কক্সবাজারবাসীর স্বপ্ন পূরণের দিন
আইকনিক রেলস্টেশন উদ্বোধন, কক্সবাজারে ছুটবে ‘স্বপ্নের রেলগাড়ি’
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ নভেম্বর,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:৩৫ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন। ছবি : সংগৃহীত
আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, তারপরই উদ্বোধন করা হবে দোহাজারী- কক্সবাজার রেলপথে স্বপ্নের ট্রেন চলাচল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার (১১ নভেম্বর) কক্সবাজারে নবনির্মিত আইকনিক স্টেশনে এই রেলপথ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন।
কক্সবাজার শহরের ঝিলংজায় ঝিনুকের আদলে তৈরি এশিয়ার সর্ববৃহৎ আইকনিক রেল স্টেশনকে সাজানো হয়েছে মনোরমভাবে। এখানে যাত্রা শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে নতুন একটি ট্রেন।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রেলপথ
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রেলপথ ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার পথ বৃটিশ আমলে তৈরি। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি হাতে নেয় বর্তমান সরকার। এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার বিবেচনায় গৃহীত একটি মেগাপ্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় সংস্কার করা হয়েছে শতবর্ষী কালুরঘাট সেতু।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন জানান, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণে মেগাপ্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পে ১০২ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।
প্রকল্পে যা আছে
দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার, রামু থেকে কক্সবাজার ১৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হয়েছে। রেলপথে স্টেশনের সংখ্যা থাকছে নয়টি। এগুলো হলো—সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়ার সাহারবিল, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও, রামু, কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও ঘুমধুম। এতে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম থাকবে নয়টি, ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম থাকবে নয়টি। সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে সেতু। এ ছাড়া ৪৩টি ছোট সেতু, ২০১টি কালভার্ট, সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় একটি ফ্লাইওভার, ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং এবং রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দুটি হাইওয়ে ক্রসিং রয়েছে।
মনোমুগ্ধকর আইকনিক রেলস্টেশন
কক্সবাজার শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর নির্মিত হচ্ছে আইকনিক রেলস্টেশন। ঝিনুকের আদলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এই স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা ভবনটির কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। আইকনিক রেল স্টেশন দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছেন বিপুল মানুষ।
রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন গত বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) ও পরদিন শুক্রবার কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প এবং আইকনিক স্টেশন ভবন পরিদর্শন করেছেন। প্রকল্পের উদ্বোধন সম্পর্কে তিনি সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনাও প্রদান করেছেন।
রেলমন্ত্রী বলেন, ‘কক্সবাজারে ট্রেনে করে আসার জন্য সারা দেশের মানুষ ভীষণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে। এই রেলপথ পর্যটন শিল্পে আমূল পরিবর্তন আসবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সবর জন্য গর্বের একটা বিষয় কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন ভবন। এ রকম অনন্য স্থাপনা অন্য কোথাও নেই। ঝিনুকের আদলে তৈরি স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিং ইত্যাদি ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। পর্যটকরা স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখে সারাদিন সমুদ্র সৈকতে বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে পারবেন। এই স্টেশন দিয়ে দিনে ৪৬ হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করতে পারবেন।’
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার আবদুল জাবের মিলন বলেন, সমুদ্র সৈকত থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা এলাকায় ২৯ একর জমিতে ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্টেশন। আইকনিক এই স্টেশনটি নির্মাণে চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী এবং ছয় শতাধিক লোক কাজ করছে। চার বছরের শ্রমে অনন্য সুন্দর রেলস্টেশন ভবনটি আজ দৃশ্যমান।
রেলমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এই স্টেশন হবে এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয়তলা স্টেশন। এতে রয়েছে পর্যটকদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। পর্যটকরা যেন কক্সবাজারে দিনে এসে ঘুরে আবার ফিরে যেতে পারেন, সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। স্টেশনে রাখা হচ্ছে লাগেজ ও লকার সিস্টেম। এ ছাড়া থাকছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা। স্টেশনের নিচতলায় থাকছে টিকেট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কেন্দ্র, লকারসহ নানান সুবিধা। দ্বিতীয় তলায় শপিংমল ও রেস্তোরাঁ। তিন তলায় থাকবে তারকা মানের হোটেল। থাকছে মসজিদ, শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র ও চলন্ত সিঁড়ি। এখনে থাকছে এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথসহ নানান সেবা কেন্দ্র।’
