avertisements 2

বোকা বানানোর কারিগর

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৭ অক্টোবর,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:১৪ পিএম, ১০ মার্চ,রবিবার,২০২৪

Text

বাড়ির নাম দ্য প্যালেস, ঢাকা। গুলশানের ১০৪ নম্বর সড়কের এই বাড়িটি খুঁজতে খুব বেশি সময় লাগল না। নীল রঙের জিংফু মোটরবাইকটি গেটের এক পাশে রেখে সামনের চাকায় তালা লাগাতেই দারোয়ান বললেন, ‘এখানে বাইক রাখা নিষেধ। এটা প্রিন্সের বাড়ি।’ বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘ভাই, রাজপ্রাসাদের বাইরে গরিবের বাইকটা অল্প সময়ের জন্য রাখা যাবে না?’ দারোয়ান মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা রাহেন।’

বাইক রেখে ভেতরে ঢুকতেই একটি লম্বা পথ, তারপর মূল ভবনে ঢোকার দরজা। আমার আসার কথা আগে থেকে জানানো ছিল। একজন এসে ড্রয়িংরুমে বসতে বললেন। এ রকম বিশাল আকারের ঝাঁ-চকচকে ড্রয়িংরুম আমি আগে কখনো দেখিনি। ভেতর থেকে একটি সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। চারদিকের দেয়ালে অনেক ধরনের ছবি ঝোলানো, সব কটি সোনালি ফ্রেমে বাঁধা। দেয়ালের সব কারুকাজও সোনালি। দেখলে মনে হয় সোনা দিয়ে মোড়ানো। মাথার ওপর ঝুলছে ইয়া বড় বড় ঝাড়বাতি। স্যুট পরা একজন এসে বাতি জ্বালাতেই আলোর বন্যা বয়ে গেল ভেতরে। যা দেখি তাতেই বিস্ময় লাগে।

কর্নেলের সঙ্গে শেষ ফোনালাপকর্নেলের সঙ্গে শেষ ফোনালাপ
সবচেয়ে বড় বিস্ময় হলো তিনি যখন এলেন। তিনি মানে মুসা বিন শমসের। ওপর থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামলেন, সঙ্গে কয়েকজন স্যুট পরা সঙ্গী। বললেন, বলো বেটা, প্রিন্স মুসার কাছে কেন এসেছ? বললাম, একটা নিউজের জন্য আপনার বক্তব্য নিতে এসেছি। তিনি কোনো বক্তব্য দেবেন না বলে জানিয়ে বললেন, তোমার অনেক কিছু শেখার আছে, দেখার আছে। বলো, আমার সম্পর্কে কী জানো? আমি বললাম, ‘না, তেমন কিছু জানি না।’

আমার ঘোর আর কাটে না। নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগে। প্রিন্স মুসা বলেই যাচ্ছেন। তিনি আমাকে দেয়ালে লাগানো একটি কেবিনেটের কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে সারি সারি স্যুট। বললেন, এগুলো সব বিদেশি ব্র্যান্ডের, হাজার হাজার ডলার দাম। নিজের জুতা দেখিয়ে বললেন, ডায়মন্ড লাগানো জুতাও তাঁর আছে। জুতায় ডায়মন্ড থাকতে পারে, সেটা ছিল আমার কল্পনারও বাইরে। বলতে বলতে একজন কয়েকটি বাক্স টেনে আমার সামনে রাখলেন, তাতে সারি সারি জুতা রাখা। এরপর দেখালেন ঘড়ির সংগ্রহ। দুনিয়ার প্রায় সব নামী ব্র্যান্ডের ঘড়ি আছে তাঁর সংগ্রহে। বললেন, সৌদি বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী আদনান খাসোগি তাঁর বন্ধু। ৪০টি দেশে সমরাস্ত্রের ব্যবসা আছে। সুইস ব্যাংকে ১২ বিলিয়ন ডলার আছে। এসব দেখে আর শুনতে শুনতে ক্লান্ত আমি। যত দেখি ততই বিস্ময় লাগে, ঘোর না কেটে উল্টো ধাঁধা লাগে। তবে যে কাজে গেলাম, তা আর হলো না। আর একটা জিনিস লক্ষ করলাম, প্রিন্স মুসার শরীরের একটি অংশ অবশ। তিনি বাম হাত নাড়াতে পারেন না। বসার ঘরে অনেক পত্রিকা সাজানো, যার কাভার স্টোরি তাঁকে নিয়ে করা। কিন্তু এসব পত্রিকার বেশির ভাগেরই নাম কখনো শুনিনি।


