দেশে লুটপাটের আখড়া বিভিন্ন স্কুল কলেজ মাদ্রাসা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৫:০৬ পিএম, ২৯ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২০ | আপডেট: ০৭:৫০ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট। কোথাও পরিচালনা কমিটির সভাপতিসহ অন্য সদস্যরা লুটপাট করছেন। আবার কোথাও লুটপাটে খোদ অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষক নেতৃত্ব দিচ্ছেন। উভয় ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর একশ্রেণির শিক্ষক জড়িত।
মূলত শিক্ষা বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রণীত বেসরকারি স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি (এসএমসি) ও গভর্নিং বডি (জিবি) পরিচালনা বিধিমালায় সভাপতিসহ পর্ষদকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কর্মকাণ্ডের দায়ভার থেকে তাদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। শাস্তি বলতে সর্বোচ্চ কমিটি ভেঙে দেয়ার ঘটনা। এ কারণে দুর্নীতিবাজরা সেবার পরিবর্তে বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দু’হাতে অর্থ লুটে নিচ্ছেন।
এ ক্ষেত্রে চাকরি বাঁচানোর স্বার্থে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নির্দেশ মানে। আবার কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাও লুটপাটে যুক্ত হন। আর যে ক’জন প্রতিবাদ করেন তাদের নানা অপমান-অপদস্ত হতে হয়। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির (বাকশিস) সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হক বলেন, সমস্যার মূল হচ্ছে পরিচালনা কমিটি গঠন বিধিমালা। এতে সভাপতিসহ কমিটিকে অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এ ক্ষমতা খর্ব করতে হবে। পাশাপাশি কাজের জন্য সভাপতিকে দায়বদ্ধ করার ব্যবস্থা রাখা দরকার।
শিক্ষা রাজনৈতিক বিষয় নয়, তাই কমিটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের না রাখার বিধান করা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের নিয়োগ, আয়-ব্যয় ব্যাংকের হিসাব ও কমিটির মাধ্যমে সমাধা ও কোনো শিক্ষক অপরাধী হলে তার বিচার নিশ্চিত করলে প্রতিষ্ঠান থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির বেশিরভাগই দূর হয়ে যাবে।
জানা গেছে, পরিচালনা কমিটির অসৎ সদস্যদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার উন্নয়ন কাজের পরিবর্তে আর্থিক কর্মকাণ্ডে বেশি নজর রাখেন। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কমিটির পদক্ষেপ দেখা যায় কমই। অবৈধ নিয়োগ আর নামমাত্র উন্নয়নের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন অনেকে।
এই লুটপাট নির্বিঘ্ন করতে অনেকে বেছে নেন সন্ত্রাসী পন্থা। মিথ্যা মামলা বা জিডির মাধ্যমে হয়রানির রেকর্ডও আছে। কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানের প্রতিবাদী শিক্ষক-অভিভাবকদের নাজেহাল করেন। আবার কেউ শিক্ষককে কিংবা অভিভাবকের সন্তানকে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেন। দিনে দিনে এ ধরনের অন্যায়-অত্যাচার বাড়ছে। বিষয়গুলো জানার পরও রহস্যজনক কারণে বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিহ্নিতরা বারবার কমিটির সভাপতি ও সদস্যপদে মনোনয়ন পাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উল্লিখিত চিত্র সমস্যাগ্রস্ত দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই। মহাখালীর আইপিএইচ স্কুল অ্যান্ড কলেজে পরিচালনা কমিটির (জিবি) সভাপতি একেএম জসিমউদ্দিনের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ে সাবেক কমিটির ৫ সদস্য অভিযোগ দিয়েছিলেন। তাতে সভাপতির বিরুদ্ধে একগুঁয়েমি, স্বেচ্ছাচারিতা, প্রতিষ্ঠানের এফডিআর ভেঙে খরচ, অব্যবস্থাপনার দাবি করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ, জিবির অন্য সদস্যদের না জানিয়ে সভাপতি অর্থ ব্যয় করে থাকেন।
প্রতিষ্ঠানের ২৫ লাখ টাকার এফডিআর ভেঙে খরচ, রেজিস্ট্রার অনুসরণ না করেই আয়-ব্যয়, আয়-ব্যয়ের হিসাব না দেয়ার অভিযোগও করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের জিবি থেকে বরখাস্ত হওয়া সাবেক সদস্য রুনু বেগম রোববার রাতে যুগান্তরকে বলেন, সভাপতির অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় তার মেয়েকে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে তিনি মামলা করে ছাত্রত্ব ফেরত পান।
তার বর্তমান ও শ্বশুরবাড়ির ঠিকানায় পুলিশ পাঠিয়ে হয়রানি, সন্ত্রাসী দিয়ে বাসায় হামলা, রাস্তাঘাটে অপমান-অপদস্ত ইত্যাদি করা হয়। রাস্তায় হামলার চেষ্টা করলে দৌড়ে এক বাড়িতে ঢুকে রক্ষা পান। তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে নিরাপত্তাহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন বলে জানান। সরকারের বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ করা পাঁচ সদস্যের মধ্যে আরও দু’জনকে শারীরিকভাবে নাজেহাল করা হয়।
