যেভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৫ আগস্ট,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০২:৪৭ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে বড় ছেলে মাওলানা রফিক বিন সাঈদীর পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে। পিরোজপুর নতুন বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন তার নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত সাঈদী ফাউন্ডেশনের মসজিদের পাশেই তাকে দাফন করা হয়। এর আগে মঙ্গলবার দুপুর ১টা ১০ মিনিটে সাঈদী ফাউন্ডেশনের মাঠে হাজার হাজার ভক্ত-অনুসারীদের উপস্থিতিতে তার জানাজা সম্পন্ন হয়।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মজিবর রহমান জানাজায় ইমামতি করেন। এ সময় প্রায় ২ কিলোমিটার রাস্তা ও বিভিন্ন মাঠ বাড়ির ছাদে লাখ লাখ মানুষ জানাজায় অংশ নেন এবং সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
২০০৬ সালে পিরোজপুর-১ আসন থেকে জামায়াত এবং ২০০১ সালে পুনরায় চার দলীয় ঐক্যজোট থেকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে এর আগে থেকেই ধর্মীয় বক্তা হিসেবে তার বেশ পরিচিতি ছিল।
সাবেক সংসদ সদস্য দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাগারে দণ্ডিত ছিলেন। ২০১০ সালে গ্রেফতারের পর থেকেই কারাগারে ছিলেন তিনি।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দেশজুড়ে পরিচিত হয়ে ওঠা নিয়ে ২০১৩ সালে তার গ্রাম এবং পরিবারের মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। সেখানে সাঈদীর জীবন নিয়ে নানা তথ্য উঠে আসে।
জিয়ানগরের সাঈদখালি গ্রাম আগে পরিচিত ছিল সাউদখালি নামে। এখনো অনেকে আগের নামেই চেনেন।
তবে সাউদখালির নামের রূপান্তর ঘটেছে এই গ্রামেরই মানুষ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ঘিরে। এই গ্রামেই ১৯৪০ সালে জন্ম নেন জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জিয়ানগরে ঠিক কী ঘটেছিল, তা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে।
সেই সঙ্গে বিতর্ক চলছে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে ঘিরে, যিনি ধর্মীয় জলসার জনপ্রিয় বক্তা থেকে পরে পরিণত হয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর এক গুরুত্বপূর্ণ নেতায়।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় অবশ্য নিজ গ্রামেরও খুব কম মানুষই তাকে চিনতেন।
সাঈদখালির মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জন্মের পর তিনি এলাকায় পরিচিত ছিলেন দেলোয়ার শিকদার নামে।
বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের যে ওয়ার্ডটির অধীনে সাঈদখালি গ্রাম, সেই ওয়ার্ডের একজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হারুনুর রশীদ বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই তথ্য তিনি নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, ওনাকে সবাই দেলোয়ার শিকদার নামে চিনতো। স্বাধীনতার সময় তো আমার বয়স খুব কম ছিল। এ বিষয়ে আমি বলতে পারবো না। তবে আমি শুনছি এইটা। ওনার বংশ শিকদার বংশ। ওনার নাম কিভাবে সাঈদী হলো সেটা বলতে পারবো না। হয়তো সাউদখালি নাম থেকেই উনি নিজের নাম করেছেন সাঈদী।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পরিবারের পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হচ্ছেন, শিকদার কখনো তাদের পারিবারিক উপাধি ছিল না। তার ছেলে মাসুদ সাঈদী বিবিসিকে বলেন, সাঈদী তাদের পারিবারিক উপাধি।
স্থানীয় সাংবাদিক নাসিরউদ্দীন বলছেন, সাউদখালি গ্রামকে এখন সাঈদখালি বলা হচ্ছে, সাঈদীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে।
বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলছেন, দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বাবা ছিলেন গ্রামের খুব সাধারণ এক গৃহস্থ। ওনার বাবা একজন সাধারণ মানুষ ছিল। গ্রামে জমি-জিরাত ছিল। তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা যদিও অনেক তত নামকরা কোন পরিবার ছিল না।
পরিবারের কাছে থেকে পাওয়া জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পড়াশোনা করেছেন গ্রামের মক্তবে, এরপর শর্ষিনার পীর পরিচালিত আলীয়া মাদ্রাসা, বারুইপাড়া সিদ্দীকিয়া মাদ্রাসা এবং খুলনা আলীয়া মাদ্রাসায়।
স্থানীয় সাংবাদিক নাসিরউদ্দীন জানান, পড়াশোনা শেষে তিনি গ্রামের কাছে এক বাজারে কিছুদিন ব্যবসা করেছেন বলেই তারা জানেন।
তার ভাষায়, ‘উনি মূলত এর আগে পারের হাটে ব্যবসা করতেন ভায়রা ভাইয়ের সাথে মিলে। মুদি দোকানের ব্যবসা ছিল। তখন কিন্তু তিনি এত নামকরা লোক ছিলেন না। সাধাসিদে জীবন-যাপন করতেন। কিন্তু আশির দশকে উনি ওয়াজ নসিহত করা শুরু করেন। পরে আস্তে আস্তে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। এখান থেকেই উনার নাম ছড়িয়ে পড়ে।’
তবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী বলেন, এই তথ্য সঠিক নয়, তিনি পারের হাটে কখনো ব্যবসা করেননি, ব্যবসা করেছেন খুলনায়।
তিনি বলেন, বেসিক্যালি তিনি একজন লেখক। ছাত্র জীবনের পর থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। তিনি ব্যবসা মূলত শুরু করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে যখন খুলনা-যশোরে বসবাস করতেন তখন। এরপর তিনি লেখালেখি করেছেন স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে। আর কোরআনের দাওয়াত দেওয়াটা ছিল তার মিশন।
দেশজুড়ে পরিচিতি যেভাবে
বাংলাদেশের মানুষের কাছে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পরিচিতি পান মূলত আশির দশকের শুরু থেকে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তখন তিনি ‘ওয়াজ মাহফিল’ নামে পরিচিত ধর্মীয় সমাবেশগুলোতে একজন বক্তা হিসেবে হাজির হতে শুরু করেন।
পিরোজপুরের বালিপড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান জানান, ১৯৮০ সালে তিনি প্রথম দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে দেখেন তাদের এলাকার এক ওয়াজ মাহফিলে।
তিনি বলেন, ওনারে আমি প্রথম দেখি ১৯৮০ সালে। আমাদের এলাকায় মাহফিল করছিল, তখন। আমাদের এলাকায় মাহফিল আগে করছে কিনা আমি জানিনা। তবে আমি প্রথম দেখছি ১৯৮০ সালে।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী বলেন, ওয়াজ মাহফিল করেই তার বাবা দেশজোড়া পরিচিতি পান।
তিনি বলেন, এটা সত্য যে তিনি তখন অত্যন্ত সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন, এত পরিচিতি তখন তার ছিল না। তখন তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাহফিল করে বেড়াতেন। ১৯৭২ সালে তিনি পিরোজপুরে প্রথম মাহফিল করেন। তারপর একের পর এক দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাহফিল করতে থাকেন। চট্টগ্রামে যে তাফসীর মাহফিল হয়, সেটা তিনি শুরু করেন ৩৮ বছর আগে।
আশির দশকের শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একজন সুবক্তা হিসেবে খুব দ্রুত পরিচিতি অর্জন করেন। তার ধর্মীয় সমাবেশগুলোতে জনসমাগমও বাড়তে থাকে।
কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের মানুষের একটি বিরাট অংশের কাছে বিতর্কিত হয়ে পড়েন তার নানা রাজনৈতিক মন্তব্য এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর।
ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ছদ্মাবরণে জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্র সংগঠনের পক্ষে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার করছেন বলে অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে।
রাজনীতিতে উত্থান
শুরুতে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে দৃশ্যমান না থাকলেও তিনি যে এই রাজনীতির সক্রিয় সমর্থক সেটি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কখনো গোপন করেন নি।
এরপর অবশ্য তিনি প্রকাশ্যেই জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন এবং ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পর পর দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জীবনের যে অধ্যায়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক, সেটি মূলত ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী কয়েক বছর।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
তিনি ২০০৯ সালে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ২০১০ সালের ২৯শে জুন ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে একটি মামলায় তিনি গ্রেফতার হন।
পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের ডিসেম্বরে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।
যে বিশটি অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল, তার মধ্যে আটটি অভিযোগে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। এর মধ্যে দুটো অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয়।
তবে মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আপিল বিভাগ দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়।
অভিযোগে বলা হয়েছে, যুদ্ধ শুরুর পর তিনি আধা মিলিশিয়া রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে পাকিস্তানী বাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন।
তবে তার ছেলে মাসুদ সাঈদীর ভাষ্য ভিন্ন। বিবিসিকে তিনি জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালে দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদী পিরোজপুরেই ছিলেন না। ১৯৬৯ সাল হতে তিনি যশোরের নিউমার্কেট এলাকায় এ ব্লকের একটি বাড়িতে বসবাস করতেন।