avertisements 2

স্বামীজি ও জয় শ্রীরাম

জালাল উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: ০১:২৫ এএম, ৫ ফেব্রুয়ারী,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৩৬ এএম, ১১ মার্চ,সোমবার,২০২৪

Text

স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে জয় শ্রীরাম শব্দ যুগল সমার্থক কিনা জানিনা। তবে তা ভারত বর্ষের ঐতিহ্যের সঙ্গে বেমানান বলেই বিদগ্ধজনের কাছে মনে হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ বাঙালী জাতীয়তাবোধের একজন পথিকৃত হিসাবে বিবেচিত। তবে মানুষ হয়ে প্রকাশ্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তিনি ছিলেন একজন সর্ব ভারতীয় ধর্মগুরু। হিন্দু সভ্যতাকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা দেয়ার লক্ষ্যে তিনি তাঁর ধর্মীয় মাহাত্মের ঝাঁপি নিয়ে দেশ দেশান্তর ভ্রমন করেছেন। হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম প্রচারে জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। হিন্দু সনাতনী মত ও পথের দিশারী হয়ে তিনি হিন্দু ধর্মীয় সমাজে মহা পুরুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তবে স্বামী বিবেকানন্দ প্রকৃত অর্থে ছিলেন একজন জ্ঞানী, শিক্ষানুরাগী এবং আদর্শ ধর্ম প্রবর্তক। স্বামীজিকে নিয়ে এর বেশী বলা বা ব্যাখ্যা দেয়ার ধৃষ্টতা আমার জন্য বেমানান বলেই মনে হয়। স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্ব হিন্দু সমাজের পথিকৃত হলেও প্রকৃত অর্থে তিনি একজন উচ্চমার্গের আদর্শ মানুষ হিসাবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন এবং এখনো আছেন। ধর্ম প্রচারে মানবতাবাদের যে মৌলিক দিকগুলো আছে তা তিনি সুউচ্চ কন্ঠে পরাধীন ভারত বাসীর হিন্দু সমাজকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন। তিনি ভারতীয় সভ্যতার জয়গানে হিন্দু জাতীয়তাবাদের একাত্মতার কথা বিশ্ব দরবারে প্রচারে সার্থক ভুমিকা পালন করেছেন।

স্বামীজিকে নিয়ে লেখার উদ্দেশ্যে আমি কলম ধরি নি। একজন মহা পুরুষকে নিয়ে লেখা বা বলার জন্য বড় বড় পন্ডিত বা বিদগ্ধজন আমাদের সমাজে রয়েছেন। প্রসঙ্গ স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম বার্ষিকী উদযাপন। এই গেল মাসেই তা বেশ জোরে শোরে ঢাক ঢোল পিটিয়ে হয়ে গেল। অবশ্য আমাদের স্বাধীন বাংলায় ওসবের খুব তোড়জোড় না থাকলেও বিভিন্ন সেমিনার ও স্মরন সভার আয়োজন করে আমরা আমাদের মহা পুরুষদের স্মরন করি। কোথাও ধর্মীয় আচার আচরনে কোথাও বা শিল্প সাহিত্যের আবরনে আমরা স্বামীজিকে স্মরন করি। কারন বাঙালীর প্রথিত যশা মহাপুরুষদের স্মরন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাদের পথ ধরেই তো আমরা আজ মাথা উঁচু করা সার্থক বাঙালী। নিজেকে উপস্থাপন করা, মাথা উঁচু বুক টান করে বিশ্ব মঞ্চে বাঙালী হয়ে ভারতীয় আঙ্গিকে নিজেকে প্রকাশ করার এসব নমস্য ব্যক্তিদের উত্তর পুরুষ হিসাবে আমরা তাদেরকে নিয়ে গর্ব করতেই পারি। হিন্দু ধর্মের বিশুদ্ধতার প্রতীক এবং সর্ব ভারতীয় আঙ্গিকে একজন সার্থক হিন্দু ধর্মগুরু সেই স্বামী বিবেকানন্দ ভৌগলিক কাঠামোগত আঙ্গিকে বাঙালী হয়েও এখন ভারতীয় হিসাবে তাঁর পরিচয়। সেই ভারতীয় বাঙালী মহাপুরুষের জন্ম বার্ষিকী উদযাপনে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালী সমাজে যেভাবে মৌলবাদী উচ্চারনে ধর্মীয় আচরনের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল তা সভ্য ভারতে কতটুকু প্রযোজ্য তা তারাই বলতে পারবেন। কারন ছোটবেলা থেকে আমার দেখা স্বামীজির জন্ম বার্ষিকীতে যেভাবে স্কুল কলেজ ও সামাজিক আচার আচরনে স্বামীজিকে স্মরন করা হয়  তা কখনোই রাজনীতির ধর্মাচরনের আবরনে করা হোত না। স্কুলের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা প্রার্থনা সভার সংযুক্তির মত স্বামীজির স্মরনে ভক্তিগীতি, কবিতা ও নাচ ইত্যাদি দিয়ে ধর্মানুরাগী ও শিক্ষাগুরু হিসাবে তাঁকে স্মরন করতো। এমনকি সমাজেও সর্ব ধর্মের সমন্বয়ে বিশেষ ভাব গাম্ভীর্য নিয়ে আলোচনা সভা ও মিলন মেলা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে স্মরন করা হোত। কখনোই তা রাজনীতির ব্যানারে উচ্চ কলরবের স্লোগান সমৃদ্ধ মিছিল করে পালন করা হয়েছে বলে মনে পড়েনা।

