কামাল হোসেনের তাসনুভা শিশির হয়ে ওঠার গল্প
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৬:২৩ পিএম, ১৪ মার্চ,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:৫২ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
তাসনুভা আনান শিশির। একজন উঠতি অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী কিংবা সংবাদ উপস্থাপক- এমন নানান বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়। টেলিভশন কিংবা ইউটিউবের পর্দায় তাসনুভার বাচনভঙ্গি দেখে যে কেউ ভাবতেই পারেন, আর আট-দশ জন মানুষের মতোই একজন। কিন্তু আজকের তাসনুভা আনান শিশিরের বহু বসন্ত কেটেছে কামাল হোসেন পরিচয়ে।
কামাল হোসেন পরিচয় ছাপিয়ে তাসনুভা আনান শিশির হয়ে ওঠার এক দীর্ঘ গল্প রয়েছে। যে গল্প শুধুই বঞ্চনা, অপমান আর উপেক্ষার। তবে তীব্র পরিশ্রম আর লেগে থাকার মানসিকতা যে নতুন ভোর এনে দেয় তার উৎকৃষ্ট উদহারণও তাসনুভা। পরিবারের ভালোবাসা না পেয়ে যে তাসনুভার বেড়ে ওঠা সে এখন হাল ধরেছেন পরিবারের। তবে দিন বদলেনি এখনও। বাবা-মার মুখ দেখার তীব্র ইচ্ছা পূরণ হয়নি বহুদিন। তিন বোন আর এক ভাইয়ের সাথেও নেই কোনো যোগাযোগ। ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে বেড়ে ওঠা তাসনুভার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল বড় হওয়ার। স্রোতের বিপরীতে হাঁটার যে তীব্র সাহস জন্মেছিল, তা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
বাগেরহাটে জন্ম নেওয়া তাসনুভার জন্মের পর বাবা-মা নাম রাখেন কামাল হোসেন। উচ্চ-মাধ্যমিকে থাকতে তাসনুভা উপলব্ধি করেন, তিনি মেয়েদের মতো চলতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। বাবা-মা বুঝতে পেরে বন্ধ করে দেন তাসনুভার নৃত্য করা। আশেপাশের লোক বলতে শুরু করেন ‘হিজড়া’। বাবা-মার সম্মানের দিকে তাকিয়ে ঘর ছাড়েন তিনি। জন্মস্থান ছেড়ে চলে আসেন নারায়ণগঞ্জে। সেখানেই তোলারাম করেজে সমাজকর্মে শেষ করেন মাস্টার্স। একইসংগে চলতে থাকে লড়াই। তাসনুভা ততদিনে তাঁর ভেতরের চাওয়াকে সম্মান দিয়ে নারীর বেশভুষায় চলতে শুরু করেন। ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ কলকাতায় গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শে পুরুষ থেকে রূপান্তরিত নারী হয়ে কামাল থেকে হয়ে ওঠেন তাসনুভা আনান শিশির।
রূপান্তরিত হয়ে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। ‘হিজড়া’ হিসেবে যখন পরিচিত ছিলেন, তখন আর্থিক সংস্থাপন করাটা ছিল সহজ। ছেলেদের মতো চলাফেরায় কাজ টিউশনি কিংবা নৃত্য চালিয়ে যেতে পারতেন। রূপান্তরের পরে কাজ বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করতেন, সেটিও বন্ধ হতে থাকে। তারপরে দেখা গেল, কেউ প্রোগ্রামে ডাকছে না। তবে থেমে থাকেননি তাসনুভা। আপন যোগ্যতায় নিজের পায়ের মাটি শক্ত করেছেন।
বাঁকা চোখ আর কটূক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এগিয়ে চলেছেন স্বপ্নপূরণে। তাসনুভা এখন মাস্টার্স করছেন ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ থেকে পাবলিক হেলথ বিষয়ে। ছোটবেলা বাড়ির বারণ উপেক্ষা করে যে নৃত্য অনুশীলন করতেন- তা এখনও চালিয়ে নিচ্ছেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে তাসনুভার পালকে যোগ হয়েছে আরও দুই পরিচয়- অভিনেত্রী এবং সংবাদ উপস্থাপক। ‘কসাই’ নামে একটি সিনেমায় অভিনয় করছেন তিনি। যা চলতি মাসেই মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে, একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে যাত্রা শুরু করলেন আজই (৮মার্চ)।
এতকিছুর মধ্যেও তাসনুভার পরিবার ফেরেনি। তাঁরা কামাল হোসেনকেই চায়। তাসনুভার শারিরিক পরিবর্তন নিয়ে তাঁদের আগ্রহ নেই। তাসনুভা বলেন, ‘বাবার বয়স হয়েছে। বাবা-মা অসুস্থ। ফ্যামিলিতে কন্ট্রিবিউশন আমি করছি। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়া অনেক বড় প্রভাব ফেলে আমাদের সোসাইটিতে। সেটা খানিকটা হওয়ার কারণে, বাড়ি আসতেই পারবা না, সে জায়গাটা এখন আর নেই। তবে তাদের মান সম্মানের ভয়ে, আশপাশের মানুষ কী বলবে, এই ভয়ে আমি বাড়ি যাই না।’
