avertisements 2

ডিবিতে বর্বর নির্যাতন চালায় হিন্দু অফিসার

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৮ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৩:৩৭ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪

Text

আধুনিক ও ধর্মীয় জ্ঞানে সমান পারদর্শী মুফতি কাজী মোহাম্মদ ইবরাহীম। ওয়াজ মাহফিলের মঞ্চ থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া এবং গণমাধ্যমে ধর্মীয় আলোচনা করে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছেন। গড়েছেন হাজারো মক্তবসহ আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর এ কারণেই আওয়ামী সরকারের টার্গেটে পড়েন বরেণ্য এই আলেম। তার মক্তব-স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি স্বাভাবিক কাজে নানাভাবে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টির পাশাপাশি নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকতেন তিনি।

গাড়িতে গুলি ও চাপা দিয়ে দুবার হত্যাচেষ্টার মুখোমুখি হন মুফতি ইবরাহীম। এরপরও ধর্মীয় তৎপরতা ঠেকাতে না পেরে একপর্যায়ে রাতের আঁধারে বাসা থেকে বিনা অপরাধে তাকে আটক করা হয়। একে একে দেওয়া হয় চারটি মামলা। ডিবিতে প্লাস ও চাকু দিয়ে হাত ও পায়ের আঙুলে নির্মম নির্যাতন করে এক হিন্দু অফিসার। পাঁচ দিন রিমান্ডসহ দীর্ঘ ১৬ মাস কারাগারের ফাঁসির সেলে কাটান মুফতি ইবরাহীম।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালানো শেখ হাসিনার সরকারের সময় এভাবেই জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন মুফতি ইবরাহীম। নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পরিবারের সদস্যরা। কারামুক্তির পরও স্বস্তিতে ছিল না তার জীবনযাত্রা। কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর অনেকটা নীরবে দেশত্যাগে বাধ্য হন পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও আল-জামেয়া ট্রাস্টের চেয়ারম্যান মুফতি ইবরাহীম। জুলাই বিপ্লবের পর সম্প্রতি তিনি দেশে ফেরেন। বর্তমানে তিনি লালমাটিয়ায় অ্যাভেরোজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমার দেশ-এর কাছে জেল-জুলুমের সেই ভয়াবহ স্মৃতি তুলে ধরেছেন তিনি।

মুফতি ইবরাহীম বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট রেজিমে দেশের আলেমরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। তাদের রাজনৈতিক কোনো অধিকার ছিল না। কোনো আলেম রাজনীতি বা রাষ্ট্রবিষয়ক ভূমিকায় থাকলে শত শত মামলা দিয়ে তাকে দমিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ কোনো স্প্রিচুয়াল (আধ্যাত্মিক) বৈঠকে বসলেও গোপন সংবাদের কথা বলে তাদের জঙ্গি-সন্ত্রাসী বা নাশকতার কথা বলে আটক করে পুলিশ। সে সময় মিডিয়া তথ্যসন্ত্রাসের মুখোমুখি হন আলেমরা। এমনকি মা-বোনরা কোথাও ধর্মীয় শিক্ষার জন্য বসলেও তাদের ধরে নিয়ে থানা-হাজতে নির্যাতন করা হয়েছে। সেখানে আলেমদের স্ত্রী-কন্যা ও আত্মীয়স্বজনরা আক্রান্ত হয়েছেন। জঙ্গির বিষয়টি ছিল শতভাগ কিস্যা কাহিনি। এটা করে তারা ইসলামি শক্তিকে উৎখাত, কলঙ্কিত ও অপমানিত করে জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে নিস্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল।

তিনি বলেন, আধিপত্যবাদীদের লক্ষ্য ছিল আলেমরা যেন এখানে জনপ্রিয় হতে না পারেন। কারণ তারা জানত যে দুটি শক্তি এই বাংলাদেশকে রক্ষা করতে পারে। একটি হলো সেনাবাহিনী, আরেকটি হলো ইসলামপ্রেমিক মানুষের জাগরণ। তাই ইসলামি ব্যক্তি, দল ও সংস্থাকে দমনে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। বক্তাদের একটি লিস্ট করে ডিবিতে প্রত্যেকের নামে আলাদা বাক্স রাখা হতো। সেখানে আমলনামার মতো তাদের বক্তব্যে দোষ-ত্রুটি ধরে ঘায়েল বা ধরপাকড়ের জন্য মনিটরিং করা হতো।

