avertisements 2

আমার অপরাধ আমি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কন্যা

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৫০ এএম, ২৪ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪

Text

আব্বা নেই আজ ৪৭ বছর। সেই শৈশবে তাঁকে হারিয়েছি। তাঁর আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি আমি ও আমার অন্য ভাই-বোনরা। আমাদের কী অপরাধ ছিল, যে কারণে প্রিয় বাবাকে হারাতে হয়েছে? কী অপরাধ ছিল আমার বাবার, যে কারণে তাঁকে মধ্যরাতে কারাগারের মতো নিরাপদ স্থানে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো? আব্বার অপরাধ তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুগত ও বিশ্বস্ত ছিলেন।

তাঁর অপরাধ তিনি একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাঁর অপরাধ তিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর অপরাধ বারবার আহবান সত্ত্বেও তিনি খুনি মোশতাকের সঙ্গে হাত মেলাননি। বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করে পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারে যোগ দেননি। মোশতাক অনেক চেষ্টা করেছেন, টেলিফোন করে বাবাকে ভয় দেখিয়েছেন। প্রতিউত্তরে আব্বা তাঁর ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

বেহায়া মোশতাক এরপর আম্মার সঙ্গে যোগযোগ করে বাবাকে বোঝানোর কথা বলেন। কিন্তু আমার বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন অবিচল। সামান্য ক্ষমতার লোভে কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের সঙ্গে হাত মেলাননি। বিনিময়ে তাঁকে প্রাণ দিতে হলো। ভয়ংকর এক মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হলো। খুনিচক্রের সঙ্গে হাত না মেলানোর পরিণতি কী হতে পারে আব্বা তা জানতেন, তবু প্রিয় নেতার রক্তের সঙ্গে তিনি বেঈমানি করেননি।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আব্বার প্রায় তিন দশকের বন্ধুত্ব। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের প্রাক্কালে সিলেট থেকে পরিচয়। তারপর বাংলার নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে তাঁরা একসঙ্গে হেঁটেছেন জীবনের শেষ পর্যন্ত। পাকিস্তানি জান্তা সরকারের রক্তচক্ষুকে ভয় না করে দৃঢ়চিত্তে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংগ্রাম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা আব্বাকে ‘সংকট-মানব’ হিসেবে উল্লেখ করে। ‘সংকট-মানব সৈয়দ নজরুল’ শিরোনামে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে লেখা হয়—‘স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কর্ণধার সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাঙালিদের কাছে একজন সংকট-মানব হিসেবে পরিচিত। বস্তুত আওয়ামী লীগ ও বাঙালি যখনই কোনো সংকটে পতিত হয়েছে তখনই তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছে পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব। সহজ-সরল নীতিনিষ্ঠ এই মানুষটি কথার চেয়ে কাজ করেন বেশি—চিন্তা করেন আরো বেশি। ’

সেই আব্বাকে হারিয়ে আমরা দিকহারা। অনিশ্চয়তায় কেটেছে আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত। রাতের পর রাত কেটেছে নির্ঘুম। আমার সহজ-সরল মায়ের ওপর আকাশ ভেঙে পড়ল। পরিচিত মানুষ সব চোখের পলকে বদলে গেল। এই সেদিনও কত মানুষ সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার আশায় আব্বার চারপাশ ঘিরে রাখতেন। মুহূর্তেই যেন সব পাল্টে গেল। মিন্টো রোডের সরকারি বাড়ি ছাড়তে হলো। থাকার জন্য একটি নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করা ভয়াবহ বিষয় হয়ে দাঁড়াল আমাদের জন্য। একটি সুখী-সুন্দর পরিবার মুহূর্তেই তছনছ হয়ে গেল। কাচের মতো ভেঙে পড়ল আমাদের স্বপ্নগুলো। অনিশ্চিত হয়ে পড়ল আমাদের শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু।

এই অবস্থায় আম্মা সৈয়দা নাফিজা ইসলাম তাঁর বিধ্বস্ত মনকে শক্ত করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আব্বা যখন মুক্তিযুদ্ধের সরকার পরিচালনা করছেন, আমরা তখন পাকিস্তান সরকারের ঘোষণা করা মৃত্যুর হুলিয়া নিয়ে দেশের ভেতর এখানে-ওখানে আতঙ্কের দিন-রাত পার করছি। আম্মা তখন পরম মমতায় ও যত্নে আমাদের আগলে রেখেছিলেন। একাত্তরের সেই সাহসী রূপ তখন আম্মার মুখচ্ছবিতে। গ্রামের ঋজু সেই নারী যদি সেদিন শক্ত হাতে হাল না ধরতেন, তাহলে আমাদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াটাই নিশ্চিত ছিল।

ধীরে ধীরে আমরা বড় হয়ে উঠেছি। বড় দুই ভাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মঞ্জুরুল ইসলাম বিদেশে। দেশে সেনাবাহিনীতে কর্মরত সাফায়েতুল ইসলাম ভাই। ছোট ভাই শরিফুল ইসলাম, আমি আর রুপা পড়ছি। আমি ভর্তি হলাম ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে। লেখাপড়া শেষ করে একটি চাকরির জন্য যেখানেই আবেদন করেছি সেখান থেকেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। সিভি দেখে যখনই নিশ্চিত হয়েছে আমি সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে, তখনই তারা আমাকে না করে দিয়েছে। আমার অপরাধ আমি সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে। তখন ১৯৯১-৯২ সাল। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নির্মাণে কাজ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে মনে হয় স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি এখনো সর্বত্র সক্রিয়। তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। আজ এই শোকের দিনে এই হোক দৃপ্ত শপথ।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2