তাসনুভার অন্য চার বোন এবং এক ভাইয়ের সাথেও নেই যোগাযোগ। বোনরা সবাই ঘর-সংসার করছেন। বাচ্চাও আছে। ভাগ্নে-ভাগ্নিদেরও চিনেন না তিনি। বছরান্তে বোনদের সংগে কথা হয় দুয়েক মিনিট। কেউই কারো কাছে জানতে চান না, কে কোথায় আছে। তাসনুভাও বুঝাতে চান না তাঁর নারী হয়ে ওঠার অগ্রগতির কথা। বলেন, ‘আমি কথা বলি না। কথা বললে ট্রমাটাইজড হয়ে পড়ি। কাজে ব্যাঘাত ঘটে। আমাকে তো খেতে হয়, পরতে হয়। এই রিলেশন প্যানপ্যানানি আমার বিরক্ত লাগে।’
তবে তাসনুভা সন্তান হিসেবে নিজের দায়িত্বের কথা মনে রেখেছেন। মাস শেষে অনেক যত্নে গুছানো টাকা বাড়িতে পাঠান বাবা-মায়ের জন্য।
তাসনুভা এখন মানসিকভাবে স্থির হতে চান। বিয়ে করে একটি পরিবার নিয়ে বাঁচতে চান। ‘বিয়ে করতে চাই। সংসার করতে চাই। কিন্তু সোসাইটি তো সেনসিটাইজ (সংবেদনশীল) না এখনও। যেখানে আমাদের দেশের মেয়েদেরই বিয়ের পর যৌতুকসহ সব কিছুতে চাপ নিতে হচ্ছে, সেখানে আমাকে স্বীকৃতি দিবে তেমন পরিবেশ তো হয়নি। আর প্রেম-ভালোবাসা তো নরমাল মেয়েদেরই কতরকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়। সেখানে আমাদের তো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। আমি এখন একজন মানুষের কথা ভাবছি। যার বাবা-মায়ের কাছে আমি ছেলের বউয়ের সম্মান পাব। নারী হিবেসে মর্যাদা পাব।’
তাসনুভা শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবছেন না। তাঁর মতো রূপান্তরিত নারী এবং হিজড়া জনগোষ্ঠীদের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করতে চান। ‘আমরা একটা নীতিমালা চাই। যাতে বলা থাকবে সার্টিফিকেট নেম কীভাবে চেঞ্জ করবে, ডাক্তারি পরীক্ষা কীভাবে সম্পন্ন হবে। পরিবার গঠন কীভাবে হবে আমরা জানি না। সম্পদের ভাগ কীভাবে হবে তা স্পষ্ট না। এই সবকিছুর একটা প্রপার ওয়ে থাকা দরকার।’ নীতিমালা না থাকায় তাসনুভা নিজেও জাতীয় পরিচয় পত্রের নাম পরিবর্তন করতে পারছেন না বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
হিজড়া জনগোষ্ঠী কিংবা রুপান্তরিত নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ তাসনুভার। ‘পড়াশোনা করতে চাইলে করা যায়। তারজন্য একটু বেহায়ার মতো পরে থাকতে হয়। আমার বাবা-মা তো কম বলেনি, মান সম্মানের দোহায় দিয়ে। বুলিংতো আমি কম শুনিনি। লোকজন তো আমাকে কম হ্যারেস করেনি। তবে আমি পড়াশোনাটা করেছি…’
সাম্প্রতিক সময়ে হিজড়া বা রূপান্তরিতরা অনেকেই পারিবারের সহযোগিতা পাচ্ছেন। পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে আশার কথা জানালেন তাসনুভা। ‘গত ১০ বছরে এখন তো পরিবেশটা পাল্টেছে। এখন ১৩ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে অনেককে চিনি, যারা নিজেদেরকে ট্রান্স বলে। তাদের পরিবার অরিয়েন্টেন্ড। তারা পড়াশোনাও করছে। হয়তো আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কারণে বলতে পারছে না।’
নারী হয়ে ওঠার এ পথপরিক্রমায় তাসনুভার ভাগ্যে ভালোবাসা না জুটলেও যৌন হেনস্তার শিকার হয়েছেন। কিন্তু তিনি চুপ থাকেননি। বিশ্বব্যাপী #মি-টু আন্দোলনে নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের জবাবও দিয়েছেন তিনি। সে বিষয়ে বেশিকিছু বলতে চান না তাসনুভা। হেনস্তাকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন ‘মানসিক বিকাশের অভাব। দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা। সবচেয়ে বড় সমস্যা- নৈতিকতার অধঃপতন।’
তাসনুভা আনান শিশির কারও সহযোগিতা চান না, মানুষ হিসেবে সম্মানটুকু চান। ‘তাসনুভার জন্য আপনি কিছু করতে পারছেন না, কোনো সমস্য নেই। কারণ, তাসনুভারা নিজেদের পথ খুঁজে নিতে পারে। আপনি কাজ করে দিতে পারছেন না, কিন্তু বাধা তৈরি করবেন না। আপনার জায়গায় আপনি স্বাভাবিক থাকেন। একজনের দোষ আমাদের পুরো কমিউনিটির উপর চাপাবেন না।’
এতসব বঞ্চনার মধ্যেও কিছু ভালোবাসার গল্প আছে। যা এখনই জানাতে চাইলেন না তাসনুভা। আরেকটু থিতু হলে আত্মজীবনী নিয়ে প্রকাশ করতে চান বই। যা লিখছেন প্রতিনিয়তই। কামাল হোসেনের তাসনুভা আনান শিশির হয়ে ওঠার সে গল্পে সিনেমাও নির্মাণ করতে চান তিনি।