কই শহীদ হলেন না যেকই শহীদ হলেন না যে
সে সময় ‘সেই রাজাকার’ নামে একটি সিরিজ ছাপা হচ্ছিল। তাতে ফরিদপুরের সাংবাদিক প্রবীর সিকদার মুসা বিন শমসেরকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিবেদনে মুসার বক্তব্য ছিল না। জনকণ্ঠ থেকে বার্তা সম্পাদক কামরুল ইসলাম আমাকে বললেন, মুসার একটা বক্তব্য নিতে হবে। প্রবীর সিকদারের রিপোর্ট পড়ে দেখি তিনি লিখেছেন, মুসা ছিলেন একাত্তরে পাকিদের সহযোগী। তাঁর পুরো নাম এ ডি এম মুসা। ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামটের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকার শমসের মোল্লার তৃতীয় পুত্র তিনি। আদি নিবাস ফরিদপুরের নগরকান্দার হিয়াবলদী গ্রামে। তাঁর পুরো জীবন রহস্যঘেরা। ইংরেজি ও উর্দুতে বাকপটু।শাহবাজ ইন্টারন্যাশনাল নামে বিদেশে লোক পাঠানোর একটি প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা শুরু করেছিলেন।

পরে খোলেন ডেটকো নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। এরশাদের আমলে তৎকালীন ফার্স্ট লেডিকে ‘ডক্টরেট’ খেতাব এনে দিয়ে আলোচনায় আসেন মুসা বিন শমসের। ১৯৮৭ সালের দিকে তিনি একটি কোরীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে লিবিয়ায় লোক পাঠাতে শুরু করেন। এভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হন। সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল তাঁর। সেই সময়ের এক মন্ত্রীপুত্রের সঙ্গে নিজের কন্যার বিয়ে দেন। ব্রিটেনের লেবার পার্টিকে বিশাল অঙ্কের চাঁদা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচিত হন মুসা। দেশি-বিদেশি অনেক জাঁদরেল সাংবাদিককেও তিনি ভুয়া তথ্য দিয়ে বোকা বানিয়েছেন।

আমি তো শীর্ষ সন্ত্রাসীর মা...আমি তো শীর্ষ সন্ত্রাসীর মা...
আমিও সে রকম বোকা বনে গেলাম। বক্তব্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরে এসে টানা তিন দিন অফিসের সবাইকে মুসার শানশওকতের গল্প শুনিয়ে গেলাম। তবে জনকণ্ঠের ‘সেই রাজাকার’ সিরিজে প্রবীর সিকদারের রিপোর্টটি ছাপা হলো মুসার বক্তব্য ছাড়াই, ২০০১ সালের ২৪ মার্চ।

সিটি রাউন্ডআপ করতে গিয়ে একদিন কানে এল বনানীর ডেটকো অফিসে শত শত তরুণের ভিড়। সেখানে হইচই হচ্ছে। গিয়ে দেখি সংবাদের সাংবাদিক হারুন উর রশীদ আগেই সেখানে হাজির। এটা সম্ভবত ২০০২ সালের দিকে। ডেটকোর ফটকের সামনে নোটিশ। তাতে লেখা: অস্ট্রেলিয়া ও লিবিয়ায় গরুর খামারের জন্য কর্মী নিয়োগ করা হবে। সেই নোটিশ দেখে যুবকেরা এভাবে ভিড় করেছেন। নোটিশ পড়ে আমাদের সন্দেহ হলো। অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশনের পলিটিক্যাল অফিসার ছিলেন হিফজুর রহমান। তাঁর কাছ থেকে জানলাম, অস্ট্রেলিয়া থেকে এমন কোনো চাহিদা আসেনি। বুঝলাম, শত শত যুবকও বোকা বনে গেছেন।

