ভারতের কারণে ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন ভাঙছে লাখো বাংলাদেশির
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪ | আপডেট: ০৯:২৮ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
পরিবারের হাল ধরতে ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে শেফের কাজ শিখেছেন সোলায়মান। ক্রোয়েশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানে পেয়েছেন চাকরিও। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ক্রোয়েশিয়ার ভিসা পাওয়ার কোনো মাধ্যম না থাকায় তাকে পাশ্ববর্তী কোনো দেশের ক্রোয়েশিয়া দূতাবাসে যেতে হবে। কিন্তু সম্প্রতি ভারতেরও ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পড়েছেন বড় জটিলতায়। বাধ্য হয়ে চেয়েছিলে নেপাল গিয়ে ভিসা জোগাড় করতে। কিন্তু বিধি বাম, বিমানবন্দর থেকে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেনঢাকার ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। সোলায়মানের এই বিফল বিদেশযাত্রার স্বপ্ন ভেঙেছে পুরো পরিবারের। দু:খে-কষ্টে সেদিনই দুনিয়া ছেড়েছেন তার বৃদ্ধ বাবাও।
সোলায়মান বাংলাভিশকে বলেন, আমি বিদেশ যেতে ঋণ করেছি, জমি বিক্রির প্রস্তুতি নিয়েছি। ইতোমধ্যে অনেক টাকা খরচও করে ফেলেছি। আবার বিদেশ যেতে না পারলেও ঠিকই ট্রাভেল এজেন্সির টাকাও দিতে হবে। আমার সময় আছে আর মাত্র ১০ দিন। আমার এই ক্ষতির দায় কে নেবে?
সেরা ট্যুর প্যাকেজ
অনেক সাধনার পর রোমানিয়ার বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি অব বোখারেস্টে ভর্তিযুদ্ধে টিকেছেন ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ফাহিম। আদায় করেছেন সেমিস্টার ফিসহ সব খরচও। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তার রোমানিয়ায় পৌঁছানোর কথা থাকলেও ভিসা জটিলতায় এখনো যেতে পারেননি সে দেশে। বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক অনুরোধ করে এক সেমিস্টার অনুমতি নিতে পারলেও সেই সময়ও শেষের পথে। এখন ভর্তি বাতিলের শঙ্কায় এই কিশোর।
ইউনিভার্সিটি অব বোখারেস্টের ছাত্র আব্দুর রহমান ফাহিম বলেন, আমি অনেক টাকা লগ্নি করেছি। ইতোমধ্যে আমার একটা সেমিস্টার গ্যাপ গেল। ফেব্রুয়ারির আগে পৌঁছাতে না পারলে ভর্তিই বাতিল হয়ে যাবে। আমি এখন কি করবো হতাশায় ভুগছি।
শুধু সোলায়মান বা ফাহিম নয়, বাংলাদেশে দূতাবাস বা ভিসা সেন্টার না থাকায় এমন ভোগান্তিতে ভুগছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেতে আগ্রহী হাজারো মানুষ।
শুভ নামের একজন শেফ বলেন, আমি নর্থ মেসেডোনিয়ায় যাওয়ার জন্য ঋণ নিয়েছি। কিন্তু আমার ঋণের কিস্তি শুরু হয়ে গেছে অথচ আমার যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। এখন আমি একদিকে কিস্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছি অন্যদিকে আমার ওয়ার্ক পারমিট বাতিলের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বাংলাভিশনের গুগল নিউজ ফলো করতে ক্লিক করুন
ইউরোপগামীদের নিয়ে কাজ করা ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বলছে, বাংলাদেশে দূতাবাস বা ভিসা সেন্টার না থাকায় সম্পূর্ণ ভারত বা নেপাল নির্ভর হতে হচ্ছে বাংলাদেশের ইউরোপগামীদের। এতে যেমন বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে অন্যদিকে চরম হয়রানিরও শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশিরা।
ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে বিয়ন্ড বর্ডার স্টাডি সলিউশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির সিইও সোহেল এম আরাফাত বলেন, আমরা সেপ্টেম্বর সেমিস্টারে রোমানিয়ায় যেতে ইচ্ছুক ৭০ শিক্ষার্থী নিয়ে কাজ করাছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র তিনজনকে ভিসার জন্য এম্বাসি ফেস করতে ভারতে পাঠাতে পেরেছি। সেই তিনজনের আইলটিস পয়েন্ট অনেক ভালো ছিল কিন্তু অদৃশ্য কারণে তারাও রিফিউস হয়েছে। এমনটা আর কখনো হয়নি। আমরা চাই ভিসা প্রসেসিং আমাদের দেশ থেকে হোক তাহলে এই শঙ্কাটা কমে যাবে।
ড্রিমস্টার ইন্টারন্যাশনাল লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রেমথ খন্দকার বলেন, ভারতে গিয়ে এম্বাসি ফেস করতে একেকজন ব্যক্তিকে শুধু ভারতের ডাবল এন্ট্রি ভিসাই মেনেজ করতে হয় ৫০-৬০ হাজার টাকায়। তারপর ভারতে থাকা, খাওয়া বহু খরচ। একেকজনকে পার্সপোর্ট জমা দিয়ে তিনমাস ভারতে বেকার বসে থাকতে হয়। এইসব কারণে ইউরোপগামীদের খরচ অনেক বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশে ইউরোপের দেশগুলো দূতাবাস করতে না পারলেও কনস্যুলেট অথবা ভিসা সেন্টার অন্তত করা হোক। তাহলে ইউরোপগামীদের খরচ অর্ধেক কমে আসবে, ভোগান্তিও কমবে।
ভিসা নিতে প্রতিবেশী দেশে যাওয়ার এই পদ্ধতি মানবপাচার ও অর্থ পাচারেরও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে জানিয়ে দ্রুত বাংলাদেশে ইউরোপের দেশগুলোর দূতাবাস বা ভিসা সেন্টার চালু করতে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাগর ওভারসীস সলিউশন এর কর্নধার শহিদুল ইসলাম সাগর বলেন, বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ভিসা আবেদনের সুযোগ না থাকায় অনেক দিক থেকে সমস্যা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন বিপুল পরিমান ডলার ব্যায় হচ্ছে অন্যদিকে ডলার পাচারও হচ্ছে। পার্শবর্তী দেশে ভিসা নিতে যাওয়া ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রচুর ডলার পার্শবর্তী দেশে পাচার হচ্ছে। একইসঙ্গে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মানবপাচারও হচ্ছে। তাই সমাধান করতে হলে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ভিসা পাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।
বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ভিসা পাওয়ার মাধ্যম তুলে ধরে তিনি বলেন, সরাসরি দেশগুলো দূতাবাস বা কনস্যূলেট সেন্টার করা না গেলেও ভিএফএস গ্লোবালের মাধ্যমে সব দেশের ভিসা প্রসেসিংয়ের ব্যবস্থা করণ অথবা বাংলাদেশে ইউরোপের যেসব দেশের দূতাবাস আছে সেগুলোতে তাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্য আলাদা কর্নার তৈরির অনুরোধ করা অথবা জুমে ভিসাপ্রত্যাশীদের ইন্টারভিউ নিয়ে ডিএইচএল এর মাধ্যমে পার্সপোর্ট আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে দেশের টাকাও বাঁচবে ভোগান্তিও কমবে।
ইউরোপ ভিসা প্রত্যাশী ঐক্য পরিষদের উপদেষ্টা ও আইকনিক ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল এর সিউও মো. সোহেল রানা বলেন, ভারতে ভিসা নিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হলেও ভিসা পায় এমন সংখ্যা কম, অথচ প্রতি বছর অন্তত ৫ লাখ মানুষকে ভিসার জন্য ভারত-নেপালে গিয়ে টাকা ঢেলে আসতে হয়। তাই আমরা চাই আমাদের সরকার এখনি উদ্যোগ নিক ইউরোপের যেসব দেশে আমাদের শ্রম বাজারের সুযোগ আছে সেসব দেশের ভিসা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে পাওয়ার ব্যবস্থা করুক।
এজেন্সিগুলোর তথ্য বলছে, বর্তমানে ভিসা জটিলতায় আটকে আছে ইউরোপগামী লক্ষাধিক যাত্রী। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ জানতে বার বার চেষ্টা করা হলেও কথা বলতে রাজি হননি পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা।