avertisements 2

দুর্গাপূজার অর্থনীতি

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৩ অক্টোবর,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:৩৮ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪

Text

হাজার বছর ধরে বিশ্বের সব অঞ্চলেই ধর্মীয় উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এর ভাবগত বিষয়টি প্রধান হলেও অর্থনৈতিক গুরুত্বটিও কম কিছু নয়। এর মাধ্যমে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পায়, মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি হয়, মানব মনে সহিষ্ণুতা জাগে, এ বিষয়গুলো অবশ্যই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এবং এর গুণগত বিষয়গুলো নিয়ে ধর্মীয় গবেষক ও পণ্ডিতরা বিশদভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারেন।

এর বাইরে এ উৎসবগুলোর ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের যে গতিশীলতা দেখা দেয়, তা উপেক্ষা করার মতো নয়। ধর্মীয় উৎসবগুলোকে উপলক্ষ্য করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন, তা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এ উৎসবগুলোতে সব আর্থিক সংগতিপূর্ণ মানুষেরই তার স্বাভাবিক দিনের চেয়ে কিছুটা হলেও বাড়তি ব্যয় করার প্রবণতা থাকে। এ বাড়তি ব্যয় অর্থনীতি তথা ব্যবসা-শিল্পে বাড়তি গতি সঞ্চারিত করে। ফলে অর্থনীতিতে চাঙাভাব সৃষ্টি হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের দুই ঈদ, খ্রিষ্টীয়দের বড়দিন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা ইত্যাদি সব ধর্মীয় উৎসবই অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের একাধিক ধর্মীয় উৎসব থাকলেও, আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতার দিক থেকে দুর্গাপূজাই বড় আসনটি দখল করে রেখেছে।

গত ১৪ অক্টোবর শুভ মহালয়া দিয়ে এ বছরের দুর্গাপূজার যাত্রা শুরু হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২৪ অক্টোবর প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হবে হিন্দু সম্প্রদায়ের এ বছরের সবচেয়ে বড় উৎসব। ১৬১০ সালে এই সপরিবার দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হওয়ার পর এ ভূখণ্ডে অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং এ পরিবর্তন পূজার আকার-আয়তনকে প্রভাবিত করেছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে বসবাসকারী মধ্যবিত্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ দেশত্যাগ করে। তারপর পার হয়ে গেছে প্রায় ৭০-৭৫ বছর। এ সাত দশকে আরেকটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে। এ মধ্যবিত্ত থেকে অনেকে আবার অতি ধনীর পর্যায়েও অবস্থান করছেন। যে কারণে আমরা রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরায় অনেক জৌলুসপূর্ণ পূজা উদযাপন দেখতে পাই।

পূজার মণ্ডপ বা প্যান্ডেল একটি ভিন্ন মর্যাদা বহন করে। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল, আবার একই অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন পাড়া-মহল্লা তাদের আয়ের শক্তির বিচারে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পূজামণ্ডপের আয়োজন করে। ২০২১ সালে সারা দেশে এ রকম পূজামণ্ডপের সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ১২২। ২০২২ সালে মণ্ডপের সংখ্যাটি ৪৬টি বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ হাজার ১৬৮-তে। আর চলতি বছর আরও ৫০টি মণ্ডপ যোগ হয়ে মণ্ডপের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২ হাজার ২১৮-তে। এর অর্থ এই নয় যে, হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধিই মণ্ডপ বৃদ্ধির একমাত্র কারণ। যেহেতু মণ্ডপের সঙ্গে ভিন্ন মাত্রার মর্যাদা জড়িত, তাই আর্থিক সংকুলানের ব্যবস্থা করতে পারলেই মণ্ডপের সংখ্যা বাড়ে। এ মণ্ডপগুলোর পরিচালন ব্যয় নির্ভর করে আয়োজকদের আর্থিক সংগতির ওপর। প্রতিমা তৈরি ও তার সাজসজ্জা, আলোকসজ্জা, বাদ্য-বাজনা, প্রসাদ বিতরণসহ প্রতিটি মণ্ডপের ব্যয়ের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন। যদি সামান্যতম আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করেন, তাহলে একটি মণ্ডপ পরিচালনার ন্যূনতম ব্যয় হবে ২ লাখ টাকা। আবার রাজধানীতে এমনও মণ্ডপ আছে, যার ব্যয়ের পরিমাণ ২০ কোটি টাকা। আপনি যদি মণ্ডপগুলোর গড় খরচ ৫ লাখ টাকা ধরেন, তাহলে এবারের দুর্গাপূজায় মণ্ডপের ব্যয় হবে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

