ধারাবাহিক কমছে ব্যাংক আমানত
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৬ জুলাই,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ১২:২৪ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
ব্যাংকে ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে আমানত। বিশেষ করে চলতি আমানত কমে যাচ্ছে বেশি হারে। একই সাথে মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ গ্রাহকের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকের নতুন বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে, বাড়ছে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়। কারণ, আমানত সংগ্রহ করতে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত এপ্রিলে আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮.৫৪ শতাংশ, যেখানে গত বছরের এপ্রিলে ছিল ৯.০৯ শতাংশ। আর ২০২১ সালের জুনে ছিল ১৪.৩৭ শতাংশ। আমানতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে চলতি আমানত। এপ্রিলে চলতি আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১.০৭ শতাংশ, যেখানে গত বছরের এপ্রিলে ছিল প্রায় ১৩ শতাংশ। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, গত এক বছরে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু বিপরীতে মানুষের আয় কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি, বরং ক্ষেত্রবিশেষ কমে গেছে। এতে মানুষের সঞ্চয় করার সক্ষমতা কমে গেছে। অপর দিকে, আমানত কমে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা যেমন কমছে, তেমনি আমানত সংগ্রহ করতে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর গত বৃহস্পতিবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমে গেছে। এর ওপর মেয়াদি আমানতের সুদহার বেড়ে গেছে। সাধারণত, চলতি আমানতের সুদহার সামান্যই থাকে। অনেকটা কম সুদে ব্যাংকগুলো চলতি আমানত সংগ্রহ করে। এখন যেহেতু মেয়াদি আমানতের সুদহার বেড়ে যাচ্ছে, তখন মানুষ চলতি আমানত প্রত্যাহার করে মেয়াদি আমানতে স্থানান্তর করছে। এতে চলতি আমানত বেশি কমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এর ফলে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে বিনিয়োগ সক্ষমতা। তিনি মনে করেন, আমানত কমে গেলে এর প্রভাব বিনিয়োগের ওপর পড়বে। এ কারণে মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখতে বাজার ব্যবস্থা তদারকি জোরদার করতে হবে।
অর্থনীতির সর্বশেষ সূচক নিয়ে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ মাসে আমানত বেড়েছিল ৭৫ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা, সেখানে বিদায়ী অর্থবছরের ১০ মাসে আমানত ১ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৭৭ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের জুন শেষে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮.৯০ শতাংশ। ২০২১ সালের জুনে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৪.৩৭ শতাংশ। আর এক মাস হিসাবে গত এপ্রিলে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে ৮.৫৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ মাসিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২১ সাল থেকে আমানতের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, একক মাস হিসেবে এপ্রিলে আমানতের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রকৃত হিসাবে তা আরো কম। কারণ, আমানতের গড় সুদহার যদি ৬ শতাংশ হয়, তখন ১০০ টাকা আমানতে বছর শেষে ১০৬ টাকা হয়। আর এপ্রিলে আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮.৫৪ শতাংশ। এ হিসাবে আমানতের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছে আড়াই শতাংশ।
সামগ্রিক আমানতের মধ্যে ১০ মাসে সামগ্রিক আমানত যেখানে বেড়েছে ১ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা, সেখানে চলতি আমানত কমেছে ৪ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে চলতি আমানত বেড়েছিল ১৬৬ কোটি টাকা, সেখানে বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে চলতি আমানত না বেড়ে বরং কমেছে ৪ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা। তবে, চলতি আমানত কমলেও মেয়াদি আমানত ৬ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৮১ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা। মেয়াদি আমানত বৃদ্ধির হার হলো ৮.৩৯ শতাংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, গত জুন শেষে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে পৌনে ১০ শতাংশ। অথচ আমানতের সুদহার গড়ে ৬ শতাংশ। এ হিসাবে ১০০ টাকা আমানত রাখতে বছর শেষে গ্রাহকের মূলধন খোয়া যাচ্ছে পৌনে ৪ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকে আমানত রেখে গ্রাহকরা মূল্যস্ফীতির হিসাবে লোকসান গুনছে। অপর দিকে যে হার মানুষের ব্যয় বেড়েছে ওই হারে আয় বাড়েনি, বরং ক্ষেত্রবিশেষ কমে গেছে। এমনি অবস্থায় ব্যাংকে আমানত রেখে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে গ্রাহকের অর্থ। এ কারণে ব্যয়ের সাথে আয় সমন্বয় না হওয়ায় মানুষ আগের মতো সঞ্চয় করতে পারছে না, বরং অনেকেই সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। অপর দিকে আমানত কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বেশি হারে আমানত সংগ্রহ করছে। এতে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে গেলে ঋণের সুদহারও বেড়ে যাচ্ছে। এতে উদ্যোক্তাদের ব্যবসার ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। সবমিলে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। এতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে তারা মনে করছেন।