রামকৃষ্ণ পরম হংস দেবের যোগ্য উত্তরসুরী হয়ে স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মগুরু ও ধর্ম পরিব্রাজক হিসাবে ভারতবর্ষে খ্যাতি অর্জন করেন। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন একজন যুক্তিবাদী হিন্দু ধর্মীয় মহাসাধু। ধ্যান তপস্যা ও শিক্ষার দ্যুতি দিয়েই তিনি হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য বিশ্ব দরবারে প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন। তাঁর ধর্ম সাধনার মূল কথাই ছিল “জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর”। পর ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ এবং পর হিংসা পরিহার করে মানব ধর্মের প্রকৃত নির্যাসে তিনি নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছেন। স্বল্প বয়সের জীবনকালে তিনি তাঁর শিক্ষা ও সাধনাকে হিন্দুস্থানের হিন্দু জাতীয়তাবাদে যেভাবে সুউচ্চ করেছেন তা সত্যিকার অর্থেই এক অনন্য দৃষ্টান্ত। হিন্দু ধর্মের ভেদাভেদের বিভিন্ন কুপমন্ডুতাকে ঝেড়ে ফেলে ধর্মের প্রকৃত নির্যাসে আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনে তিনি হিন্দু সমাজকে এগিয়ে আসতে পথ দেখিয়েছেন। মানব কল্যানের কথা বলে ধর্মের গুরুত্বকে তিনি মানব সমাজে প্রচার করেছেন বলেই হয়তো তাঁর ধারনায় গড়ে উঠা রাম কৃষ্ণ মিশন আজ বিশ্বের বিভিন্ন কোনে তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। 

ভারত আজ এই উপমহাদেশে একটি বৃহৎ হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র। হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র হলেও সর্ব ধর্মের সমন্বয়ে এক আদর্শ ধর্ম নিরপেক্ষ অবয়বে স্বাধীন ভারতের যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রকৃত অর্থে বহু জাতি ও ধর্মের সমন্বয়ে এই ভারতের জনসংখ্যা এখন প্রায় এক'শ তিরিশ কোটির কাছাকাছি। এর শতকরা আশি জনই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। সত্যি কথা বলতে কি এই হিন্দু একটি জাতি এবং সামষ্টিক অর্থে তা ধর্মীয় জাতিস্বত্তা হিসাবে কখনোই একাট্টা নয় বলে প্রতীয়মান হয়। কারন তারা শক্তি-প্রকৃতি ইত্যাদির বিগ্রহ বা প্রতিমা বানিয়ে তার পুজা অর্চনা করে তাদের ধর্মীয় অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়। তাই দেখা যায় দক্ষিন ভারতীয়রা যেসব প্রানী বা প্রকৃতির উপাদান নিয়ে তাদের দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করেন পুবের বা উত্তরের কিংবা পশ্চিমের ভারতীয় হিন্দুদের ঘরে ধর্মীয় আচরনের সেই কালচার বা সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয় না। আবার প্রকৃতি ও শক্তির পুজারী হয়ে যেভাবে তারা জীব-জন্তু ও প্রাণীকুলের আবক্ষ মুর্তি বানিয়ে পুজা অর্চনা করে তা সামগ্রিক অর্থে হিন্দু অনুশাসনের গীতা বা বেদের কোথাও উল্লেখ আছে বলে মনে হয় না। একজন সনাতন ধর্মীয় হিন্দুর আচার আচরনে প্রকৃত বেদ ও গীতার যে প্রভাব তা সমগ্র হিন্দু জাতির আচরনে প্রতিফলিত হতে না দেখে বুঝা যায় হিন্দু ধর্ম সত্যিকার অর্থে হিন্দু জাতিস্বত্তার একটি সামাজিক রূপ। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্র উচ্চারনেই বলা যায় “হিন্দু কোন ধর্ম নয়। হিন্দু হচ্ছে ভারতীয় কৃষ্টি ও কালচারের জাতিগত পরিনতি”। 

