অনিয়মে ঢাকা পড়েছে ডলারের ‘আসল রেট’
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৪ জুন,
বুধবার,২০২৩ | আপডেট: ০৩:৪২ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
খোলাবাজারে ডলারের দামে আবার কারসাজি শুরু হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জে খোঁজ নিয়ে নানা অনিয়ম পাওয়া গেছে। যেমন—ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি, বিক্রির রসিদ না দেওয়া, পাসপোর্ট, টিকিট ছাড়া ডলার কেনাবেচা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো তথ্যে গরমিল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অভিযান শিথিল হওয়ার কারণে অসাধু মানি এক্সচেঞ্জগুলো অনিয়ম শুরু করেছে।
এই অনিয়মের কারণে ভোগান্তি হচ্ছে হজযাত্রী ও বিদেশ গমনেচ্ছু ব্যক্তিদের। রাজধানীর গুলশান ও পল্টন এলাকার কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জ ঘুরে দেখা গেছে, ঘোষিত দামের চেয়ে অন্তত দু-তিন টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে ডলার। ক্রেতাদের কাছে বেশি দামে ডলার বিক্রি করে দেখানো হচ্ছে কম দাম। ১১২ টাকায় ডলার বিক্রি করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো তথ্যে কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জ দেখিয়েছে ১০৮ থেকে ১১০ টাকা।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বরে ল্যান্ডমার্ক শপিং সেন্টারের নিচতলায় করনিকা মানি এক্সচেঞ্জের বোর্ডে ডলারের ক্রয়মূল্য ১০৯ টাকা আর বিক্রয়মূল্য ১১০ টাকা ৫০ পয়সা লেখা ছিল। তবে এটি আসল রেট নয় বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মী। আসল রেট জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মী বলেন, ‘আসল রেট বোর্ডে দেওয়া হয় না। বিক্রি করা হয় আরো বেশি দামে।
গতকাল ১১১ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে প্রতি ডলার।’ একই চিত্র দেখা গেল ল্যান্ডমার্ক শপিং সেন্টারের দ্বিতীয় তলার মেট্রো মানি এক্সচেঞ্জে। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মীর কাছে একটি বিশেষ সংস্থার কর্মকর্তা পরিচয়ে এক ব্যক্তি কোনো কাগজপত্র ছাড়াই নিমেষে পেয়ে গেলেন চাহিদামতো ডলার, রিয়াল।
বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে পাসপোর্ট-ভিসা, ভ্রমণ টিকিট দেখানোর নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তা কোনো কোনো মানি এক্সচেঞ্জ মানছে না।
আবার কোনো মানি এক্সচেঞ্জ দিনশেষে নিজেদের কাছে ২৫ হাজার ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রাখতে পারবে নগদ আকারে। এর চেয়ে বেশি রাখতে পারবে না। কিন্তু এই নিয়মও না মানার অভিযোগ উঠেছে কোনো কোনো মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের মানি এক্সচেঞ্জগুলোকে ডলার কেনা দামের চেয়ে এক থেকে সর্বোচ্চ এক টাকা ৫০ পয়সা বেশি দামে বিক্রি করার সীমা নির্ধারণ করে দিলেও তা মানছে না কেউ কেউ।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও গোয়েন্দা সংস্থার অভিযান চলাকালে বাজারে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরলেও এখন অনিয়ম বেড়েছে। বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচায় শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে একাধিক চক্র। এই চক্র রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, গুলশান এলাকায় এক্সচেঞ্জ হাউসের সামনে অবস্থান নিয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে।
জানতে চাইলে গুলশান-২-এর এএসএন মানি এক্সচেঞ্জের পরিচালক সলিম উল্লাহ বলেন, দেশে মাত্র ২৩৫টি মানি এক্সচেঞ্জ বৈধ, আর সাত শতাধিক মানি এক্সচেঞ্জ অবৈধ, যাদের বিরুদ্ধে নিয়ম না মেনে লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এসব অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ অনিয়ম করছে।
বাংলাদেশ মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. হেলাল শিকদার বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের প্রতিটি সদস্য যার যার বোর্ডে যে দাম থাকবে সেই দামেই বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচা করবে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিংয়ে ধরা পড়লে তার লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। যারা এমন অনিয়ম করেছে, তাদের বিরুদ্ধেই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই এখনো লাইসেন্স নবায়ন না করে ব্যবসা করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তারা সুযোগ পেলেই ডলারের দাম বাড়িয়ে দেয়।’
এদিকে আন্ত ব্যাংকে গতকাল ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। আর সর্বনিম্ন দর ছিল ১০৭ টাকা ৯৭ পয়সা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে এই দামে ডলার পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করে আসছেন। সেখানেও অদৃশ্য রেট কাজ করছে বলে জানিয়েছেন খোদ এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দীন।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সরকারের বেঁধে দেওয়া ডলারের বিনিময়হার কোনো কাজ করছে না। ব্যাংকগুলো লুটের মালের মতো করে ডলারের দাম নিচ্ছে। আমদানি বিল পরিশোধের সময় এক ডলারের বিপরীতে প্রায় ১১৫ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। যার কাছ থেকে যা ইচ্ছা আদায় করছে ব্যাংকগুলো।’
বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর খোলাবাজারে ১২১ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল, এক বছর আগেও যা ছিল ৯০ টাকার ঘরে। ওই সময় ডলারের দর নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে দেড় শতাধিক মানি এক্সচেঞ্জে অভিযানে নেমে বাংলাদেশ ব্যাংক ডজনখানেক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সাময়িকভাবে স্থগিত করে।
গত বছরের জুনে ডলার নিয়ে অস্থিরতার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, অনুমোদিত ২৩৫টির বাইরে আরো ৭০০টির মতো মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে। ওই সময় অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযানে নামার কথাও জানিয়েছিল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বৈদেশিক মুদ্রার খোলাবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং হুন্ডি বন্ধে মানি চেঞ্জারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠকের পর সিআইডির অভিযানের বিষয়টি জানানো হয়।
আগামী মাসে ডলারের এক রেট : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার শর্ত দিয়েছে। আগামী জুলাইয়ের মধ্যে তা করা হবে বলে সরকারের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘ডলার এক রেটে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। যখন ডলার রেট ২ শতাংশ ব্যান্ড রেটের মধ্যে থাকে, তখন আমরা সেটিকে সিঙ্গল রেট বলি। আমরা ধীরে ধীরে সেদিকেই এগোচ্ছি। সিঙ্গল প্রায় চলে এসেছে। বাকিটাও পর্যায়ক্রমে হয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার সেলিং রেটটা এখনো কম আছে, আমরা সেটি ধীরে ধীরে বাজারভিত্তিক করব।’
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ডলারের যে রেটটা ছদ্মবেশে আছে, সেটা উন্মুক্ত হবে। তাহলে বাজারের স্বচ্ছতা বাড়বে। একই মুদ্রার অনেক রকম দর গত বছরের সেপ্টেম্বরে চালুর পর ডলারের জোগান কমিয়েছে। বাফেদার (বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন) নির্ধারিত রেট ব্যাংকগুলো খুব একটা মানতে পারছে না। এখনো ডলারের সংকট রয়ে গেছে বলেই এলসি নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের জোগান বাড়াতে হলে বিনিময়হার বাজারের ওপর ছাড়তে হবে। এলসি খুলতে গিয়ে আমদানিকারকরা যে দরে ডলার কিনছেন, সেটা দেখানো যাচ্ছে না।’