প্রতিটি সম্প্রদায়ের পরিবারই চেষ্টা করে তাদের স্ব স্ব ধর্মীয় উৎসবগুলোতে সাধারণ সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত কিছু ব্যয় করার। এ ব্যয়গুলো করা হয় নতুন কাপড়, প্রসাধনসামগ্রী, যাতায়াত, উন্নত মানের খাদ্য গ্রহণ ও আপ্যায়ন বাবদ। হিন্দু সম্প্রদায়ও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পরিবারে সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ। এ পরিবারগুলোর মধ্যে এমনও পরিবার আছে, পূজা উপলক্ষ্যে যাদের ব্যয় কয়েক কোটি টাকা। আবার এমন পরিবারও আছে, যারা অন্যের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। তারপরও তারা আত্মীয়দের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েও আনন্দের অংশীদার হন। সেই হিসাবে দেখা গেছে, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে পরিবারগুলোর গড় অতিরিক্ত খরচ ৩০ হাজার টাকার কম নয়। তাহলেও পূজা উপলক্ষ্যে পরিবারগুলোর খরচ দাঁড়ার প্রায় ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয়কে আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ বছরের পূজা উপলক্ষ্যে অর্থনীতিতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে। করোনা-পরবর্তী সময়ে এ পরিমাণ আর্থিক লেনদেন নিশ্চয়ই উপেক্ষা করার মতো নয়।

মোটা দাগে অনেকে পূজার এ ব্যয়কে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বলে মনে করেন; কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এটি অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদার সৃষ্টি করে। এ বাড়তি চাহিদা আবার বাড়তি উৎপাদনের তাগিদ দেয়। এ বাড়তি উৎপাদন করতে গিয়ে কিছু মানুষের কর্মের পরিধি বাড়ে। প্রতিমাশিল্পীর কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে এবারে ৩২ হাজারেরও বেশি পূজামণ্ডপ তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো মণ্ডপের প্রতিমা তৈরিতে দুই মাসেরও বেশি সময় লেগে যায়। এক একটি মণ্ডপে প্রধান প্রতিমাশিল্পী ছাড়াও একাধিক সহকারী কাজ করেন। এ মানুষগুলোর জীবিকার প্রধান উৎস হলো দুর্গাপূজা। এর সঙ্গে রয়েছে রং, মাটি ও প্রতিমা তৈরির অন্যসব উপকরণ, যা তৈরিতে আরও কিছু মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। ঢাকি সম্প্রদায়ের কদর বাড়ে। পূজার সময়টাতে তাদের আয়ের পরিমাণ বাড়ে। এখনকার পূজাগুলোর মণ্ডপ তৈরিতে পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ ‘থিমের’ ওপর ভিত্তি করে মণ্ডপ তৈরি করা হচ্ছে। এ থিমের কাজে কবি-সাহিত্যিক, নাট্যকার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চিত্রশিল্পীরাও আলোকসজ্জার কাজে নিয়োজিত থাকায় তাদের জীবিকার উন্নতি ঘটে। আর এরই সঙ্গে এর সামাজিক দিক আছে বলেই তো মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা জানিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশে দুর্গাপূজার আর্থিক দিক বিবেচনা করে অর্থনীতির অনেক বিশ্লেষকই বিভিন্ন পরামর্শ তুলে ধরেছেন। তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আর এম দেবনাথের বক্তব্য দিয়েই শেষ করব। তিনি বলেছেন, আমরা কিন্তু দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে একটা ধর্মীয় পর্যটনশিল্প গড়ে তুলতে পারি। এ উপলক্ষ্যে আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ থেকে হাজার হাজার মানুষ বাংলাদেশে আসতে পারেন। শত হোক, তাদের অনেকেরই জন্মস্থান বাংলাদেশ। যতটুকু জানি, তারা আসতে চান, যেমন চাই আমরা যেতে। উপযুক্ত পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করলে এ থেকে আমরা অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। ইলিশ মাছ বাংলাদেশ থেকে যায় পশ্চিমবঙ্গে। এমনও তো হতে পারে, তারা এখানে এসে দুর্গাপূজা দেখবেন এবং ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করবেন। উত্তর ভারতে বৌদ্ধদের জন্য গৌতম বুদ্ধের কর্মস্থলে ধর্মীয় পর্যটনের সূত্রপাত করে প্রতিবেশী দেশ প্রচুর লাভবান হচ্ছে। আমরাও কি লাভবান হতে পারি না?

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2