বদলে যাবে কক্সবাজার
হাজারো লোক প্রতিদিন কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশনে দেখতে আসছেন। রেলস্টেশনে কথা হয় শিক্ষক শফিউল আলমের সঙ্গে। তিনি স্থানীয় পোকখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কক্সবাজারে ট্রেন আসায় উচ্ছ্বসিত শিক্ষক শফিউল আলম। তিনি বলেন, ‘স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। আমার বাপ-দাদারা ট্রেনে চড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম যায়নি। এখন আমি ও আমার সন্তানরা ট্রেনে চড়ে যাব। এটা অনেক আনন্দের।’
কক্সবাজার পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, ‘স্বপ্নের রেল এখন পর্যটন শহর কক্সবাজারে। এই রেলপথ বাংলাদেশের উন্নয়নে যুগান্তকারী ঘটনা। বৃটিশ, পাকিস্তানের সুদীর্ঘ সময় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশত বছরে যা হয়নি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার তা করে দেখালেন। এই রেলপথ কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিপূর্ণতা দেবে। বিদেশি পর্যটক আনতে সহায়ক হবে। শুধু শীতকালে নয়, বর্ষাসহ সারা মৌসুম পর্যটকরা কক্সবাজার ভ্রমণে উৎসাহিত হবেন।’
আয়াছুর রহমান বলেন, সহজ রেল যোগাযোগের কারণে কক্সবাজার এলাকায় উৎপাদিত পণ্য—মাছ, শুঁটকি, লবণ, পান, সবজিসহ নানান পণ্য পরিবহণ ও বিদেশে রপ্তানির সুযোগ বাড়বে। কক্সবাজারসহ দেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসবে।’
কক্সবাজার-রামু আসনে সংসদ সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমল বলেন, ‘দোহাজারী- কক্সবাজার রেল চালু হলে পর্যটকদের যাতায়াত যেমন সহজ হবে। পাশাপাশি স্বল্প সময়ে ও কম খরচে কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ পরিবহণ করা যাবে। এতে কক্সবাজারের পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।’
এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘এই রেলপথ মিয়ানমার, চায়নাসহ এই অঞ্চলের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের হাব হবে। আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। কক্সবাজার এলাকায় ব্যাপক হারে বিনিয়োগ হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।’
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন বলেন, ‘প্রকল্পের অধীনে ১০২ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক বসানো হয়েছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথে ৩৯টি ব্রিজ এবং আন্ডারপাসসহ ২৫১টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। কক্সবাজারে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক স্টেশনসহ নয়টি স্টেশনের নির্মাণ কাজ শেষ। এছাড়াও চুনতি এলাকায় একটি আন্ডারপাসের ওপর দিয়ে হাতি চলাচলের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’
সুবক্তগীন জানান, ২০১০ সালে ৬ জুলাই দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মেগাপ্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে টেন্ডার হলে দোহাজারী-চকরিয়া এবং চকরিয়া-কক্সবাজার (লট-১ ও লট-২) এই দুই লটে চীনা প্রতিষ্ঠান সিআরসি (চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন) ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান তমা কনসট্রাকশন প্রকল্পের নির্মাণ কাজ পায়। কার্যাদেশ দেওয়ার পরপর ২০১৮ সালে এই মেগাপ্রকল্পের কাজ শুরু হয়।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার : সর্বনিম্ন ভাড়া হবে ৫৫ টাকা
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পথে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ট্রেন চলাচলের সময় এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এর আগেই নতুন রুটে ভাড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে পর্যটন শহর কক্সবাজারে ট্রেনে করে যেতে লাগবে সর্বনিম্ন ৫৫ টাকা আর সর্বোচ্চ ৬৯৬ টাকা। শোভন চেয়ারে (নন-এসি) বসে যেতে দিতে হবে ২০৫ টাকা। নতুন নির্মিত এই রেললাইনে ট্রেনের ভাড়া বাসের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম হবে। অনেক ক্ষেত্রে বাসের তুলনায় অর্ধেকেরও কম হবে।’
নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেনের ভাড়া ঠিক করা হয়েছে। রেলওয়ের মার্কেটিং শাখা থেকে ৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনে ভাড়া চূড়ান্ত করা হয়। তবে এই রুটে কয়টি ট্রেন চলবে, কোন সময়ে চলবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। রেল ভবনের নির্দেশনা পেলে তা ঠিক করা হবে।’
নাজমুল ইসলাম আরও বলেন, ‘চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে দোহাজারী পর্যন্ত আগে থেকেই রেললাইন আছে। ২০১৮ সালে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেললাইনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। নতুন নির্মিত রেললাইন ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই রেললাইনে মিটারগেজের পাশাপাশি ব্রডগেজ ট্রেনও চলাচল করতে পারবে। এই ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। নতুন রেললাইনে নয়টি স্টেশন রয়েছে।’