ট্রানজিটের সুফল পায়নি বাংলাদেশ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪ | আপডেট: ১০:২০ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে বেশ টানাপড়েন যাচ্ছে। সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভারতের একটি রাজ্য বাংলাদেশের সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধের হুমকি দিয়েছে। এতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে ট্রানজিট সুবিধায় সুফল আসেনি।
প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে খাদ্য ও শিল্পপণ্য আমদানিতে নির্ভরতা থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিকল্পও তৈরি হয়েছে।
শুরুতে কিছুটা ভুগতে হলেও পরে সেগুলোর সমাধান হয়েছে। বিশেষ করে গরু আমদানির উদাহরণকে সামনে এনে তারা স্বনির্ভর হওয়ার তাগিদ দিয়েছে।
এদিকে বেনাপোল স্থলবন্দর সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর থেকে দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের ধস নেমেছে।
ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার।
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ভারতে এখন রপ্তানি করে কমবেশি দুই বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ পণ্য। ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১৪ বিলিয়ন ডলার।
ভারত থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি আগস্ট মাসে ২৮ শতাংশ কমে গেছে।
এ মাসে বাংলাদেশে ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের আগস্টে ছিল ৯৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রকাশ করা পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এসব তথ্য দিয়েছে।
দুই দেশের বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ হয়ে থাকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে। বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, জুলাই মাসের চেয়ে আগস্ট মাসে বেনাপোল দিয়ে আমদানি কমেছে সোয়া তিন কোটি কেজির বেশি। একই সঙ্গে রপ্তানি কমেছে প্রায় সাড়ে সাত লাখ কেজি।
আখাউড়ায় কমেছে ৬৮১ টন। হিলি বন্দর দিয়ে আমদানি নেমেছে অর্ধেকে। অন্য বন্দরগুলো দিয়েও আমদানি-রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
গত চার মাসে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১৮ লাখ ৩০ হাজার ৩৪ মেট্রিক টন পণ্য কম আমদানি হয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে রপ্তানি কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৬২ হাজার মেট্রিক টনে। ডলার সংকট, দেশে বিরোধীদের ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থবিরতার কারণে কমেছে দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য।
তবে আমদানি কমলেও রাজস্ব আয় বেড়েছে আকস্মিকভাবে। যদিও চার মাসে চলতি অর্থবছরে ২১০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় বেড়েছে। গত অর্থবছরে একই সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছিল এক হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় রাজস্ব আয়ও বেড়ে গেছে।
বেনাপোল কাস্টম হাউস সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ছয় হাজার ৭০৫ কোটি টাকা।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শামছুর রহমান জানান, বৈশ্বিক মন্দা, ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এলসির সংখ্যা কমিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে এলসি করতে শতভাগ মার্জিন প্রথা চালু করায় আমদানি কমে যায়। বর্তমানে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি হয় দীর্ঘমেয়াদি ও পারস্পরিক চাহিদার ওপর। সে ক্ষেত্রে ভারত সরকারের কোনো নীতিনির্ধারক মহল বা বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার থেকে এখনো তেমন বক্তব্য আসেনি।
কেউ কেউ রাজনৈতিক বক্তব্য দিলেও সেসব অঞ্চলে বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি হিস্যা উল্লেখযোগ্য কিছু নয় বলে মনে করেন বাণিজ্য বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, শিল্পের কাঁচামালের বড় অংশ ভারত থেকে এলেও এরই মধ্যে এর বিকল্প বাজার তৈরি হয়েছে। আর প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের যেসব কৃষিপণ্য নির্ভরতা আছে, সেসব পণ্যের জন্যও খুব শিগগিরই কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আগামী চার-পাঁচ মাস দেশের কৃষিপণ্যর ভরা মৌসুম। এর পরও পেঁয়াজ, রসুন ও আলুর পর্যাপ্ত উৎপাদন এবার বেশি হবে মনে করছেন কৃষি খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর পরও ভারত নেতিবাচক উদ্যোগ নিলে বিকল্প বাজার রয়েছে। যদিও বড় প্রতিবেশী দেশ হিসেবে কম সময়ে দেশটি থেকে দ্রুত পণ্য নিয়ে আসা যায়। এ ছাড়া ভারত তাদের পণ্য রপ্তানি বন্ধ করলে সমান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
সম্প্রতি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা আগরতলায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দেন। তিনি বলেছেন, প্রতিবেশী বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থগিত করার বিবেচনা করছে ত্রিপুরা।
জানতে চাইলে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, বাণিজ্য হলো দুই দেশের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার বিষয়। উভয় দিক থেকে লাভবান হওয়ার সুয়োগ না থাকলে সেখানে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদি হয় না।
ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক পাঁচ দশকের বেশি সময়ের। উভয় পক্ষ একে অপরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার। আর ভারতের যে রাজ্য থেকে রাজনৈতিক বক্তব্যে দেওয়া হয়েছে, সেই রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে আমদানি রপ্তানির হিস্যা উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নয়।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বৈশ্বিক মন্দা, ডলার সংকট, সরকার পরিবর্তনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা ছন্দঃপতন ঘটেছে। ব্যবসায়ীরা দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন মাত্র। আবার ডলারের উচ্চমূল্য আমদানির জন্য একটি বড় ধরনের বাধা। তবে আমরা আশাবাদী, সামনের দিনগুলোতে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে গতি ফিরে আসবে।’
ভারত-বাংলাদেশ চেম্বর অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (আইবিসিসিআই) তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘাটতি ছিল ১০.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতের থেকে বাংলাদেশ প্রধানত খাদ্যদ্রব্য, কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি আমদানি করে, আর বাংলাদেশ থেকে ভারত রপ্তানি করে গার্মেন্টস, চামড়াজাত পণ্য ইত্যাদি।
দুই দেশের বাণিজ্য নিয়ে জানতে চাইলে আইবিসিসিআইয়ের একজন সাবেক সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভারত যদি বাংলাদেশকে বাণিজ্যিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে, তাহলে বাংলাদেশের আমদানি খরচ বাড়বে। কারণ বিকল্প উৎস থেকে পণ্য আমদানি করা হতে পারে, যাতে সময় বেশি লাগবে এবং ব্যয়বহুল। সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পর হঠাৎ করে দেশে পেঁয়াজের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
এ ব্যাপারে কৃষি অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, একসময় বেশ কিছু কৃষিপণ্য ভারত নির্ভরশীলতা থাকলেও এটা কমতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বিকল্প বাজারও তৈরি হয়েছে। তাই ভারত বাংলাদেশে তাদের কৃষিপণ্য রপ্তানি বন্ধ করলেও সহসা তেমন প্রভাব পড়বে না।
আখাউড়া স্থলবন্দরে চার মাস ধরে আমদানি বন্ধ!
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি হয় পাঁচ কোটি ৭৬ লাখ ৫৮ হাজার ৭১৮ টাকার পণ্য। চলতি বছরের ওই সময়ে এ বন্দর দিয়ে কোনো ধরনের পণ্য আমদানি হয়নি। অর্থাৎ চার মাস ধরে আমদানিশূন্য আখাউড়া স্থলবন্দর।
আখাউড়া স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. হাসিবুল হাসান সোমবার সকালে কালের কণ্ঠকে জানান, এই বন্দর দিয়ে আমদানি প্রায় শূন্যের কোঠায়। তবে রপ্তানি বাণিজ্যে যদিও তেমন কোনো প্রভাব নেই।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এক হাজার ৫৯০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।
বাংলাদেশের যেসব পণ্য ভারতে যায়
বেনাপোল বন্দর সূত্র জানায়, বন্দর হয়ে বাংলাদেশ থেকে পাট, পাটজাতদ্রব্য, সাবান, গার্মেন্টস-সামগ্রী, ব্যাটারি, মাছ, কেমিক্যাল, এসি ও ফ্রিজ রপ্তানি হয় ভারতে। গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে তৈরি পোশাক ও পাট।
ত্রিপুরায় পণ্য রপ্তানি
বাংলাদেশ ত্রিপুরা থেকে ভাঙা পাথর, ভুট্টা, আগরবাতি, আদা, শুকনা মরিচ, সবজির বীজ এবং কাঠ আপেল আমদানি করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় মাছ, সিমেন্ট, খাদ্যপণ্য, স্টিল, পিভিসি পাইপ, কোমল পানীয় এবং তুলার বর্জ্যসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করা হয়।
উৎস: কালেরকন্ঠ