পিচ্চি হান্নানকে দিয়েই ‘হাতেখড়ি’ র‍্যাবেরপিচ্চি হান্নানকে দিয়েই ‘হাতেখড়ি’ র‍্যাবের
২০১৪ সালের নভেম্বরে মুসা বিন শমসেরের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তিনি দেশে-বিদেশে মিলে সম্পদের এক বিশাল ফিরিস্তি দিলেন। দুদকের কর্মকর্তারা সময় ব্যয় করে সেই তথ্য খুঁজতে গিয়ে হয়রান, কিন্তু সম্পদের আর হদিস পান না। দুদকের একজন সদস্য আমাকে বলেছিলেন, সম্পদের এসব তথ্য ভোগাস। তাঁর কিছুই নেই। মনে মনে ভাবলাম, আমার মতো দুদকও বোকা বনে গেল!

কয়েক দিন আগে শুনলাম ই-কমার্স নিয়ে প্রতারণার ঘটনায় ডিবি পুলিশ মুসার পরিবারকে ডেকেছে। আমার মনে হলো, মুসা এবারও সবাইকে বোকা বানাবেন। করলেনও সেটা। তিনি ডিবির কর্মকর্তাদের বললেন, সুইস ব্যাংকে তাঁর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আছে। সেই অর্থ উদ্ধার করতে পারলে পুলিশকে ৫০০ কোটি টাকা দেবেন। দুদককে ২০০ কোটি টাকা দিয়ে ভবন করে দেবেন আর দ্বিতীয় পদ্মা সেতু করে দেবেন। বলেছেন, বাংলাদেশের যে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা; এর একক কৃতিত্ব তাঁর। বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি করে দেশের উন্নয়নের স্বপ্ন প্রথমে দেখান তিনি। প্রিন্স উপাধি তাঁকে সৌদি বাদশা দিয়েছেন। বিশ্বের এক নম্বর অস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। আরও বলেন, প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে তাঁর প্রেম ছিল। মুসার এই গল্প শুনে পাশে থাকা স্ত্রী পুলিশের সামনেই মুসাকে বললেন, নিজের বানানো এসব রূপকথার গল্প নাতি-নাতনিদের শোনাবে। এবার এসব বাদ দাও। এবার পুলিশও বোকা বনে গেল।

নবজাতকের সূত্রে মিলল বাংলা ভাইয়ের খোঁজনবজাতকের সূত্রে মিলল বাংলা ভাইয়ের খোঁজ
বোকা বানানোর আরেকটি গল্প বলে শেষ করি। নৌবাহিনীর কমান্ডার মাসুদ হাসান আহমেদ একদিন আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন মুসার কাছে। আবার সেই শানশওকতের গল্প। সব শেষে তিনি আমাকে নানা ধরনের উপহারসামগ্রী দিতে চাইলেন। বললেন, যেটা পছন্দ হয় নিতে পারি। আমি শেষমেশ একটি মগ চাইলাম। খুব সুন্দর র‍্যাপিং করা একটি মগ তিনি আমার হাতে দিয়ে বললেন, `…বেটা, এটা অনেক দামি মগ। ফ্রান্স থেকে তৈরি করিয়ে আনা।'

বাসার ড্রয়িংরুমে দুই দিন মগটা পড়ে ছিল। একদিন স্ত্রীকে বললাম, এটা ফ্রান্সের মগ, মুসা বিন শমসের দিয়েছেন। ফ্রান্সের কথা শুনে স্ত্রী খুব যত্নসহকারে প্যাকেটটা খুলে উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, …ওমা, এটা তো বেঙ্গল সিরামিকের মগ!

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2