আজকের দিনে ভারত রাষ্ট্রে হিন্দু ইজমকে প্রাধান্য দিয়ে বিশেষ করে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে যেভাবে সর্ব ধর্মের ভারতকে হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্র বানানোর দিল্লি শাসন শুরু হয়েছে তা কতটা বিধি সম্মত বা রাষ্ট্র কাঠামোয় তা কতটুকু সহায়ক সেটা বিদগ্ধজনেরাই বলতে পারবেন। কারন প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা যা সিন্ধু নদ বা মতান্তরে হিন্দু নদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল তার মুল মন্ত্রই ছিল সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের এক সমৃদ্ধ ভারত বর্ষ। আর সেই ভারতীয় জাতি যারা সিন্ধু অববাহিকায় হিন্দুস্থান নামক রাষ্ট্রের পত্তন ঘটিয়েছিল তা মুলতঃ এশিয়া মাইনর বা পারস্য এলাকা থেকে আসা অগ্নি পুজক থেকে শুরু করে স্থানীয় স্থলভাগের সামষ্টিক জনপদ। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সিন্ধু নদের অববাহিকায় গড়ে উঠা জনপদে তারা হিন্দুস্থানের হিন্দু নামেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সেই সুত্র ধরেই আজকের এই হিন্দুস্থান। সেক্ষেত্রে হিন্দুস্থানের হিন্দু বলতে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মীয় জন গোষ্টিকেই বুঝায় না। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এদেশের সবাই হিন্দু। এখানে একজন কাশ্মিরী যেমন হিন্দু তেমনি একজন মারাঠী বা গুজরাঠীও হিন্দু। তেমনিভাবে তামিল আহমিয়া বাঙালী উড়িয়া নাগা নেপালী গোর্খা সবাই হিন্দু নামেই পরিচিত। 

প্রসঙ্গ স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম বার্ষিকীর আয়োজন। সেই স্বামীজির জন্ম বার্ষিকী এবার রাষ্ট্রীয় মোড়কে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত হোল সাড়ম্বরে। ঈগলের চোখ লাগিয়ে বলাই যায় যে, সামনের পশ্চিম বঙ্গীয় রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনকে সামনে রেখে এবার দিল্লির মৌলবাদী সরকার বাংলার মাটিতে নিজেদের পায়ের মাটি শক্ত করতে  সবকিছুই সাজাচ্ছেন অতি সন্তর্পনে। তাইতো দেখা যায় দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম বার্ষিকী পালনে এবার কোলকাতা মুখী হয়েছেন বেশ আটোসাঁটো ভাবেই। অবশ্য এই স্বামীজির জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী নিয়ে আজকের এই অতি হিন্দু ইজমের দিল্লি ওয়ালাদের কতটুকু সংযোগ বা সংশ্রব আছে তা তাদের ঠিকুজিই বলে দেয় এবং তার মুল্যায়ন করবেন তাদের সমাজের বিদগ্ধজনেরা। সত্যি কথা বলতে কি, স্বামী বিবেকানন্দের স্বপ্নের হিন্দু সমাজের খোঁজ খবরে আজকের দিনের শাসক গোষ্ঠির মহারথীরা কতটুকু সংশ্লিষ্ট বা সম্পৃক্ত কিংবা হিন্দু মহা সাধু হিসাবে তার প্রতিষ্ঠিত বেলুড় মঠই বা কোথায়-  সে খবর তারা জানেন কিনা তাতে সন্দেহ আছে বৈকি! অথচ রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠানের নাম করে কেন্দ্র শাসনের মহারথীরা যেভাবে হিন্দু ইজমের রাজনীতির “জয় শ্রীরাম” স্লোগান দিয়ে জন্ম বার্ষিকীর মঞ্চ কাঁপালেন তাতে বাঙালী সনাতনী হিন্দু ধর্মের আঁতে ঘা লেগেছে কিনা তা তারাই ভাল বলতে পারবেন। 

আজকের দিনে গেরুয়া সংস্কৃতির দাপুটে নির্বাচনী স্লোগান “জয় শ্রীরাম” ধ্বনির হুংকার বাংলার জনপদে ভীতি ছড়াচ্ছে কিনা তা শুধু তারাই বলতে পারবেন যারা রাম রাজত্বের প্রতিষ্ঠা লগ্নে সেই উঠানে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। ঋষি বংকিমের “বন্দে মাতরম” কিংবা আযাদ হিন্দ ফৌজের এক অখ্যাত মেজর আবিদ হাসান সাফরানির “জয় হিন্দ” আজ ভারতের জাতীয় স্তুতি ও স্লোগান। সেই স্লোগান ও স্তুতির কক্ষচ্যুতি ঘটিয়ে আজ সারা ভারত জুড়ে যে “জয় শ্রীরাম” স্তুতির মহা এন্তেজাম বা যজ্ঞ চলছে তা সর্ব ভারতীয় হিন্দু রাজের হিতে বিপরীত হয় কি না তা সময়ই বলে দেবে। কেননা আমরা দেখেছি ধর্মীয় গোঁড়ামী কখনোই কোন জাতি গোষ্ঠিকে স্বস্তি দেয় নি। মুসলমানদের “নারায়ে তাকবির” যেমন জাতিগত মেল বন্ধনে কক্ষচ্যুতি ঘটিয়েছে তেমনি আজকের তলোয়ার ও তিলক চন্দন সমৃদ্ধ গেরুয়াদের “জয় শ্রীরাম” এক সময় লক্ষচ্যুত হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে তা হাত গুনেই বলে দেয়া যায়।

  

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2