পতিত আওয়ামী সরকারের সময়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বাধা প্রসঙ্গে মুফতি ইবরাহীম বলেন, ‘আমি সারা দেশে ছয় হাজার মক্তব চালাতাম। এসব মক্তবের কাজে যেখানেই যেতাম, দেখতাম ১১/১২ জন অচেনা মুখ আমাকে ফলো করত। পরীবাগে একটি মক্তবে প্রতি মাসে আলেমরা আসতেন মক্তব পরিচালনার বিষয়ে আলোচনা করতে। হঠাৎ একদিন সেখানে পুলিশ ঘেরাও করে। বাংলাদেশের ১৩৫০ বছরের ইতিহাসে মক্তবে নির্যাতনের কোনো তথ্য আমার জানা নেই। কারণ সেখানে আলিফ-বা-তা-ছা পড়ায়। তবে আওয়ামী আমলে সেই মক্তবও ঠিকমতো চালাতে পারিনি। এ জন্য অনেক নির্যাতিত হয়েছি, পুলিশের মামলা-হামলা সয়েছি। মক্তবগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় হাজার হাজার শিশু লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হয়।’

তিনি বলেন, ‘আইসিটি আইনে আলেমদের যখন-তখন ধরে নিয়ে ডিবিতে নির্যাতন করা হতো। একজন আলেমের পা বেঁধে ওপরে ঝুলিয়ে নির্যাতন করতে দেখেছি। জেলখানায় আমার সঙ্গে ছিলেন হেফাজত নেতা আজিজুল হক ইসলামাবাদী। তাকে এত নির্যাতন করা হয়েছে যে তার কোমরের সাইডে কোনো মাংস ছিল না। পেছনে হাত বেঁধে একনাগাড়ে ছয় দিন তাকে নির্যাতন করেছে।’

বিগত সরকারের রোষানল থেকে বাদ পড়তেন না ইসলামি বক্তা এবং মসজিদের ইমাম-খতিবরা। মাহফিলে সভাপতির কথা মনমতো না বললে সেখানেই হেনস্তা করা হতো। মসজিদে খুতবা মনঃপূত না হলে খতিবকে বরখাস্ত করা হতো। এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে মুফতি ইবরাহীম বলেন, নটর ডেম কলেজের সামনে একটি বড় মসজিদে দীর্ঘ ১১ বছর খতিব ছিলেন তিনি। হঠাৎ একদিন আওয়ামী লীগ নতুন কমিটি গঠন করে তাকে পরবর্তী জুমায় আসতে নিষেধ করেন ও পুলিশের ভয় দেখান। এ রকম হাজার হাজার ইমাম বরখাস্ত হয়েছেন।

মুফতি ইবরাহীম বলেন, কয়েক বছর ধরেই তাকে টার্গেটে রেখেছিল গোয়েন্দারা। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পরপর তারা স্টাডি করে যে, মাহফিল ও গণমাধ্যমে যারা কথা বলেÑ এই শক্তিকে স্তব্ধ করতে হবে। এ জন্য তাদের টার্গেট করে মামলা দেওয়া শুরু করে। অনেকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, আমরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে যতটুকু পারতাম বলতাম।’

একবার গুলি খাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মুফতি ইবরাহীম বলেন, ‘একদিন ঢাকায় আসার পথে কাঁচপুরে গাড়ির পাশে বিশাল আওয়াজ হয়। কিছুদূর গিয়ে গাড়ি থামিয়ে দেখতে পাই, একটি গুলি বর্নাটে লেগে আয়নার ওপরের দিকে চলে গেছে। মোটা গ্লাস হওয়ায় আল্লাহ সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছেন।’

আরেক দিন গাড়িচাপা দিয়ে হত্যাচেষ্টার মুখোমুখি হন তিনি। সেই স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের দিকে যাচ্ছিলাম। টাঙ্গাইল বাইপাস পার হয়ে দেখি হঠাৎ সামনের দিক থেকে দ্রুত গতিতে একটি ট্রাক আসছে। ট্রাকের নিচে চাপা থেকে বাঁচতে আমার গাড়ির ড্রাইভার বিদ্যুৎ গতিতে পাশে খালের দিকে চলে যায়। সেখানে মাইলস্টোন ও গাছ-গাছালি ভেঙে ২৫ ফিট নিচে খালে গিয়ে পড়ি। গাড়িটা দুমড়েমুচড়ে শেষ। দু-তিন মিনিটের মধ্যে সেখানে পুলিশ হাজির হয়। তাদের দেখে বোঝা যায় যে এটা পরিকল্পিত। পরে আমাকে একটি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। সেখানে একজন আমাকে ইনজেকশন দেওয়ার চেষ্টা করেন। অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের চিনত না। এতে আমি ভয় পেয়ে যাই।’

মুফতি ইবরাহীম বলেন, ২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মসজিদে একটা খুতবা দিলাম, “স্বাধীনসমৃদ্ধ নিরাপদ বাংলাদেশ চাই।” কিছুক্ষণ পর গোয়েন্দা পুলিশ ফোন দিয়ে জানায়, আপনার নামে মামলা আছে। স্বাধীনতা কেন চাইলাম। আমাকে সব সময় নজরদারিতে রাখা হতো।’