এ প্রসঙ্গে সভাপতি একেএম জসিমউদ্দিন বলেন, দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার এই স্কুলে এমন কোনো আয় নেই যা ভাগ-বাটোয়ারা করে খাওয়া যায়। ২৫ লাখ টাকা এফডিআর ভেঙে স্কুলের প্রয়োজনেই ব্যয় করা হয়েছে। প্রত্যেকটি ব্যয় কমিটিতে অনুমোদনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। আয়-ব্যয়ের রেজিস্টার অনুসরণ না করা বা হিসাব পেশ না করার অভিযোগ সঠিক নয়।
স্কুলের প্রয়োজনেই তিনি কঠোরতা অবলম্বন করেন। তিনি বলেন, রুনু বেগমের মেয়ে দুই প্রতিষ্ঠানে একইসঙ্গে পড়ায় শিক্ষা বোর্ড তার ছাত্রত্ব বাতিল করেছিল। এতে তার কোনো হাত নেই। তিনি কোনো সন্ত্রাসী লালন করেন না। এই রেকর্ড কেউ দেখাতে পারবে না। সুতরাং রুনু বেগম বা অন্য কাউকে কিংবা কারও বাসায় হামলা হয়ে থাকলে তার নেপথ্যে তিনি নন।
রাজধানীর হযরত শাহ্ আলী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে আরেকটি ঘটনা ঘটে। এ প্রতিষ্ঠানেও বিভিন্ন অনিয়ম চলছে বলে শিক্ষক-কর্মচারীদের অভিযোগ। তাদের দাবি, বিভিন্ন নিয়োগ, এমপিওভুক্তি, বেতন ইস্যুসহ নানা ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটছে। স্কুলের জায়গায় একটি ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে মার্কেট গড়া হয়েছিল।
এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। মার্কেটের দোকানের ভাড়া ঠিকমতো স্কুল তহবিলে জমা হয় কি না সেটা নিশ্চিত নন কেউই। ওই মার্কেট সংক্রান্ত কাজের পর প্রধান শিক্ষক হঠাৎ শ্যামলিতে নতুন একটি ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু করেন। আরও অভিযোগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার পরও প্রতি বছর অতিরিক্ত বই পাঠ্য করা হয়। সম্প্রতি ভবনের তৃতীয় তলায় ৩৮টি দোকান নির্মিত হয়েছে। সেই দোকান কীভাবে হল, বিক্রি হয়েছে কি না- এসব জানেন না শিক্ষক-কর্মচারীরা।
বড় অভিযোগ প্রধান শিক্ষক নার্গিস আক্তারের নিয়োগে। এই পদে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছাড়াই ২০০২ সালে নিয়োগ নেন তিনি। বিধিসম্মত না হওয়ায় সরকার তখন তাকে এ পদে এমপিও দেয়নি। ফলে সহকারী শিক্ষকের স্কেলে এমপিও নিয়ে তাকে খুশি থাকতে হয়। এরপর তিনি ২০১২ সালে সহকারী প্রধান এবং ২০১৮ সালে প্রধান শিক্ষকের এমপিও নেন। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বা প্রধান শিক্ষক পদে সরাসরি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ হওয়া দরকার ছিল। এভাবে গত কয়েক বছরে এমপিওভুক্ত অন্য শিক্ষকদের নিয়োগও খতিয়ে দেখা দরকার বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
শর্ত পূরণ না করে প্রথম নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নার্গিস আক্তার বলেন, এ কারণেই বেতন কম পেয়েছিলেন। পরে শর্ত পূরণ করায় বিধিসম্মতভাবেই তার বেতনের ধাপ উন্নীত হয়েছে। এখানে নতুন নিয়োগের দরকার ছিল না। তিনি বলেন, ২০০২ সালে তিনি দায়িত্ব নেয়ার আগেই ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে মার্কেট নির্মাণের চুক্তি হয়। তার স্বামী একটি প্রতিষ্ঠানে পরিচালক পদে চাকরি করেন। সুতরাং ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া কঠিন নয়। করোনার মধ্যে মার্কেটে দোকান নির্মাণ করেছে স্কুলের পরিচালনা কমিটি। পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে বিষয়টি সম্পর্কে তিনি জানেন না।
মাউশির উপপরিচালক এনামুল হক হাওলাদার বলেন, যোগ্যতা পূরণ না করা ব্যক্তিকে নিয়োগ করা বিধিসম্মত নয় । এ ধরনের নিয়োগের ইস্যুতে নিচের ধাপে এমপিওভুক্ত করার দৃষ্টান্ত আছে। পরে শর্ত পূরণ করলে স্কেল পরিবর্তন হয়। কিন্তু একই ব্যক্তির এমপিও দুই ধাপ অগ্রগতি পেতে পারে না। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টি বিধিসম্মত নয়।
আরও কিছু ঘটনা : দু’বছরে অন্যায়-অনিয়মের কারণে বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের (রাজনৈতিক দলের নেতা) সভাপতির নানা অন্যায়-অনিয়ম ও লুটপাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন শিক্ষকরা। দনিয়া কলেজে বিভিন্ন সময়ে ৪১ কোটি ৪০ লাখ ৯৪ হাজার টাকার অনিয়ম পেয়েছে ডিআইএ। যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজশাহী মসজিদ মিশন স্কুলে দুর্নীতি বের করেছে সংস্থাটি।
ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় জিবির ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে সালাম খান নামে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে জাল সনদে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ বাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) তদন্তে প্রমাণিত হয়। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটিকে নির্দেশনা দেয়া হলেও উল্টো এ শিক্ষককে নিজস্ব তহবিল থেকে পুষছে বলে জানা গেছে।