avertisements 2

ভয়ংকর আয়নাঘর দেখল বিশ্ব!

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৩ ফেব্রুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২৫ | আপডেট: ০৩:২৪ এএম, ২৩ ফেব্রুয়ারী,রবিবার,২০২৫

Text

ছোট একটা ঘর। মাঝখানে একটি ধাতব ইলেকট্রিক চেয়ার। সেখানে দাঁড়িয়ে একের পর এক রক্ত হিম করা নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন ভুক্তভোগীরা। কিভাবে নির্যাতনের মুখে তাদের জবানবন্দি আদায় করা হতো, তার ভয়াবহ বয়ান উঠে আসে বর্ণনায়। তাদের অনেককে বিনা বিচারে আটকে রাখা হয় বছরের পর বছর। ওই সময় অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তাদের দিন কেটেছে শুধুই মৃত্যুর প্রহর গুনে।


বুধবার সকালে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সেই আলোচিত নির্যাতন কেন্দ্র বা আয়নাঘর পরিদর্শনে যান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় ভুক্তভোগীদের কয়েকজন তার সঙ্গে যোগ দেন। এছাড়া সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা, নবগঠিত গুম কমিশনের সদস্য এবং দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

পরিদর্শন শেষে প্রধান উপদেষ্টা উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, এখানে ‘যারাই নিগৃহীত হয়েছেন, যারা এটার শিকার হয়েছেন, তারাও আমাদের সঙ্গে আছেন। তাদের মুখ থেকেই শুনলাম কীভাবে এসব হয়েছে। এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ... বিনা কারণে রাস্তা থেকে উঠিয়ে আনা হলো, বিনা দোষে কতগুলো সাক্ষী তৈরি করে কোনো একটা ঘটনায় ঢুকিয়ে দিয়ে বলা হলো-তুমি সন্ত্রাসী, জঙ্গি ইত্যাদি। তিনি আরও বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল, এই আয়নাঘর শুধু এখানেই (রাজধানীতে) যে কয়েকটা আছে। কিন্তু আজ শুনলাম এগুলোর বিভিন্ন ভার্সন সারা দেশে আছে। কেউ বলছেন ৭০০, কেউ বলছেন ৮০০ হবে। এর মধ্যে কতগুলো জানা এবং বেশ কতগুলো অজানা।’ রীতিমতো ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ (অন্ধকার যুগ)। গত সরকার যে সেই আইয়ামে জাহেলিয়া প্রতিষ্ঠা করে গেছে এটা (গোপন বন্দিশালা) তার একটি নমুনা।

ভুক্তভোগীদের বয়ান : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় এক যুবককে আটক করে আয়নাঘরে বন্দি রাখা হয়। বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে তিনি তার ওপর চালানো ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দেন। বলেন, ২০২০ সালে ফেসবুকে দুই লাইনের একটা পোস্ট দেওয়ার পরদিন থেকে তাকে অনুসরণ করা হয়। একপর্যায়ে অফিসে যাওয়ার পথে হাতিরঝিল এলাকা থেকে তাকে তুলে নেওয়া হয়। প্রথমে তাকে নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব-১১ কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে একটা গুম সেলে রাখা হয়। পরদিন রাতে তাকে ঢাকায় নিয়ে এসে একটি গোয়েন্দা কার্যালয়ের টর্চার সেল বা আয়নাঘরে বন্দি করা হয়। বুধবার সেই টর্চার সেলের মেঝেতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, এই এখানে আমাকে ঢোকানো হয়। চোখ বাঁধা ছিল। শার্ট-প্যান্ট খুলে লুঙ্গি এবং গেঞ্জি পরতে দেন তারা। পরে ঠিক কোন জায়গায় তাকে নিয়ে আসা হয়েছে তা বোঝার চেষ্টা করেন তিনি। চোখের ওপর শক্ত বাঁধন হালকা করে আশপাশের শব্দ শোনার চেষ্টা করেন। এ সময় পাশ থেকে চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ পান।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, বন্দি অবস্থায় বারবার আমার পরিবারের কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে আমার দুটো শিশু সন্তান। এদের একজনের ৭ মাস এবং একজন দেড় বছরের। তাদের কথা খুব বেশি মনে হয়। কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম। আমাকে হয়তো এরা শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলবে। পরের দিনগুলোতে আশপাশের বন্দিদের সঙ্গে আমার কথা হয়। তাদের কেউ তিন বছর এবং কেউ এক বা দেড় বছর ধরে বন্দি থাকার কথা বলেন। তাদের কেউ কেউ তাকে সান্ত্বনাও দেন।

