কিশোর গ্যাং আর ‘কিশোর’ নেই
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৯:৫২ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
‘কিশোর গ্যাং’। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় প্রত্যেকটি জনপদে এক আতঙ্কের নাম। ক্ষমতা প্রদর্শন করতে তুলনামূলক কম বয়সী কয়েকজন মিলে পাড়া বা মহল্লায় বিভিন্ন নামে বাহিনী গড়ে তুলছে। মূলত হিরোইজমের চিন্তাভাবনা থেকে কিশোরদের মধ্যে গ্যাং কালচার শুরু হলেও এখন তারা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, ধর্ষণ, মাদক কারবার, জমি দখলে সহায়তা এবং যৌন হয়রানির মতো ভয়ংকর সব অপরাধেও জড়িয়ে পড়েছে। এমনকি জড়াচ্ছে ব্যাংক ডাকাতি বা চলন্ত বাসে উঠে শিশুর গলায় ছুরি ধরে ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায়ও। আর তাদের এসব কর্মকাণ্ড সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কিন্তু নামে ‘কিশোর গ্যাং’ হলেও এসব অপরাধী চক্রের বেশিরভাগ সদস্যই এখন আর কিশোর নয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ৪০ শতাংশই কিশোর। দেশে বর্তমানে দুইশর বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে। যাতে রয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি সদস্য।
আর দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, নামে কিশোর গ্যাং হলেও এসব অপরাধী চক্রের বেশিরভাগ সদস্যের গড় বয়স ১৮ বছরের বেশি। অবশ্য এসব গ্রুপে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সীরাও রয়েছে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের প্রত্যেকটির সদস্যদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট। তাদের রয়েছে আলাদা আলাদা দলীয় নাম, জমায়েতের স্থান, ড্রেস কোড ও চুলের স্টাইল, চালচলনও ভিন্ন তাদের। দলের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং স্কুল বা কলেজপড়ুয়া। নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবারের এবং লেখাপড়া না জানা কিশোর-তরুণও রয়েছে এসব দলে।
পুলিশ বলছে, ‘কিশোর গ্যাং’ নাম দিয়ে অনেক অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে। ‘কিশোর গ্যাং’ বললে গ্রেপ্তারের পর আদালতেও এসব অপরাধী চক্রের সদস্যরা ‘কিশোর’ হিসাবে পরিচয় পায়। তখন তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা যায় না।
অপরাধ বিশেজ্ঞরা বলছেন, ত্রুটিপূর্ণ সামাজিকীকরণ, নেতৃত্ব ও ক্ষমতার আকাঙ্খাক্ষা, সামাজিক বৈষম্য ও বঞ্চনা, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের গ্যাংয়ের জন্ম দিচ্ছে। সম্প্রতি কিশোর অপরাধের মাত্রা যেভাবে বাড়ছে, তা নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রয়োজনে কিশোর কারাগার ব্যবস্থা চালু এবং কিশোর সংশোধন কেন্দ্রগুলোকে আরও সময়োপযোগী করে সংশোধন কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষম কাঠামো গড়ে তোলা দরকার। কিশোর গ্যাং নির্মূলে পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
গত বুধবার রাতে রাজধানীর সায়েদাবাদে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মো. কামরুল হাসান (২৩) নামে এক তরুণ নিহত হন। এই ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হলে জানা যায় তাদের বয়স ১৮ বছরের কম। তার অর্থ আইনের দৃষ্টিতে তারা শিশু। এ বিষয়ে গতকাল শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মফিজুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিহত তরুণের কাছ থেকে নগদ অর্থ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিতে চায়। নিহত কামরুল হাসান ছিনতাইকারীদের বাধা দেওয়ায় তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ছিনতাইকারী রোহান তার হাতে থাকা ধারালো চাকু দিয়ে কামরুলের বুকে আঘাত করে।’
গত ১৫ ডিসেম্বর রাজধানীর মগবাজারে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত হাবিবুল্লাহ (১৮) নামে এক যুবকের চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়। এই ছিনতাইয়ের ঘটনায়ও জড়িত ছিল কিশোর গ্যাং সদস্যরা। এছাড়া ৫ আগস্টের পরে শুধু রাজধানীর মোহাম্মদপুরেই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষে তিন মাসে ১০ জন খুন হয়েছেন। এভাবে দিনে দিনে কিশোর অপরাধে বাড়ছে ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি। তবে থানা পুলিশ বলছে, ‘কিশোর গ্যাং’ নাম দিয়ে অনেক অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ এলাকায় ব্যাংক ডাকাতি চেষ্টার ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে দুজনের বয়স ১৬ বছর এবং একজনের ১৮ বছর। তারা সিনেমা দেখে ডাকাতির পরিকল্পনা করে বলে পুলিশের তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য নগরবাসী দায়ী করছেন পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাকে। তারা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পুলিশের প্রতি মানুষের ক্ষোভ ও আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ৫ আগস্ট। হামলা, লুট, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল থানাসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায়। এসব সহিংসতায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য প্রাণও হারিয়েছেন। অন্তর্বতী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিন পর পুলিশ সদস্যরা কাজে ফিরলেও তাদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা কাটেনি। সহায়তার জন্য সেনাসদস্যরা থাকলেও পুলিশ সদস্যরা এ শঙ্কার কারণে পুরোদমে মাঠে সক্রিয় হচ্ছেন না। আর এর সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা, অবনতি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বিগ্ন নগরবাসীর ফেইসবুকে দেওয়া পোস্টেও উঠে আসছে কিশোর গ্যাংয়ের বেপরোয়া হওয়ার চিত্র। মাজহারুল ইসলাম মহসিন নামে একজনের ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে দেখা গেছে, যানজটে স্থবির সড়কে চাপাতি হাতে ঘুরছে তিন যুবক। একপর্যায়ে একটি প্রাইভেটকারের আরোহীর মোবাইল ফোন জানালা দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায় তারা। গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর আসাদ গেট এলাকায় ঘটে এমন ঘটনা। একই সড়কে ১৮ ডিসেম্বর রাতের আরেকটি ছিনতাইয়ের ঘটনার দৃশ্যের ভিডিও ক্লিপ নিজের ফেসবুক আইডির টাইমলাইনে শেয়ার করেন জুনায়েদ চৌধুরী নামে আরেকজন।
তিনি লিখেন, ‘এটা স্পষ্ট, তবে এত অল্প সময়ের মধ্যে ঘটনাটি ঘটেছিল। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সিগন্যালের সামনে এক মধ্যবয়সী নারী ছিনতাইয়ের শিকার হন।’ পরদিন ওই সড়কেই এক ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরার ঘটনার দৃশ্যের ভিডিও ক্লিপ নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেন রাইয়ান আহমেদ রাজু নামে রাজধানীর এক বাসিন্দা।
কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য শুরুর প্রথম দিকে ২০১৫ সালের ২৭ মে উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে গ্যাংয়ের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে খুন হয় অনিক নামে এক কিশোর। এরপর ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরায় ‘ডিসকো বয়েজ’ ও ‘নাইন স্টার’ নামে দুটি কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে খুন হয় নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। মূলত আদনান হত্যার পরই কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি আলোচনায় আসে। আর এরপর অনুসন্ধানে নেমে উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশত কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পায় পুলিশ ও র্যাব।
কিশোর-তরুণদের অপরাধে জড়ানো থেকে নিবৃত্তে পারিবারিক বন্ধনের উপর গুরুত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের বেশিরভাগ পরিবারের সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের তেমন মনোযোগ নেই। সন্তান কী করছে? কার সঙ্গে মিশছে? তা জানা যেমন জরুরি, তেমনি সন্তানকে সময় দেওয়াটাও জরুরি। তার সঙ্গে গল্প করা, তার মনের অবস্থা বোঝা, তার কাছে বাবা-মার অবস্থান তুলে ধরা। সহজ করে বললে অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানদের বন্ধন খুবই জরুরি। এই বন্ধন যত শিথিল হয়, সন্তান তত বাইরের জগতে ছুটবে, তখন তাকে ফেরানোর কোনো রাস্তা থাকবে না।’
কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি রোধে কয়েকটি বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করেন এই সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক। তিনি বলেন, ‘কিশোররা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলেও বয়সের কারণে তাদের শাস্তির আওতায় আনা যায় না। তাদের পাঠানো হয় কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে। কিন্তু সেখানে গিয়ে অনেকেই সংশোধিত হওয়া তো দূরের কথা, তারা আরও ভয়ঙ্কর অপরাধী হয়ে বেরিয়ে আসে। দেশের বাস্তবতায় কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সংশোধনের সুযোগ রেখে আইন প্রয়োগ, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধকরণ, সামাজিক অনুশাসনের পরিধি বৃদ্ধি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্র বাড়াতে হবে। পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও বন্ধু-বান্ধব কিশোরদের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে।’
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মাদ তালেবুর রহমান দেশ রূপন্তরকে বলেন, ‘কিশোর নয়, ডিএমপি এলাকায় যেকোনো অপরাধ হলে আমরা তাদের গ্রেপ্তার করি। কিশোর গ্যাংয়ের স্পটগুলো চিহ্নিত করে অভিযান চালানো হবে। তবে অপরাধীকে কিশোর বলে চিহ্নিত না করে অপরাধী বলে চিহ্নিত করতে হবে।’
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা নিয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) এনামুল হক সাগর বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি। দ্রুতই কিশোর অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে। তবে অপরাধীকে কোনো বয়সে চিহ্নিত না করে অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করাই ভালো।’