গ্রেপ্তার হওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে আরটিভির একটি টক শোতে বক্তব্য দিয়ে তিনি বাসায় ফেরেন। হঠাৎ তার মোবাইলে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে কল আসে। পরে বাসায় দারোয়ান এসে জানায়, দুজন লোক তার সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি ধারণা করলেন যে তারা ‘র’-এর লোক। তাই তাদের সঙ্গে দেখা না করে ট্রিপল নাইনে ফোন দেন। এ ছাড়া রুমের দরজা ভালো করে আটকে ফেসবুক লাইভে আসেন। এ সময় তিনটা স্লোগান দেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, র-মুক্ত বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, হিন্দুস্তানি রাজাকার ধরধর মারমার।’

তিনি বলেন, রাত আড়াইটার দিকে শাবল দিয়ে তার রুমের দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়। এতে বাসায় সবাই কান্নাকাটি শুরু করেন। বাচ্চারা কান্নাকাটি করে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আজও তারা ঠিকমতো সুস্থ হতে পারেনি।

মুফতি ইবরাহীম বলেন, আসলে ‘র’ বর্ণচোরা। এ জন্য তারা রাতে আসে। এভাবে রাত একটা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তিনি তাদের প্রতিরোধ করেন। ফেসবুক লাইভে যখন হাজার হাজার মানুষ তার বক্তব্য দেখছিল, একপর্যায়ে ‘র’ সরে যায়। সেখানে আসে ডিবি ও থানা-পুলিশ। ভোর সাড়ে ৪টায় তাকে গাড়িতে তুলে ডিবিতে নিয়ে যায়।

ডিবিতে নেওয়ার পথে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন এই আলেম। ডিবি অফিসেও ধর্মেন্দু নামে একজন হিন্দু অফিসার তাকে একটি প্লাস দিয়ে প্রচণ্ড চেপে আঙুল থেঁতলে দেন। এতে রক্ত জমে যায়। ছয় মাস লাগে তা সারতে। আরেকটা চাকু নিয়ে তার পায়ের আঙুলে খোঁচা দেন ওই অফিসার। অন্য অফিসাররা রুমে না থাকার সুযোগে হিন্দু অফিসার তাকে নির্যাতন করেন। ডিবিতে তার হাতকড়া পরানো ছিল। নামাজের জন্য কিছুক্ষণ তা খুলে দেওয়া হয়। আটকের পর পাঁচ দিন রিমান্ডে ছিলেন তিনি।

অবশ্য তিনি বেশি নির্যাতিত হন জেলজীবনে। কেরানীগঞ্জের সেই জেলজীবন সম্পর্কে মুফতি ইবরাহীম বলেন, ‘সাধারণ একটি মামলার আসামি হলেও আমাকে রাখা হয় ফাঁসির সেলে। সাত মাস সেখানে বন্দি ছিলাম। আলো নেই, রোদ নেই। ধীরে ধীরে চুল পড়তে শুরু করে। অষ্টম মাসে সকালে ও বিকালে আধঘণ্টা করে বের হওয়ার অনুমতি পাই। এভাবে ১৬ মাস কারাগারে কেটেছে আমার জীবন।’

তিনি বলেন, আটকের সময় তার নামে কোনো মামলা ছিল না। ধরে নিয়েই তার স্কুলের এক পার্টনারকে দিয়ে জোর করে একটি প্রতারণার মামলা করায়। পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন ধারায় চারটি মামলা দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ১৯ জানুয়ারি কারামুক্ত হন মুফতি ইবরাহীম।

দেশত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জেল থেকে বের হওয়ার পরও তাকে ১২/১৩টা হুমকি দেয় ‘র’ থেকে। তাকে সরাসরি হিট করারও ঘোষণা দেওয়া হয়। এ অবস্থায় অনেকে তাকে দেশ থেকে চলে যেতে পরামর্শ দেন। একপর্যায়ে ২০২৩ সালের রমজান মাসে বিদেশে চলে যান তিনি। মুফতি ইবরাহীম বলেন, ‘বিমানবন্দর পার হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় ছিলেন। গোপনীয়তার জন্য পরিবারকেও বিদেশযাত্রার বিষয় জানায়নি। সব ধাপ পার হয়ে বিমানে ওঠার পর পরিবারকে জানান। সবাই তখন কান্নাকাটি করছিল। প্রথমে সৌদি আরবে গিয়ে তিন মাস ছিলেন। পরে কাতারে এক বছর ও দুবাইয়ে পাঁচ-ছয় মাস ছিলেন। সেখান থেকে ফের সৌদি আরব হয়ে দেশে ফিরে আসেন।
ad

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2