avertisements 2

মার্কিন ব্যাংকের ধস থেকে আমরা কী শিক্ষা নেব

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৮ মার্চ,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ১২:৫৯ পিএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪

Text

গত সপ্তাহে বেশ সকালেই একটি ফোন পাই এক সিনিয়র শুভার্থীর কাছ থেকে। এত সকালে আমি ঘুম থেকে আজকাল উঠতে পারি না। ঘুম ঘুম চোখে হ্যালো বলতেই ওদিক থেকে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠস্বর। তার জিজ্ঞাসা, আজকের কাগজ দেখেছেন? আমি বললাম, না। ঘুম থেকে উঠে পড়ব।

তিনি বেশ উদ্বেগের কণ্ঠে বললেন, আমাদের ব্যাংকগুলোর অবস্থা কী? প্রশ্ন করেই বললেন, আজ আমেরিকায় দ্বিতীয় একটি ব্যাংক ব্যবসা বন্ধ করল। আগের (২০০৮) একটি ব্যাংকের ঘটনা ধরলে এটি যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম ব্যাংক ধস। ২০০৮ সালে বন্ধ হওয়া ব্যাংকের নাম ছিল ‘ওয়াশিংটন মিউচুয়াল ব্যাংক’। এবার প্রথমে যে ব্যাংকটি লালবাতি জালাল, তার নাম ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’। কয়েকদিনের মাথায় দ্বিতীয় যে ব্যাংকটি এবার লালবাতি জালাল, তার নাম ‘সিগনেচার ব্যাংক’। বিশাল স্টোরি এসব ধসের ওপর।

শুভার্থী এসব খবর দিয়ে একটি কাগজ পড়তে পরামর্শ দিলেন এবং কাতর কণ্ঠে একটি বাংলাদেশি ব্যাংকের নাম বলে জিজ্ঞাসা করলেন এর অবস্থা কী? বেশ উদ্বিগ্ন তিনি। বিদেশে অবস্থানরত তার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বারবার জানতে চেয়েছে ওই ব্যাংকের অবস্থা কী। কারণ, তার বহুদিনের সঞ্চয়ের সব টাকাই ওই ব্যাংকে। অতএব তার আত্মীয়টি গভীর উদ্বেগের মধ্যে আছে। এ উদ্বেগ আরও বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দুই ব্যাংক ধসের ঘটনায়।

তার জিজ্ঞাসা, যেসব দেশে এত নিয়মনীতি মানা হয়, বস্তুত যেখান থেকে ব্যাংকিং নিয়মনীতির জন্ম হয়, সেখানে ব্যাংকে ধস দেখা দিলে আমাদের অবস্থা কী হবে? সেসব দেশে তো খেলাপি ঋণের সমস্যা আছে বলে আমরা জানি না। সেখানে ব্যাংকে সুশাসনের অভাব আছে বলেও জানা যায় না। ব্যাংকের মালিক কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে সেখানে তো ব্যাংকের টাকা লুট করে না। বরং সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যাংকব্যবস্থা অনেকটা আদর্শস্থানীয়। ওইসব ব্যাংক চালায় বিশ্বের প্রথম শ্রেণির ব্যাংকাররা, যারা বড় বড় ও নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিল।

এসব ব্যাংকারের নাম শুনলেই আমাদের মাথা ‘নত’ হয়ে যায়। তারা বেতনভাতা পায় পর্বতসমান-মিলিয়ন মিলিয়ন (এক মিলিয়ন সমান দশ লাখ) ডলার। আবার উপরের কর্তারা বেতনের বাইরে পায় বোনাস-কমিশন। এসবের অঙ্ক শুনে আমাদের রীতিমতো ভয় পেয়ে যেতে হয়। তাদের দেশে নিয়মনীতি কঠোরভাবে পালিত হয়। বাজার অর্থনীতির ‘ঠাকুরদা’ দেশ তারা। তারা অবাধ বাণিজ্য চায়। অবাধ অর্থনীতি চায়। দুনিয়ার সব দেশ তাদের নিয়মনীতি স্কুলছাত্রের মতো অনুসরণ করুক, তারা তা-ই চায়। আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার মাধ্যমে তারা তাদের পছন্দের নীতি আমাদের দিয়ে গ্রহণ করায়।

আবার আমাদের দেশেও তাদের অনুকরণ করার মতো লোকের/সরকারের অভাব নেই। তাদের অনুসরণ করে আমরা এখন ‘অ্যাসিস্টেন্ট জেনারেল ম্যানেজার’ (এজিএম) বলি না-বলি ‘অ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট’ প্রভৃতি। বলি ‘চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার’ (সিইও)। শুনছি এখন থেকে কোম্পানির নামের পেছনে ‘লিমিটেড’ শব্দ ব্যবহৃত হবে না-হবে ‘লিমিটেড লায়াবিলিটি কোম্পানি’ (এলএলসি)। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ‘যাহা আমেরিকা তাহা বাংলাদেশ’। ‘ফ্লোর’ হবে ‘লেভেল’। ‘টয়লেট’ হবে ‘ওয়াশ রুম’ প্রভৃতি।

