সমুদ্রসৈকতের বালুচরকে খাস জমি বানিয়ে বসুন্ধরাকে বরাদ্দ দেয় আ.লীগ সরকার
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ অক্টোবর,শুক্রবার,২০২৪ | আপডেট: ০৭:০৭ এএম, ১৬ সেপ্টেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৫

এ যেন সুকুমার রায়ের হ য ব র ল’র মেটামরফসিস। ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল। খুলে বলা যাক। দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপ বসুন্ধরাকে চট্টগ্রামের একটি সমুদ্রসৈকতের বালুচর শ্রেণির জমিকে নথিপত্রে খাস/খাই দেখিয়ে বরাদ্দ দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার চর বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের তিনটি মৌজা থেকে সমুদ্রসৈকতের ৪৭০ একর জায়গা বরাদ্দ দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেখানে পেট্রোক্যামিকেল পণ্য, তেল শোধনাগার, এলপিজি প্ল্যান্ট ও একটি পোর্ট টার্মিনাল করতে চায় বসুন্ধরা।
আর এই বরাদ্দ দিতে গিয়ে তড়িঘড়ি করে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ভূমি মন্ত্রণালয়। এই কারণে জায়গাটির বাজারমূল্যের তিনগুণ কম দামে পায় বসুন্ধরা গ্রুপ। মৌজা রেট অনুযায়ী বালুচর শ্রেণির (সৈকত) খাসজমির ৪৭০ একরের বর্তমান মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২৩৫ কোটি টাকা (২০১৭-১৮ সালের মৌজার মূল্য অনুযায়ী)। শ্রেণি পরিবর্তনের কারণে সেটা মাত্র প্রায় ৫৫ কোটি টাকায় দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্ত দেওয়া হয় বসুন্ধরাকে। আর ভূমির এ শ্রেণি পরিবর্তন করায় সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয় প্রায় ১৮০ কোটি টাকার।
চলতি ২০২৩-২৪ সালের মৌজা মূল্য অনুযায়ী অবশ্য প্রতি শতক সমুদ্রসৈকতের বালুচর শ্রেণির জায়গার দাম ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজারের মধ্যে। সে অনুযায়ী ৪৭০ একর জায়গার বাজারমূল্য দাঁড়ায় ২৫৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে প্রতি শতক খাস জমির মৌজা মূল্য পড়ছে ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে। শ্রেণি পরিবর্তন করে খাসে পরিণত করায় বর্তমান মৌজার বাজার মূল্যে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে ১৬১ কোটি টাকা ৭৯ লাখ টাকা।
যেভাবে শুরু হয় সৈকতকে খাস বানানো
বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর সমুদ্রসৈকতের বালুচর শ্রেণির ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেন ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট। আবেদনে বন্দোবস্তি চাওয়া ভূমির সঙ্গে বসুন্ধরা গ্রুপের ক্রয়কৃত সম্পত্তি আছে বলে জানান তিনি। তিনি উল্লেখ করেন আওয়ামী লীগ সরকারের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সমুদ্রসৈকতে পেট্রোকেমিক্যাল, রিফাইনারি কমপ্লেক্স, কনডেনসেট ফ্র্যাকশনেশন রিফাইনারি স্থাপনের কাজ শুরু করেছেন।
এ জন্য তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা অনুমোদন দিয়েছেন বলে আবেদনে উল্লেখ করেন তিনি। জাতীয় স্বার্থে কর্মসংস্থান ও জাতীয় সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার প্রয়োজনে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্তের জন্য অনুরোধ করেন সায়েম সোবহান।
তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ভূমি মন্ত্রণালয়ের খাসজমি-১ শাখা থেকে চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হয়। ঠিক পরের দিন দ্রুততার সঙ্গে সীতাকুন্ড উপজেলার তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায় কানুনগো আর সার্ভেয়ার দিয়ে নড়ালিয়া, বোয়ালিয়া ও চর বাঁশবাড়িয়া মৌজার প্রতিবেদন ও মতামত নেন। প্রতিবেদনে ২৫৫.৭৭ একর সমুদ্রসৈকতকে খাস শ্রেণিতে পরিবর্তন করা যেতে পারে বলে মন্তব্য দেন কানুনগো আর সার্ভেয়ার।