তিনি বলেন, একটা ১৭ বছরের কিশোর। পাশের কক্ষে সে বন্দি ছিল। রাঙ্গুনিয়া থেকে ধরে আনা হয়। তাকে নিয়মিত পেটানো হতো, যতক্ষণ না তার কান্না থামত। এভাবে ছেলেটা পাগল হয়ে গিয়েছিল। পরে সব সময় সে উলঙ্গ থাকত। কিন্তু তার কি অপরাধ তা আমরা আজও জানতে পারিনি।

ড. ইউনূসের সামনে নিজের বন্দিজীবনের মর্মস্পর্শী বর্ণনা দেন জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাশেম আরমান। বিনা বিচারে তাকে ৮ বছরের বেশি সময় আটকে রাখা হয়। একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠের সামনে দাঁড়িয়ে আরমান বলেন, তাকে সার্বক্ষণিক হাতকড়া পরিয়ে রাখা হতো। প্রতিদিন চলত নির্যাতন। চরমতম দুর্ব্যবহার। যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একপর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টা তাকে সঙ্গে নিয়ে ওই প্রকোষ্ঠের ভেতরে ঢোকেন। তিনি আরমানের কাছে জানতে চান কাউকে চিনতে পেরেছিলেন কিনা-জবাবে তিনি বলেন না। তবে মাঝে মাঝে বড় কর্মকর্তারা এখানে পরিদর্শনে আসতেন। তখন প্রহরীদের অতিরিক্ত সতর্ক হতে দেখেছি। এ সময় আমাদের উলটোদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতে বলা হতো। ফলে কর্মকর্তাদের আমরা চিনতে পারতাম না। তবে তাদের গা থেকে দামি সুগন্ধি ঘ্রাণ পেতাম। ড. ইউনূস তাকে জিজ্ঞেস করেন-আপনাকে ছাড়ল কবে। আরমান বলেন, ৫ তারিখ (আগস্ট) থেকেই একটু এলোমেলো অবস্থা বুঝতে পারছিলাম। সেদিন সে (হাসিনা) পালিয়ে যায়। এর পরদিনই আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরমান বলেন, আমি জীবনে আর কখনো বেঁচে ফিরতে পারব তার কোনো আশাই অবশিষ্ট ছিল না। বন্দি জীবনে স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের কথা সব থেকে বেশি করে মনে হয়েছে।

বুধবার সকাল থেকে পর্যায়ক্রমে রাজধানীর আগারগাঁও, কচুক্ষেত এবং উত্তরা এলাকা পরিদর্শনে যান প্রধান উপদেষ্টা। একে একে র‌্যাব এবং গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে থাকা আয়নাঘর পরিদর্শন করেন তিনি। এদিন দুপুরের পর থেকেই আয়নাঘরে প্রধান উপদেষ্টার পরিদর্শনের ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসতে শুরু করে।

এসব ভিডিওতে দেখা যায়, কচুক্ষেত এলাকার প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরে (ডিজিএফআই) একাধিক টর্চার সেল এখন ফাঁকা। বেশ কয়েকটি সেলে নতুন করে রং করা হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে দেওয়াল। এছাড়া দেওয়ালে বন্দিদের হাতের লেখা, মোবাইল নম্বরসহ বিভিন্ন সাংকেতিক ভাষা মুছে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আগারগাঁওয়ে র‌্যাবের বেশ কয়েকটি সেলে জমেছে ধুলোর আস্তর। এখানকার কয়েকটি কক্ষে টাকার বান্ডিল, মদের খালি বোতল এবং বন্দিদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়।

সেখানে উপস্থিত ভুক্তভোগীদের কয়েকজন নিজেদের বন্দি জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এক কিশোরী তার মাকে দীর্ঘ ৯ বছর বন্দি রাখার কথা জানান। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এখনো তিনি তার মাকে খুঁজে ফিরছেন। শেষ পর্যন্ত জীবিত তাকে ফিরে পাবেন কিনা তাও জানেন না। তবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি মাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবেন।

