সংলাপ কার সঙ্গে করবো, প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৪ মার্চ,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০৪:৫৬ এএম, ২৪ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা প্রকারান্তরে নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বিগত নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত সংলাপের ফলাফল ও খালেদা জিয়ার ছেলে মারা গেলে, বাসায় ঢুকতে না দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে সরকারপ্রধান বলেন, ‘সংলাপ কার সঙ্গে করবো? ওদের সঙ্গে আবার কীসের বৈঠক, আর কিসের কী? এত অপমানের পর তাদের সঙ্গে আবার কীসের বৈঠক? যারা এইটুকু ভদ্রতা জানে না, তাদের সঙ্গে বৈঠকের কী আছে?’
কাতারে পাঁচ দিনের রাষ্ট্রীয় সফর নিয়ে সোমবার (১৩ মার্চ) গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুলের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ বিন খলিফা আল থানি এবং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের আমন্ত্রণে গত ৪ থেকে ৮ মার্চ এই সফর করেন তিনি।
মাঠে এখনও বলা হচ্ছে আপনি সংলাপ করবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সংলাপ কার সঙ্গে করবো? আমি ১৮ সালের নির্বাচনের আগে সংলাপ করেছি। তার রেজাল্টটা কী? নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ছাড়া আর কিছুই করেনি। ৩০০ সিটে ৭০০ নমিনেশন দিয়ে, টাকা খেয়ে নিজেরাই নিজেদেরকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে, তারপর নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আল্লাহ আমাকে ধৈর্য্য দিয়েছে, সহ্য শক্তি দিয়েছে। না-হলে ১৫ আগস্ট আমার বাবা-মায়ের হত্যাকারী, গ্রেনেড হামলা করে আইভি রহমানসহ আমাকে হত্যার চেষ্টা, বোমা মেরে হত্যার চেষ্টা যারা করেছে, আমি তাদের সঙ্গেও বসেছি শুধু দেশের স্বার্থে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু তাই না, খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মারা গেলো। আমি গেলাম তাকে দেখতে, একজন সন্তানহারা মাকে সহানুভূতি জানাতে। আমাকে কীভাবে অপমানটা করলো? আমার গাড়ি ওই বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেবে না। বড় গেট বন্ধ। টেলিফোন করে সময় নেওয়া হয়েছে যে, আমি ওই সময় আসবো। তারপরও সে গাড়ি বন্ধ করলো। কারণ, আমি তখন অলরেডি চলে গেছি। আমি বললাম, ঠিক আছে তাহলে ছোট গেট দিয়ে ঢুকবো। আমার গাড়ি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছোট গেট বন্ধ করে দিলো। এত অপমানের পর তাদের সঙ্গে আবার কীসের বৈঠক? আমার পরিষ্কার কথা— যারা এটুকু ভদ্রতা জানে না, তাদের সঙ্গে বৈঠকের কী আছে? কেউ পারবেন আপনার বাবা-মার হত্যাকারীর সঙ্গে বসে বৈঠক করতে? আপনাকে যদি কেউ এভাবে অপমান করে আপনারা পারবেন? কে পারবে? যেটুকু সহ্য করেছি শুধু দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, নিজের স্বার্থে না। এটা তো প্রমাণিত, বাংলাদেশের মানুষের জন্য।’
খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গ টেনে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘তারপর আবার এদের সঙ্গে কীসের কথা বলবো? তারপরও তো অসুস্থ, বয়োবৃদ্ধ তার বোন এসে, ভাই এসে, বোনের জামাই— সবাই এসে যখন আমার কাছে আর রেহানার কাছে আকুতি করলো। তার সাজাটা স্থগিত করে বাসায় থাকার এবং চিকিৎসার সুযোগটা করে দিয়েছি। এটুকু যে করেছি সেটাই যথেষ্ঠ। যারা বার বার আমাদেরকে হত্যা করে, অপমান করে। সারা বাংলাদেশে কাকে না অপমান করেছে? তারপরও যে এইটুকু সহানুভূতি পাচ্ছে, সেটা শুধু আমার কারণে। ওদের সঙ্গে আবার কীসের বৈঠক আর কীসের কী? কী ক্ষমতা তাদের আছে? সন্ত্রাস করা ছাড়া তো তাদের আর কোনও ক্ষমতা নেই।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন, রাষ্ট্র পরিচালনায় যে যে কথা আমরা দিয়েছি, আমরা তা রেখেছি। মাঝখানে করোনা ভাইরাস আর ইউক্রেন যুদ্ধ যদি না হতো, আমাদের প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগের ওপরে ছিল, আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম। আমাদের দারিদ্র্যের হার ২০ ভাগে নামিয়ে এনেছিলাম। আজ করোনা আর যুদ্ধকালীন সময় যদি না থাকতো, আরও দুই থেকে তিন শতাংশ দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে পারতাম। নানা কারণে হয়তো হয়নি। তবে এখানে থেমে থাকলে হবে না, হতাশাগ্রস্ত হলে হবে না। আমি কখনও হতাশায় ভুগি না, একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলি, আমার তো হারানোর কিছু নেই। আর কিছু মনে না রাখতে পারলেও দেশের উন্নয়নের জন্য কোথায় কী করতে হবে, সেটা মনে রাখতে পারি। ওইটুকু স্মরণশক্তি আমার রয়েছে।’