৯ জানুয়ারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায় সে প্রতিবেদন সুপারিশসহ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠান। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক চর বাশঁবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ, সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ভূমি শ্রেণি পরিবর্তনের গণবিজ্ঞপ্তি দেন এবং এ বিষয়ে কারো কোনো আপত্তি আসেনি দাবি করে শ্রেণি পরিবর্তন করে নেন।
তৎকালীন সীতাকুন্ড উপজেলার ইউএনও মিল্টন রায় এখন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত আছেন। কিসের ভিত্তিতে সৈকতের বালুচরকে খাস দেখিয়ে শ্রেণি পরিবর্তনের মতামত দিলেন জানতে চাইলে তিনি সরাসরি তা অস্বীকার করেন এবং দাবি করেন, তার আমলে বসুন্ধরাকে সীতাকুন্ডে জমি দেয়া বলে জানান।
পরে তার স্বাক্ষর সম্বলিত শ্রেণি পরিবর্তনের নথির কপি তাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হলে তিনি বাংলা আউটলুককে বলেন, ‘বসুন্ধরা তাদের কেনা জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করেছিল। আমার সময়ে কোন শ্রেণি পরিবর্তন হয়নি৷’
তাহলে কিসের ভিত্তিতে সৈকতকে খাস দেখিয়ে শ্রেণি পরিবর্তনের সুপারিশ করে সরকারকে ১৮০ কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত করলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মতামতের ভিত্তিতে শ্রেণি পরিবর্তন হয়েছে কিনা সেটা আগে দেখে তারপর মন্তব্য করতে পারব।’ কিন্তু মতামত কিসের ভিত্তিতে দিলেন সে বিষয়ে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
মিল্টন রায় বদলি হন ২০২১ সালে। এরপরে আসা সীতাকুন্ড উপজেলার ইউএনও শাহাদাত হোসেন ও এসি ল্যান্ড আশরাফুল আলমও একই মতামত দেন।
এদিকে, চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান এখন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের দায়িত্ব পালন করছেন। ভূমির শ্রেণির পরিবর্তনের বিষয়ে কথা বলতে গত সোমবার (৭ অক্টোবর) সারাদিন তাকে ফোন দিলেও ফোন রিসিভ হয়নি। শ্রেণি পরিবর্তন করে জমির মূল্য ১৮০ কোটি টাকা কমানোর কারণ জানতে চেয়ে লিখিত বার্তা দিয়ে তার মন্তব্য চাইলেও তিনি সাড়া দেননি।
অন্যদিকে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের খাসজমি-২ শাখার দায়িত্বে থাকা যুগ্ম সচিব এম এম আরিফ পাশা বাংলা আউটলুককে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’
তিনি প্রতিবেদককে জনসংযোগ কর্মকর্তা বা সচিবের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। জনসংযোগ কর্মকর্তা আহসানুল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে তার কোনো তথ্য জানা নেই।
আর ভূমি সচিবকে ফোন করা হলেও ফোন রিসিভ না হওয়ায় তার বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত : নানা দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে ২০২২ সালের অক্টোবরে শ্রণি পরিবর্তন করা হয়। ডিসেম্বরে বরাদ্দ দেওয়া হয়। জায়গার মালিক এখন বসুন্ধরা। কিন্তু এখনো প্রভাবশালী এ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীটি ভূমির দখলে যায়নি।
আরও পড়ুন
এই বিভাগের আরো খবর

তরুণরা সক্রিয় থাকলে কোনো সমস্যাই অমীমাংসিত থাকতে পারে না : প্রধান উপদেষ্টা

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিএনপির ‘সদিচ্ছা’ দেখতে চায় এনসিপি, আজ ফের বসবে কমিশন

লন্ডনে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর আ.লীগের নেতা-কর্মীদের হামলার চেষ্টা

ভারতে বসবাসকারী অবৈধ বাংলাদেশিদের বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত ঘোষণা
