বছরে হুন্ডিতে পাচার ৭৫ হাজার কোটি টাকা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১০ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:২৩ এএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফএস) অন্তত পাঁচ হাজার এজেন্ট হুন্ডি চক্রের সঙ্গে জড়িত। এরা বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়সহ বিভিন্ন মোবাইল মাধ্যমে গত একবছরে কমপক্ষে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। এ কারণে গত চার মাসে বাংলাদেশ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ রেমিটেন্স থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যা ইউএস ডলারে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের (৭৮০ কোটি) মতো।
এরকমই মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে বিলিয়ন ডলারের ডিজিটাল হুন্ডি কারবার করা ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, হুন্ডি এজেন্ট আক্তার হোসেন (৪০), দিদারুল আলম সুমন (৩৪), খোরশেদ আলম ইমন (২২) এবং এমএফএস এজেন্ট রুমন কান্তি দাস জয় (৩৪), রাশেদ মনজুর ফিরোজ (৪৫), মোঃ হোসাইনুল কবির (৩৫), নবীন উল্লাহ (৩৭), মোঃ জুনাইদুল হক (৩০), আদিবুর রহমান (২৫), আসিফ নেওয়াজ (২৭), ফরহাদ হোসাইন (২৫), আবদুল বাছির (২৭), মাহবুবুর রহমান সেলিম (৫০), আব্দুল আউয়াল সোহাগ (৩৬), ফজলে রাব্বি (২৭) ও শামীমা আক্তার (৩২)।
বুধবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে তাদের গ্রেফতার করে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ও সাইবার ক্রাইম ইউনিট। দেশে ডলারের দামে অস্থিরতা শুরুর পর বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে সিআইডি। এরপরই বেরিয়ে আসে ডিজিটাল হুন্ডি কারবারি চক্রের চাঞ্চল্যকর তথ্য। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মাদ আলী এসব তথ্য জানান।
সিআইডির প্রধান জানান, সাইবার ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে সিআইডি ৫ হাজারের বেশি এজেন্টের সন্ধান পেয়েছে, যারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের (এমএফসের) মাধ্যমে হুন্ডির কারবারে জড়িত। সংঘবদ্ধ এই চক্র অবৈধভাবে হুন্ডির মাধমে বিদেশে অর্থপাচার করছে।
আবার বিদেশে অবস্থানরত ওয়েজ আর্নারদের কষ্টার্জিত অর্থ বাংলাদেশে না এনে স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করে মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধ করছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় এর বহু এজেন্ট এই অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী জানান, গ্রেফতারকৃত ১৬ জনের মধ্যে ছয়জন বিকাশ এজেন্ট, তিনজন বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটর সেলস অফিসার, তিনজন বিকাশের ডিএসএস, দুজন হুন্ডি এজেন্ট, একজন হুন্ডি এজেন্টের সহযোগী এবং একজন হুন্ডি পরিচালনাকারী।
সিআইডি প্রধান বলেন, রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে তা মোকাবেলার জন্য সরকার অত্যন্ত তৎপর। হুন্ডি সব সময় রিজার্ভের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের অর্থনীতির এ ঝুঁকি মোকাবেলায় হুন্ডি কার্যক্রমের বিষয়ে নজরদারি শুরু করে সিআইডি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার এবং দেশের বাইরে অবস্থানরতদের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে না এনে স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং অপরাধ করে আসছে।
সিআইডির প্রধান জানান, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পাঁচ হাজার এজেন্টের মাধ্যমে চার মাসে হুন্ডি হয়েছে আনুমানিক ২৫ হাজার কোটি টাকা। চার মাসের ওই তথ্য ধরে হিসাব করে পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, এসব এমএফএস এজেন্টের মাধ্যমে বছরে হুন্ডি হয়ে দেশে আসছে আনুমানিক ৭৫ হাজার কোটি টাকা।
অর্থাৎ সরকার প্রায় ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যা ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসীরা ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন, যা দেশের মোট জিডিপির ৭ শতাংশের মতো। ওই চক্রটি কীভাবে কার্যক্রম চালায় তারও একটি ধারণা দেয়া হয় সিআইডির সংবাদ সম্মেলনে।
অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মাদ আলী জানান, হুন্ডিচক্রের সদস্যরা প্রবাসে বাংলাদেশীর কাছ থেকে বিদেশী মুদ্রা সংগ্রহ করেন দেশে তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। কিন্তু তারা বিদেশী মুদ্রা না পাঠিয়ে সমমূল্যের বাংলাদেশী টাকা দেশে পরিবারকে বুঝিয়ে দেন। তাতে দেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত থাকে। তিনি জানান, হুন্ডিচক্র কাজটি করে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীদের কাছ থেকে বিদেশী মুদ্রা সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় গ্রুপ কাজ করে দেশে।
হুন্ডির সমপরিমাণ অর্থ তারা বাংলাদেশী টাকায় নির্দিষ্ট দেশীয় মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের দেয়। ওই এজেন্টরা হলো তৃতীয় গ্রুপ। হুন্ডি হয়ে তাদের হাতে আসা টাকা তারা দেশে নির্দিষ্ট ফোন নম্বরে পরিশোধ করে। এভাবে কোটি কোটি টাকা দেশ থেকে কালো টাকার মালিকরা পাচার করছে। অপরদিকে বাংলাদেশ রেমিটেন্স হারাচ্ছে। সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী জানান, দেশে হঠাৎ ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা এই চক্রের সন্ধান পাই।
প্রবাসীদের কষ্টার্জিত আয় ডলার হয়ে দেশে আসে না। একটি চক্র তা পাচার করে দিচ্ছে। এতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি জানান, দেশীয় মোবাইল ব্যাংকিং (এমএফএস) এর এজেন্টদের সহযোগিতায় পাচারকারীরা বিদেশে স্থায়ী সম্পদ অর্জনসহ অনলাইন জুয়া, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণ চোরাচালান, ইয়াবা ব্যবসাসহ প্রচুর অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করছে। এই অবৈধ লেনদেনে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস কোম্পানিগুলো কতটা দায়ী- এমন প্রশ্নে সিআইডির প্রধান জানান, এটা দেখবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আর যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তারা এজেন্ট। তাই কোম্পানিগুলোর এজেন্ট নিয়োগে এবং মনিটরিংয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। সিআইডি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবে।
সিআইডি প্রধান বলেন, এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ২(শ) (১৪) ধারা অনুযায়ী অপরাধ। যা একই আইনের ৪(২) এর ধারায় দণ্ডনীয়। এ বিষয়ে মামলা রেকর্ডসহ যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।
হুন্ডিতে টাকা নিলে প্রবাসীর স্বজনের বিপদ ও মামলার আওতায় পড়বেন ॥ প্রবাসীরা অবৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠালে দেশে তাদের স্বজনরা আইনের আওতায় আসতে পারেন বলে জানিয়েছেন সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া। তিনি জানান, যারা বিদেশ থেকে অবৈধ পথে টাকা পাঠাচ্ছেন এবং দেশ থেকে সে টাকা গ্রহণ করছেন, তাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি সিআইডি মনিটরিং করছে।
আমার ধারণা কোন প্রবাসী চাইবেন না তার অবৈধ পথে টাকা পাঠানোর জন্য তার স্বজন আইনের মুখোমুখি হোক। ডলারের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কেন অভিযান চালিয়ে হুন্ডি কারবারিদের গ্রেফতার করা হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে সিআইডির প্রধান জানান, সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ার কারণে ধরা যায়নি। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা তথ্য মিল পাওয়ার ভিত্তিতে হুন্ডি চক্রের এই ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমাদের প্রবাসীরা তাদের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠালে ব্যাংক থেকে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়।
আবার বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নভাবে প্রণোদনা দিচ্ছে, এরপরও বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা না পাঠিয়ে অবৈধভাবে কেন বাংলাদেশীরা টাকা পাঠাচ্ছেন। এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরের সঙ্গে আমাদের একটি মিটিং হয়েছে। আমার বিশ্বাস এর একটি সুষ্ঠু সমাধান হবে।
সিআইডির প্রধান জানান, ইতোমধ্যে যারা অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল সিআইডির তৎপরতায় সেখান থেকে তারা সরে আসতে শুরু করেছে। আমরা ইন্টেলিজেন্স বেইজ অপারেশন পরিচালনা করি। সিআইডি ৫ হাজার মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এজেন্টদের নজরদারির মধ্যে রেখেছে। দুই-একদিনের মধ্যে অবৈধ লেনদেন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কমে যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিকাশ, রকেট, নগদ ছাড়াও যেসব মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস রয়েছে তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে মিটিং করিনি। আনুষ্ঠানিকভাবে মিটিং না করার কারণ, ইন্টেলিজেন্স যেন ফাঁস না হয়। হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো টাকা কোন জঙ্গী কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সিআইডি প্রধান বলেন, তদন্ত করে বিষয়টি দেখা হবে।