সবই বুঝলাম, প্রশ্ন-ওইসব আদর্শ দেশেই যদি ব্যাংকে ধস নামে, তাহলে আমাদের ভরসা কোথায়? যাদের অন্ধের মতো অনুসরণ করছি, যাদের মতো করে নিয়মনীতি বানাচ্ছি, তাদের দেশেই যদি ব্যাংকে ব্যাংকে হাহাকার হয়, তাহলে আমাদের ব্যাংকগুলোর অবস্থা কী হবে? আমাদের ব্যাংক ব্যবসা তো এমনিতেই নানা সমস্যার মধ্যে আছে। হাজার হাজার সমস্যা। সমাধানের কোনো ইঙ্গিত নেই। সবই চলছে, চলবে মতো করে। ‘সবকিছু ঠিক হ্যায়’-এই হচ্ছে ভাব। তাহলে উপায়? উপায় কী হবে তা পরের কথা। এ মুহূর্তে বোঝা দরকার দুটি ব্যাংক কেন ‘লালবাতি’ জালাল? এর থেকে আমরা কি কোনো শিক্ষা নিতে পারি? এটি জরুরি প্রশ্ন।

প্রথমেই আসি সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের কথায়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম বৃহৎ ব্যাংক-২০০ বিলিয়ন (এক বিলিয়ন সমান শতকোটি) ডলারের সম্পদ এ ব্যাংকের। ব্যাংকটির জন্ম ১৯৮৩ সালে। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তারা ব্যবসা করছিল এতদিন। নতুন নতুন ব্যবসা, যাকে এখন বলা হয় ‘স্টার্টআপ’, তারা ছিল তাদের বড় বড় গ্রাহক। টেক কোম্পানিরও প্রিয় ব্যাংক সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি)। স্টার্টআপ ও টেক কোম্পানিগুলো দুই-তিন বছর ধরে প্রচুর ব্যবসা করে আসছে। প্রচুর ‘ক্যাশ’ তাদের। সব রাখছে এসভিবিতে। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের রমরমা ভাব। তারা ওই টাকা কী করবে? বিনিয়োগ করে রেখেছে আমেরিকা সরকারের বন্ডে। সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ। বন্ডগুলো দীর্ঘমেয়াদি।

এদিকে হঠাৎ করে টেক কোম্পানি/স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোর ব্যবসা কমতে থাকে। তাদের ‘ক্যাশ’ দরকার। তারা আমানত তুলছে, তুলছে তো তুলছেই। হঠাৎ এই ধাক্কা এসভিবি সামলাতে পারছিল না-তাদের এত ‘ক্যাশ’ হাতে নেই। অতএব তারা ‘বন্ড’ ভাঙাতে শুরু করে। শেয়ারবাজারে ‘বন্ডের’ দাম পড়ে যায়। আরও বিপদ হয় সুদহার পরিবর্তনে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ‘ফেডারেল রিজার্ভ’ (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) নীতি সুদহার (পলিসি রেট) বাড়াতে থাকে। অবিরাম বাড়াতে থাকে মূল্যস্ফীতি ঠেকানোর জন্য। এখন সমস্যা হচ্ছে, ‘ফেড রেটের’ সঙ্গে ‘বন্ডের’ বাজারের সম্পর্ক বিপরীতমুখী। ‘ফেড রেট’ কমলে বন্ডের বাজার চাঙা, আবার বাড়লে বন্ডের বাজার মন্দা।

এ সমস্যার মধ্যে পড়ে এসভিবি ক্যাশের চাহিদা মেটাতে বাজারে শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেয়। আর যায় কোথায়? আমানতকারীরা মনে করে, ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। তারা লাইন ধরে আমানতের টাকা তুলতে থাকে। বলা বাহুল্য, এমন অবস্থায় দুনিয়ায় কোনো ব্যাংক টিকতে পারে না। সব আমানতকারী যদি তাদের টাকা একসঙ্গে তুলতে যায়, তাহলে চাহিদা মেটানোর মতো অবস্থা ব্যাংকের থাকে না। কারণ ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা বসিয়ে রাখে না-খাটায়, সুদ আয় করে এবং তা আমানতকারীদের দেয়।

