স্থিতিশীল ডলারের দাম বৃদ্ধি
রিজার্ভ বাড়াতে গিয়ে চাপে ডলার বাজার
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৮ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪ | আপডেট: ০৯:১৭ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
রেমিট্যান্সে দর বেড়ে ১২৫ টাকা ৪০ পয়সা
আইএমএফের শর্ত পরিপালনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কিনছে ডলার। এর প্রভাবে দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকা ডলারের দর বাড়ছে। বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে এখন ১২৫ টাকা ৪০ পয়সা দরে ডলার কিনছে কোনো কোনো ব্যাংক। অবশ্য বাজার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেনার পাশাপাশি রমজান সামনে রেখে আমদানি বৃদ্ধিও ডলারের দর বৃদ্ধির একটি কারণ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে ডলারের বাড়তি দর মূল্যস্ফীতির ওপর আরও চাপ তৈরি করতে পারে।
ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, আইএমএফের শর্ত মেনে চলতি ডিসেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে উদ্বৃত্ত ডলার কেনা হচ্ছে।
আবার রমজান সামনে রেখে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এলসি খোলায় উৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে দেশের মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে। এ সময় ডলারের দর আরও বাড়লে মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়তে পারে। যে কারণে ডলারের দরে খুব একটা ওঠানামা হোক, তা চায় না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ডলার দরে ওঠানামা না থাকায় প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বেচাকেনায় নিলাম পদ্ধতি চালুর বিষয়ে আলোচনা করছে। যদিও এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে অর্থ পাচার ঠেকাতে নানা কঠোরতা আরোপের কারণে হুন্ডি অনেক কমেছে। যে কারণে চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রেমিট্যান্সে ২৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আবার রপ্তানি বেড়েছে ১২ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কেনার পাশাপাশি আগের অনেক দায় পরিশোধের ব্যবস্থা করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ ডিসেম্বর আইএমএফের বিপিএম৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। গত ১১ ডিসেম্বর যা ছিল ১৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। এর আগে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) দেড় বিলিয়ন ডলার পরিশোধের পর গত ১১ নভেম্বর রিজার্ভ নেমেছিল ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে। বিগত সরকারের শেষ দিকে প্রতি মাসে গড়ে ১৩০ কোটি ডলার করে রিজার্ভ কমছিল। বিপিএম৬ থেকে আগামী একবছরের দায় বাদ দিয়ে নিট রিজার্ভের হিসাব হয়। বর্তমানে নিট রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের কম রয়েছে। ফলে আইএমএফ নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য গ্রস রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, অনেক দিন ধরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি হচ্ছে না। উল্টো বাজার থেকে কেনা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে চাপে ফেলে ডলার কিনছে, তেমন নয়। যেসব ব্যাংকের কাছে উদ্বৃত্ত ডলার রয়েছে, তারাই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করছে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন সবচেয়ে নিরাপদ। যে কারণে কোনো কোনো ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছে বিক্রি না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে করছে। আবার এখন রিজার্ভ বাড়ানো দরকার বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিনছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা সমকালকে বলেন, চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ডলারের দর সামান্য বেড়ে থাকতে পারে।
বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, রমজানকে সামনে রেখে এখন বড় অনেক এলসি হচ্ছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইছে আগের বকেয়া যেন না থাকে। এসব কারণে ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এর বাইরে এখন বড় এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো প্রবাসীদের সব ডলার কিনে ফেলছে। তারা বাড়তি দর চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে কিছু করার থাকছে না। আগে ছোট ছোট এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে দর কষাকষি করা সহজ ছিল। চাহিদা বাড়লেই ডলারের দর বৃদ্ধিওর এটিও এখন একটি কারণ।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের পরবর্তী কিস্তি ছাড়ের আগে বিভিন্ন শর্তের অগ্রগতি পর্যালোচনায় একটি টিম এখন ঢাকা সফর করছে। আজ বুধবার এই টিমের বৈঠক শেষ হচ্ছে। জানা গেছে, সংস্থার প্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন ডলারের দর ১২০ টাকায় স্থিতিশীল থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ডলার দর আরও কীভাবে বাজারভিত্তিক করা যায়, সে পরামর্শ দিয়েছে। তারা চায় এমন একটি ব্যবস্থা করা হোক যেন ডলারের দর ওঠানামা করে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে এখন ডলারের দর স্থিতিশীল আছে। এর পরও আরও বাজারভিত্তিক করার জন্য নতুন পদ্ধতি চালু করা হতে পারে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর ডলার বেচাকেনায় নিলাম পদ্ধতি অনুসরণ করা হতে পারে। যদিও এ বিষয়ে এখনও বিস্তারিত কোনো রূপরেখা চূড়ান্ত হয়নি।
জানা গেছে, বেসরকারি একটি ব্যাংক গত ১৫ ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের লুলু ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ১২৫ টাকা ৪০ পয়সা দরে ডলার কিনেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেশির ভাগ এক্সচেঞ্জ হাউসের দর ছিল এ রকমই। অন্য দেশের এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো এখন ডলার কিনছে ১২৪ টাকায়। যদিও ‘ক্রলিং পেগ’র বিদ্যমান নিয়মে একটি ব্যাংক সর্বোচ্চ ১২০ টাকায় ডলার বেচাকেনা করতে পারে। এদিকে খোলাবাজারেও ডলারের দর বেড়ে ১২৫ টাকায় উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে যা ১২৩ থেকে ১২৪ টাকা ছিল। অবশ্য বাড়তি দর প্রবাসীরা পাচ্ছেন না। চাহিদা বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো এভাবে দর বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার সংকটে থাকা অনেক ব্যাংক ডলার পেতে বাড়তি দর অফার করছে।
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ উঠেছিল ২০২১ সালের আগস্টে। তখন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার। তবে করোনা-পরবর্তী অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় ডলার বিক্রি করলেও দর ঠেকানো যায়নি। আবার অনেক ধরনের বকেয়া পরিশোধ না করে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে ওই সময়ে ডলার বিক্রি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ড. আহসান এইচ মনসুর গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে রিজার্ভ থেকে আপাতত কোনো ডলার বিক্রি করছে না। যে কারণে রিজার্ভ বাড়ছে।