avertisements 2

বদর যুদ্ধ ও রমজান

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৯ এপ্রিল,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৩:৫৫ পিএম, ২৭ এপ্রিল,শনিবার,২০২৪

Text

আল-ফুরকান যা আল-কুরআনের অপর নাম। যার অর্থ হলো- সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। নাজিল হয়েছিল রমজানের এক মহিমান্বিত রজনীতে, নাম তার লাইলাতুল কদর। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘রমজান তো সেই মাস, যে মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত এবং এমন দ্ব্যর্থহীন শিক্ষাসংবলিত, যা সত্য-সঠিক পথ দেখায় এবং হক-বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়।’ (সূরা বাকারাহ-১৮৫)

বদর যুদ্ধ সত্য-মিথ্যা পার্থক্যের এক চূড়ান্ত লড়াই। এই রমজানে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত ফায়সালা হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এই রমজানেরই ১৭ তারিখ। এর দ্বারা ফায়সালা হয়েছিল সত্য ও মিথ্যা কখনো পাশাপাশি সমান্তরাল অবস্থান করতে পারে না। রমজানে এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার তাৎপর্য হলো, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের জন্য প্রয়োজনে চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে।

রমজানের রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়া হলো, আল্লাহর ভয়ে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণ করে পথ চলা। অর্থাৎ মিথ্যা বা অসত্য থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা এবং সত্যের পথে নিজেকে পরিচালিত করা।

রমজানের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়ার শক্তি অর্জন করা। যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদেরকে মুত্তাকি বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলছেন- ‘আলিফ লাম মিম, এই সেই কিতাব, যার মধ্যে সন্দেহের লেশমাত্র নেই, এটি মুত্তাকি লোকদের পথপ্রদর্শক।’ (সূরা বাকারাহ : ১-২) যখন মুত্তাকি লোকেরা তাকওয়ার পথে, আলোর পথে, তাগুতের বিপরীত পথে চলবে, তখন শয়তান তাকে বাধার সৃষ্টি করবে। এই বাধাকে অতিক্রম করে সামনে পথ চলতে গেলে তার সাথে দ্বন্দ্ব অনিবার্য। তখন যুদ্ধ করে হলেও সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণ করতে হবে। রমজানে সংঘটিত ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সেই আহ্বানই রেখে যায়। আমাদেরকে ডেকে যায় তাগুতের সাথে কোনো আপস নয়। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে।

অতএব রমজান, কুরআন ও বদরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ তাকওয়াকে মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল করার জন্য এই বিষয়গুলো সম্মিলিতভাবে কাজ করে। তাকওয়া অর্থ অন্তরে সর্বদা আল্লাহর ভয় রেখে সর্বপ্রকার গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা।

ফজর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হালাল দুটো বস্তু তথা- পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ থেকে বিরত রয়েছেন কেবল আল্লাহর হুকুমে ও আল্লাহর ভয়ে। একটি মাস ক্রমাগত এই অনুশীলনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করলেন; কিন্তু তাকওয়ার পথে চলার মতো জ্ঞান আপনার নেই। আপনি জানেন না কোনটি আলোর পথ আর কোনটি অন্ধকারের পথ। কোনটি হালাল আর কোনটি হারাম। কোনটি তাগুতের পথ আর কোনটি সিরাতুল মুস্তাকিম। তাই মহান আল্লাহ রমজানের রোজা ফরজ করার প্রাক্কালেই আল-ফুরকান অর্থাৎ কুরআন নাজিল করেছেন। যাতে আপনি তাকওয়া অর্জনের পাশাপাশি তাকওয়ার পথ সম্পর্কে জ্ঞানও আহরণ করতে পারেন।

আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, নবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে ও সেই অনুযায়ী কাজ করা বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনোই প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি-১৯০৩) আগেই বলা হয়েছে, এ মাসে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের জন্য মানবজাতির জন্য আল-কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। এ মাসে রচিত হয়েছিল সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের ইতিহাসে চূড়ান্ত সংগ্রামের নতুন অধ্যায় ‘বদর যুদ্ধ’। যুগে যুগে কালে কালে সর্বাত্মক এ সংগ্রাম চলছে এবং চলবে আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকায়িত অসংখ্য মিথ্যা, অসত্য ও বাতিলের বিরুদ্ধে। আমাদের সংগ্রাম চলবে তাগুতের বিরুদ্ধে। রমজানের সাওম আমাদের মধ্যে সেই মানসিকতা গড়ে তুলুক এ প্রত্যাশাই রইল।