এই যে ঘটনা বর্ণনা করলাম, এর মূলে কী ইস্যু? মূলে রয়েছে চিরায়ত একটা ইস্যু। ‘বোরোয়িং শর্ট’ এবং ‘লেন্ডিং লং’। আমানত নেওয়া হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি, যা যখন-তখন পরিশোধ করতে হবে। আবার এর বিপরীতে ঋণ দেওয়া হচ্ছে দীর্ঘদিনের জন্য। একে বলে ‘মিসম্যাচ অব ফান্ড’। এটি মারাÍক একটা ব্যাধি। যখন-তখন বিপদ ডেকে আনতে পারে। এসভিবির ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। তারা স্টার্টআপ/টেক কোম্পানিগুলো থেকে আমানত নিয়েছে স্বল্পমেয়াদি।

অথচ এর বিপরীতে ঋণ দিয়েছে অর্থাৎ সরকারি বন্ড কিনেছে দীর্ঘমেয়াদি। এ অবস্থায় যখন আমানতকারীদের উত্তোলন চাহিদা বেড়েছে, তখন ব্যাংক আর ওই চাপ সহ্য করতে পারেনি। এখন কথা হচ্ছে, এখান থেকে আমাদের শিক্ষা কী?

আমাদের ব্যাংকগুলোর অনেক সমস্যা আছে। অনেক সমস্যার আলোচনা প্রতিদিন খবরের কাগজে হচ্ছে। কিন্তু যে বিষয়টি খুবই কম আলোচিত, তা হচ্ছে ‘মিসম্যাচ’ সমস্যা। আমাদের ব্যাংকগুলোর আমানত স্বল্পমেয়াদি। বিশাল পরিমাণ আমানতের মেয়াদ দুই বছরের নিচে। আজকাল মানুষ ঘনঘন সুদের হার পরিবর্তনের কারণে তিন মাসের জন্য মেয়াদি আমানত ব্যাংকে রাখে। অথচ এর বিপরীতে আমাদের ব্যাংকের কর্তারা কী করছেন? তারা শিল্পঋণ দিচ্ছেন, যা দীর্ঘমেয়াদি।

আবার প্রকল্প/শিল্পঋণের বিপরীতে ‘ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল’ দিতে হয়। ওটা আবার নানা কারণে দীর্ঘমেয়াদি ঋণে পরিণত হয়। এমনকি ‘লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিপ্ট’-এর (এলটিআর) টাকা হরহামেশা দীর্ঘমেয়াদি ঋণে পরিণত হচ্ছে। এটি ঘটছে দীর্ঘদিন ধরেই। দেশে শিল্পে ঋণ দেওয়ার জন্য দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক ছিল : বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস)।

খেলাপি ঋণে দুটি প্রতিষ্ঠানই ডুবে যায়। এখন দুটি প্রতিষ্ঠান নেই, এর বদলে হয়েছে ‘বাংলাদেশ ডেভেলপম্যান্ট ব্যাংক লি.’ (বিডিবিএল), যা একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। এ শূন্যতা কীভাবে পূরণ করা হয়? বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নামানো হয় শিল্প ঋণে, দীর্ঘমেয়াদি ঋণে। এখন এটি একটি বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে ব্যাংক ব্যবসায় বড় বড় সমস্যার জন্ম হচ্ছে। এটি অনেকেই বলেছেন।

এমনকি অর্থমন্ত্রী মহোদয় পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে বলেছেন কয়েকবার। এবার দেখছি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও একই কথা বলছেন। অথচ এর কোনো বিহিত দেখা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা মূলধন/চলতি মূলধনের জন্য শেয়ারবাজারে যাচ্ছেন না। তারা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে পেয়ে বসেছেন। ওখানে গেলেই তারা ঋণ পেয়ে যান। সরকারের নীতি এর জন্য দায়ী নয় কি? সরকারি নীতি হচ্ছে ‘ব্যাংক ফিন্যান্স-লেড গ্রোথ’। শিল্পায়নের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ দেবে। এই নীতি যে আমাদের কত ক্ষতি করছে, এতদিনে তা সবার টের পাওয়ার কথা। ব্যাংকগুলোর নাম ‘বাণিজ্যিক ব্যাংক’ (কমার্শিয়াল ব্যাংক), তাদের করার কথা ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থায়ন।

অথচ তারা এখন বড় বড় ব্যবসায়ীদের শিল্পে/প্রকল্পে ঋণ দিতেই আগ্রহী। এক সময়ে না হয় তা দরকার ছিল-এটা মেনে নিলেও এখন কি আর তার দরকার আছে? বড় বড় ব্যবসায়ীর প্রচুর টাকা আছে। অনেকের বিদেশেও আছে বলে শুনি। তারা নিজেদের প্রয়োজন নিজেরাই মেটাতে পারেন। যেতে পারেন শেয়ারবাজারে। না তা হচ্ছে না। কবে হতে তাও কেউ জানে না। ভেতরে ভেতরে যা ক্ষতি হওয়ার হচ্ছে। এবার এসভিবি থেকে শিক্ষা নিয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিন।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2