একজন ভুক্তভোগী টর্চার সেলের মেঝেতে বসে দেখান কীভাবে হ্যান্ডকাফ লাগানো অবস্থায় পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হতো। এছাড়া সিলিংয়ে ঝুলিয়ে পেটানোর অভিজ্ঞতা জানান কয়েকজন। কয়েকটি টর্চার সেলের দরজায় একটি ছোট ফুটো দেখা যায়। সেখান দিয়েই বন্দিদের খাবার এবং যোগাযোগের কথা জানান ভুক্তভোগীরা।

পরিদর্শন শেষে প্রধান উপদেষ্টা উপস্থিত সাংবাদিকদের আরও বলেন, বন্দিদের ন্যূনতম মানবাধিকারও দেওয়া হয়নি। একেকজনকে খুপরির মধ্যে রাখা হয়েছে। এর থেকে তো মুরগির খাঁচাও বড় হয়। সেখানে বছরের পর বছর এভাবে রাখা হয়েছে। এসব থেকে বের করে না আনা গেলে, সমাজ টিকবে না। এজন্য নতুন করে সমাজ গড়তে হবে। অপরাধীদের বিচারের জন্য এসব প্রমাণ সংরক্ষণ করতে হবে।

আয়নাঘর পরিদর্শনকালে ভুক্তভোগী, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধি ছাড়াও আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সব আয়নাঘর খুঁজে বের করা হবে : দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রতিবেদন এবং প্রধান উপদেষ্টার আয়নাঘর পরিদর্শনের বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আজকের দিনটি একটি ঐতিহাসিক দিন। কারণ আজকে পতিত স্বৈরাচারের হাতে সংঘটিত গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের একটি স্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া আজকে প্রধান উপদেষ্টা নিজেও সেই কুখ্যাত আয়নাঘর বা টর্চার সেল পরিদর্শন করেছেন।

প্রেস সচিব বলেন, আমরা আজকে তিনটি লোকেশনের আয়নাঘর পরিদর্শন করি। তার মধ্যে দুটি র‌্যাবের এবং একটি ডিজিএফআইর। সেখানে বন্দিদের কীভাবে রাখা হতো। নির্যাতন করা হতো। কীভাবে তাদের দিন কেটেছে। তা আসলে বর্ণনা করা যায় না। এমনকি কেউ কেউ সেখানে ৭-৮ বছর কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রতিটা স্পটে গিয়েছেন। সেখানে যারা বন্দি ছিলেন তারাই ঘটনাগুলো প্রধান উপদেষ্টার কাছে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সঙ্গত কারণে সেখানে আমরা সবাইকে নিতে পারিনি। পুরো ঘটনা বিটিভির মাধ্যমে ভিডিও করা হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

তিনি বলেন, গুম কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী এবং নিরাপত্তা বাহিনী যে তদন্ত করছে তার ভিত্তিতে ধারণা করা যায় যে, সারা দেশে ৭০০-৮০০ আয়নাঘর আছে এবং এটা আরও বের হচ্ছে। তাতে বোঝা যাচ্ছে যে এটি শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছিল।

আলামত নষ্ট করে দেওয়া প্রসঙ্গে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আলামত নষ্ট করা হয়েছে কি হয়নি সেটা গুম কমিশন দেখছে। প্রসিকিউটিউররাও দেখছেন। কিছু কিছু জায়গা দেখেছি যেগুলো নতুন প্লাস্টার করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় রুম ছোট ছিল। এখন দেওয়াল ভেঙে বড় দেখানো হয়েছে। তবে এগুলো ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত সেটা গুম কমিশন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধে ট্রাইব্যুনাল বিচার করবেন। তবে প্রত্যেকটা আয়নাঘর এভিডেন্স (প্রমাণ) হিসাবে সিলগালা করে সংরক্ষিত থাকবে। ব্রিফিংয়ে উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার, অপূর্ব জাহাঙ্গীর, সিনিয়র সহকারী ফয়েজ আহমদ ও সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি উপস্থিত ছিলেন। 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2