মিথ্যা কথা ও কাজ শব্দ দু’টির মাধ্যমে মানুষের সামগ্রিক জীবনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আল্লাহর দেয়া জীবনবিধানই সত্য, এ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য জীবনব্যবস্থা মিথ্যা। আল-কুরআন পৃথিবীর মানুষের শেষ হিদায়াতগ্রন্থ। আল-কুরআনের নির্দেশনাই একমাত্র নির্ভুল ও সত্য, এ ছাড়া অন্য সব নির্দেশনা ভুল ও মিথ্যায় পরিপূর্ণ। আল-কুরআনের আলোকে কথা বলা মানেই সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণ করা। আর এ কিতাবের আলোকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় চরিত্র সংশোধন করা মানে জীবনের সামগ্রিক ব্যাপারে ইসলামের পথ অনুসরণ করা। আল-কুরআনই একমাত্র নির্ভুল, এটিকে বাদ দিয়ে নফসের ইচ্ছানুযায়ী জীবনযাপন করা মানে অসংখ্য মিথ্যা রবের গোলামি করা। আর এটি হাদিসে উল্লিখিত মিথ্যা কাজের অন্তর্ভুক্ত।

মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সারাটি জীবন তার অভিব্যক্তিকে দু’টি পদ্ধতিতে প্রকাশ করে থাকে। এক. মুখ নামক যন্ত্র যা মৌখিক অভিব্যক্তি; দুই. অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন হাত-পা ও লজ্জাঙ্গ ইত্যাদি যা বাস্তব আচার-আচরণগত অভিব্যক্তি। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি তার পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর পরিধি ব্যাপ্ত।

রাসূল সা: এ দু’টি জিনিসের গুরুত্ব দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি প্রকৃত মুসলিম, যার মুখ ও হাত থেকে অপরাপর মুসলমান নিরাপদ।’ ‘তোমরা তোমাদের মুখ ও দুই ঊরুর মাঝখানের হিফাজতের গ্যারান্টি দাও, আমি তোমাদের বেহেশতের গ্যারান্টি দিচ্ছি।’

মানবজীবনের প্রতিদিনকার কথা ও কাজগুলো সত্য অথবা মিথ্যার ওপর পরিচালিত হয়। যাদের নফসের ওপর বিবেক শক্তিশালী তারা সত্য কথা ও কাজের ওপর টিকে থাকতে পারে। পক্ষান্তরে যাদের বিবেকের ওপর নফস শক্তিশালী বা বিজয়ী তারা মিথ্যার বেসাতি ছড়ায়। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দয়া করে আমাদের বিবেককে শক্তিশালী করার জন্য অনেকগুলো কর্মসূচি প্রণয়ন করেছেন। যেই কর্মসূচিগুলো আল্লাহ তায়ালা আল-কুরআনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। সব আনুষ্ঠানিক ইবাদত সামষ্টিকভাবে এ কাজ করে থাকে। আমরা যদি ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের দিকে গভীর মনোযোগ নিবিষ্ট করি তবে বুঝতে পারব, মানুষের বিবেককে শক্তিশালী ও জাগ্রত করে পরিপূর্ণ মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মহান আল্লাহর একেকটি কর্মসূচি কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখে। ঈমান, সালাত, জাকাত ও হজের মতো রোজাও একজন ব্যক্তিকে সারা দিনের ক্ষুধা-পিপাসার দুঃসহ জ্বালা নিবারণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ‘আল্লাহ আলিম অর্থাৎ মহাজ্ঞানী, অতিশয় জ্ঞাত বা বাছির অর্থাৎ মহাদ্রষ্টা, গভীর ও প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন’ এসব নামের ভয়ে সে সুযোগ গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে। অবিরত ও ক্রমাগত একটি মাসে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তার হৃদয়ের গভীরে আল্লাহর এমন এক ভয় অঙ্কিত হয়, যার ফলে বাকি ১১টি মাস সব ধরনের মিথ্যা কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকতে পারে। এটি এমন এক জিনিস, এমন একটি শক্তি ও সত্য-মিথ্যা পার্থক্য নিরূপণের এমন মানসিকতা, যার সাহায্যে বা যার ওপর ভিত্তি করে মানুষ অন্যায় থেকে বিরত থাকতে পারে, ন্যায় কাজের জন্য অগ্রসর হতে পারে। এ শক্তির ওপর ভর করে এবং আল-কুরআনের জ্ঞানকে পুঁজি করে মিথ্যা কথা ও কাজ পরিহার করে সত্য কথা ও কাজ করার জন্য এগোতে পারে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2