও মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে। সূত্র : বিবিসি, সিএনএন, এএফপি ও রয়টার্স ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এই শিশুটিকে জন্ম দেওয়ার পর মারা গেছেন মা