শ্যাডো গভর্নমেন্ট কে করবে— এমন প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে দল বেশি লাফায় তাদের দুই নেতাই সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা না পারবে ইলেকশন করতে, না পারবে ক্ষমতায় আসতে। বিএনপি তো তার নিজের গঠনতন্ত্র নিজেরাই ভঙ্গ করছে। তার গঠনতন্ত্রে আছে সাজাপ্রাপ্ত আসামি দলের নেতা হতে পারে না। এখন সেই সাজাপ্রাপ্ত আসামিকেই দলের নেতা বানিয়ে রেখে দিয়েছে। এই দলের কাছে কী আশা করবেন? ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩০০ সিটের মধ্যে তারা পেলো প্রথমে ২৯টা সিট। পরে বাই ইলেকশনে একটা, এই ৩০টা। ২০ দলীয় জোট বিএনপির নেতৃত্বে। ২০ দলীয় জোট পেলো ৩০টা সিট। ২৭০টা পেলাম আমরা মহাজোট। ২০০৮ এর নির্বাচন যেটা সবথেকে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন সেই নির্বাচনেই যখন তাদের ওই দুরবস্থা। এখন তো আমরা অন্তত কাজ করে মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছি।
উলফা নেতা অনুপ চেটিয়ার সাক্ষাৎকারে বলা কথাগুলো রাজনৈতিক, বিএনপি নেতাদের এমন মন্তব্য প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যেটা হাতে-নাতে ধরা পড়লো যে, ১০ ট্রাক ভর্তি অস্ত্র পাচার হচ্ছে। যে পুলিশ ধরলো সে পুলিশকে টর্চার করলো, চাকরি থেকে বের করে দিলো। অত্যাচার করলো এটা আবার শুধু রাজনৈতিক হয় কীভাবে? আর এই ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় কিন্তু তারেক জিয়া সাজাপ্রাপ্ত এবং খালেদা জিয়ার মন্ত্রীরাও। তারপরও যদি তারা (বিএনপি) এটাকে রাজনৈতিক বলে, তাহলে এটা জনগণই বিচার করবে। এটা একটা ভাওতাবাজি, জনগণের সঙ্গে একেবারে মোনাফেকি।’
তিনি বলেন, ‘এই অস্ত্র চোরাকারবারি ব্যবসাটাই তাদের ব্যবসা। সেটাকে তারা রাজনীতি হিসেবে দেখাতে চায়। আসলে ওদের জন্মই হয়েছে অস্ত্র হাতে নিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী একজন সেটা। সে হলো সেনাবাহিনী প্রধান আবার সেই অবস্থা থেকে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিলেন, অস্ত্র হাতে নিয়ে। নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় বসেছে। আর সেই ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলি করে তৈরি করা দল হলো বিএনপি। এদের কাছ থেকে জনগণ এর চেয়ে বেশি কী আশা করবে? লুটপাট করা, দুর্নীতি করা। বিএনপি, খালেদা জিয়া, তার ছেলেদের দুর্নীতির কথা এটা আমাদের না। এটা আমেরিকায় এফবিআই খুঁজে বের করেছে, সিঙ্গাপুরে ধরা পড়েছে। এমনকি তাদের পাচার করা ৪০ কোটি টাকা বাংলাদেশ উদ্ধার করে ফেরত এনেছে। এই কথাটা সবার মনে রাখা উচিত। সেটাও রাজনৈতিক বলবে? সরাসরি অস্ত্র চোরাকারবারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। গ্রেনেড হামলা, ওটাও তো রাজনৈতিক? হ্যাঁ, রাজনৈতিকভাবে আমাকে হত্যা করতে চেয়েছে। সবই রাজনৈতিক বলে ধামা-চাপা দেওয়া। এরা রাজনীতির কী জানে? রাজনৈতিকভাবে এদের জন্ম না তো। জন্ম তো অস্ত্র হাতে নিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীর হাতে, সেটা মনে রাখলেই চলবে। ওদের কাছে জনগণ কিছু আশা করতে পারে না।’
আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাড়াবে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আমরা আশ্রয় দিয়েছি। রোহিঙ্গাদের জন্য যেসব বিদেশি সহায়তা ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকালীন সময়ে তা সীমিত হয়ে গেছে। এখন ইউক্রেনের রিফিউজিদের দিকে তাদের নজর বেশি। আমরা যেহেতু আশ্রয় দিয়েছি, কাজেই সেটা আমাদের দায়িত্ব। যার জন্য কিছুটা সমস্যায় আমাদের অবশ্যেই পড়তে হবে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে প্রথম যখন রোহিঙ্গা আসে, কয়েক মাস কিন্তু আমরা নিজেদের টাকায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। এরপর অন্যদেশের সহায়তা এলে কিছুটা সুবিধে হয়। আমরা ভাসান চরে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছি। এরা ভাসান চরে যদি যায় অন্তত তারা জীবন জীবিকার সুযোগও পাবে। ভালো একটা পরিবেশে থাকতে পারবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গা আমাদের ওপর একটা বোঝা এটা ঠিক। কিন্তু আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে— ১৯৭১ সালে আমাদের এককোটি শরণার্থী আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। সেই সময়ের কথা মনে করে মানবিক কারণেই তাদের আশ্রয় দিয়েছি। মানুষের বিপদে পাশে তো থাকতেই হবে।’
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে আমরা ঝগড়া করতে পারি না। তাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করে যাচ্ছি— তাদের নাগরিক দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকেও বলেছি, তাদেরও চেষ্টা চালানো উচিত।’